স্বীকৃতি

বিষ্ণুপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

দেড় ফুট দৈর্ঘ্যের বাহু বিশিষ্ট এক একটি ঘনকাকার স্বচ্ছ ফাইবারের আধারের মধ্যেকার হাল্কা সোনালি ফ্লুইডের মধ্যে রাখা আছে ব্রেনগুলো। ফ্লুইডের অনবরত সার্কুলেশন চলছে। মনিটরে নানান গ্রাফ ওঠা নামা করছে।

প্রতিটি ব্রেন শুধু জীবন্তই নয় চিন্তাশীলও। 

 সোনালি তরলটা হল কৃত্রিমভাবে তৈরি এমন এক রাসায়নিক যাতে কতকটা সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডের ধর্ম বিদ্যমান। এই ফ্লুইড একাধারে ব্রেনগুলোকে প্রিজার্ভ করছে আবার নিউট্রিশানও প্রোভাইড করছে।
 
 প্রতিটি ব্রেনের জন্য অবশ্য আলাদা আলাদা আধার। চল্লিশ ফুট বাই কুড়ি ফুট এয়ারকন্ডিশনড হলটিতে দৈর্ঘ্য বরাবর মোট চারটি সারিতে ভার্টিকাল এগ্রো ফার্মিং এর আদলে থাকে থাকে সাজানো আছে আধারগুলো। প্রতিটি সারিতে উল্লম্বভাবে সাজানো আছে দশটি করে দুই ফুট চওড়া করে টানা লম্বা প্ল্যাটফর্ম। প্রতি দুটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে আবার দুই ফুটের গ্যাপ। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের উপর পাশাপাশিভাবে পরপর সাজানো আছে আধারগুলো।

হলটিতে সাকুল্যে আটশত আধারে প্রিজারভেটিভ আরকে রাখা আছে আটশো মস্তিষ্ক। তাবড় তাবড় জিনিয়াসদের মস্তিষ্ক। এক একজন এক এক বিষয়ে দিকপাল।

আজ বেশ কয়দিন হল এই ব্রেন প্রিসার্ভেসান এণ্ড নার্চারিং ফার্মে জুনিয়র ফেলো সায়েনটিস্টের পোস্টে জয়েন করেছি। জায়গাটা একটা পাহাড়ের ভ্যালি মত অংশে। চারপাশের পরিবেশ মনোরম ।

আমাদের সেঞ্চুরির প্রজন্ম ফেট বা ডেস্টিনি মানি না। কর্মই মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয় এটাই জানি আমরা। তাই বেশ অনেকগুলি ব্রেন প্রিজার্ভশন সেন্টারের প্রসপেক্টিভ ডিটেল চেক করে আমি এই ব্রেন প্রিজারভেসান সেন্টারটা খুঁজে পেয়েছি। এখানে নাগেশ্বর নন্দীর সজীব এবং সচল মস্তিষ্কটি প্রিজার্ভ করা আছে। জুনিয়র ফেলোশিপের জন্য আবেদন মঞ্জুরও হয়ে গেছিল ঝটপট। কারণ আমার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড বরাবরই ধাঁ চকচকে।

আজ দুই সপ্তাহ হয়ে গেল নাগেশ্বর নন্দীর সংরক্ষিত ব্রেনটার জন্য কয়েকটা দিনের স্লট বুক করেছিলাম। অভীষ্ট মেলের অপেক্ষায় একটা একটা করে দিন অপেক্ষা করেছি। অবশেষে আজ রাত এগারোটায় ঢুকল মেলটা। স্লট গ্রান্টেড। সামনের বেশ কয়েকটা দিনের জন্য নাগেশ্বর নন্দীর সংরক্ষিত ব্রেনটা আমার দখলে আসতে চলেছে। মনে মনে উত্তেজিত হয়ে পড়ি। এক কাপ এনার্জি বুস্টার কফি বানিয়ে নিয়ে আমি আমার ল্যাপটপটা খুলে বসি। এই তো পাসওয়ার্ড আর আইডি। আর বিশেষ সাবধানতার জন্য সিক্রেট কোড।

আমার রিমোট সেনসরিং মনিটারের স্ক্রিন অন করি। তারপর  ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করি ডিভাইসটাকে।
 আই ডি পাসওয়ার্ড আর সিক্রেট কোড অটো ইনসার্ট করে লগ ইন করতেই স্ক্রিন জুড়ে হাল্কা আইভরি রঙা পর্দাটার একটা কোণায় ফুটে ওঠে নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনটার একখানা ত্রিমাত্রিক ছবি। 
এরপর আমার ল্যাপটপের একটা ফাইলের কনটেন্ট সেন্ড করি। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে স্ক্রিনে ফুট ওঠে 'সেন্ট সাকসেসফুলি'।

নিয়মমাফিক আমার টোটাল কাজের পুরো ফিরিস্তিটা এখন নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনে সেঁধিয়ে দেওয়ার কথা। সেই ব্রেন এখন তার মতো করে চিন্তা করবে। কিছু সাজেশন দেবে। তার সেই সাজেসন ফুটে উঠবে স্ক্রিনে। তবে কোডের আকারে। যে কোড শুধু আমিই ডিকোড করতে পারব। 

আর কাজের শেষে প্রিজার্ভ করা ব্রেন থেকে সবটুকু ডেটা ড্রেন করে নিজের ডিভাইসে নিয়ে নিলেই হল। ওই ব্রেনে তার কোনও ট্রেস পর্যন্ত থাকে না। এটাই প্রটোকল।

এভাবেই সবাই প্রিজার্ভ করা ব্রেনের হেল্প নেয় এখনকার সেঞ্চুরিতে। কারণ ব্যক্তি সহকারীকে এ যুগের আমরা আর ভরসা বা বিশ্বাস কোনটাই করি না। 
আগে হামেশাই একজনের গবেষণার কাজের থিম থেকে শুরু করে বিষয়বস্তুর ডিটেইলস পর্যন্ত চুরি হয়ে যেত। উদ্ভাবক হয় তো রাম। কিন্তু সহকারী শ্যাম ভাঁড়িয়ে নিল তার আইডিয়া। আর তারপর রামের আগে শ্যাম যদি কাজটা সমাধান করতে পারে তো সে নিজের নামেই পেটেন্ট নিয়ে নিতে এক মুহূর্তকাল দেরি করত না। 

কিন্তু আমি আমার কাজের ডিটেইলস নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনে ইনপুট করলাম না। কারণ আমার তো নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনের সাহায্যের দরকার নেই। আমার দরকার ওই ব্রেনের অতীত স্মৃতির এক টুকরো অংশ।

আমি নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস এবং কর্টেক্স উভয় অংশের মেমোরি স্টোরেজ ট্র্যাক করার কাজ শুরু করলাম। কারণ মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশ স্মৃতির কোন অংশকে অঙ্কুরে বিনাশ করবে আর কোন অংশকে আমূল প্রোথিত করবে কর্টেক্সের অন্দরমহলে সেটার রহস্য বড় জটিল।
আমার ল্যাপটপের সুপার লার্জ মেমোরিতে নাগেশ্বর নন্দীর মেমোরির ডুপ্লিকেট আপলোড হতে থাকে।

এই ফাঁকে আমার কাজের ফিরিস্তি এবং কে এই নাগেশ্বর নন্দী একটু বলেনি না হয়।

আমি অভীক দে। ফাংগাস থেকে কিভাবে এনার্জি জেনেরেট এবং প্রিজার্ভ করা যায় সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছি।

নাগেশ্বর নন্দী একজন প্রবাদ প্রতিম বোটানিস্ট। প্লাস্টিক ইটিং ফাংগাস আবিষ্কারের জন্য এই পৃথিবীর ভবিষ্যত প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁকে মনে রাখবে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
নেচার পত্রিকায় বেরোনো তাঁর প্রতিবেদনটা আমি পড়েছিলাম আমার পি এইচ ডি করার সময়েই।

এক সময় মেমোরির কপি আপলোড কমপ্লিট হয়।  আমার ল্যাপটপে নাগেশ্বর নন্দীর কপি হওয়া মেমোরির রিটেন ভার্সানটা ডিসপ্লে শুরু করি।

টানা তিন দিন ডিসপ্লে চলে। 
কিন্তু নাঃ! আমার কাঙ্খিত বিষয়টা অধরাই রয়ে যায়। জানালার বন্ধ কাঁচের বাইরে তখন ভোরের আলো নাক ঘষছে।

(2)
আজ আমার ঠাকুরদার জন্মদিন। ঠাকুরদার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। ঠাকুরদা আত্মহত্যা করেছিলেন। আমি তখন অবশ্য জন্মাইনি। বাবাই তখন মাত্র পনেরো বছরের। বাবা তাঁর ঠাকুরদাদার কাছেই মানুষ হয়েছিলেন। বাবার ঠাকুরদাদা বাবাকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তেই দেননি। বিজ্ঞান পড়ে শেষে নিজের ছেলেটা পাগল হয়ে আত্মহত্যা করল। নাতিকে তাই তিনি আর ওই পথ মাড়াতে দেন নি। আমার বাবা গ্রামের স্কুলের ইংরাজির মাস্টারমশাই হয়েছিলেন।

একটু বড় হয়ে আমি শুনেছি আমার ঠাকুরদা ছিলেন একটু খ্যাপাটে ধরনের মানুষ। গাছপালা নিয়ে পড়ে থাকতেন সারাদিন। বোটানিতে ডক্টরের ডিগ্রি ছিল তাঁর। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে বছর পাঁচেক কী সব গবেষণাও করেছিলেন ।কিন্তু তারপর হঠাৎ একদিন কী সব মনো মালিন্যের কারণে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কাজ ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী আর ছেলেকে মানে আমার বাবাকে নিয়ে ফলতার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস  শুরু করেন। ফলতাতেই ছিল ঠাকুরদাদাদের আদি বাড়ি। একতলা বাড়ির ছাদে একটা পলি হাউস তৈরি করে ঠাকুরদা সারাদিন সেখানেই পড়ে থাকতেন। নানান ধরনের মাশরুম আর ফাংগি নিয়ে কারবার ছিল ঠাকুরদার। আমি বড় হয়ে দেখেছি পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ একতলার ছাদে সে পলি হাউসের কাঠামো। 
আমার ছোটবেলাতেই আমার বাবা ঠাকুরদাদাদের সাবেকি একতলার বাড়িটা ছেড়ে তার পাশে নতুন বাড়ি করে উঠে এসেছিলেন।

আমার কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বরাবর অঙ্ক বিজ্ঞানের দিকেই ঝোঁক ছিল। আর বাবাও সেটা বুঝতেন। আমাদের গ্রামের স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আমি কলকাতায় পড়তে চলে এসেছিলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজে বোটানি অনার্স। ওখানেই স্নাতকোত্তর শেষ করে  পি এইচ ডি করারও সুযোগ পেলাম। ব্যাঙ্গালোর রওনা দেবার আগে বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে ফলতা গেলাম। বাবা আমাকে ডেকে ঠাকুরদার কাবার্ডের চাবি তুলে দিলেন আমার হাতে। 

"এই কাবার্ডে বাবার গবেষণার সব কাগজপত্র আছে। অভি, আমি বিজ্ঞানের লোক নই। তাই এতদিন এসব আমার কোনও কাজে লাগেনি। তুমি তোমার ঠাকুরদাদার বিষয়টাকেই বেছে নিয়েছ। হয়ত এসব তোমার কাজে লাগলেও লাগতে পারে।"
 
পড়ার টেবিল সংলগ্ন কাবার্ডটা খুললাম। বহুদিন খোলা হয়নি এটা। ভেতরে অনেক বইয়ের সঙ্গে একটা ট্যাব পেলাম। আর একটা ছোট প্লাস্টিকের বক্সে বেশ কিছু মেমরি কার্ডও। পরদিনই আমার কলকাতা হয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যাওয়ার কথা। তাই আমার লাগেজের মধ্যে ট্যাব আর মেমোরি কার্ডগুলোকে ভরে নিলাম । আর একটা জিনিসও নিলাম সাথে। আমার ঠাকুরদাদার লালচে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠার ডায়েরি।

যত পড়েছি সেই ডায়েরি ততই রোমাঞ্চিত হয়েছি। পরিবেশের প্রতি মানুষটার ছিল পরম মমত্ববোধ। ঠাকুরদাদের সময়ে দ্বিতীয় বারের জন্য লিউকোসিস অতিমারি থেকে তখন সবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর সব দেশ। ঠিক সেই সেই মুহূর্তে পৃথিবীর এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে বিপদঘন্টা বেজে উঠল। গ্লাভস, পিপিই কিট ইত্যাদি সিঙ্গল ইউজ নাইলন ও প্লাস্টিক বর্জ্যে ছেয়ে গেছিল পৃথিবী। 
জাপানিদের আবিষ্কার করা সুপার এনজাইম যা বর্জ্য প্লাস্টিক পলিমারকে মনোমারে ভেঙে দিয়ে পুনঃচক্রায়ণে সাহায্য করত তাও তখন ফেলিওর। 

এই পরিস্থিতিতে ঠাকুরদার মাথায় প্লাস্টিক ইটিং ফাংগাস নিয়ে কাজ করার গোঁ চাপে। কিন্তু এসব অলীক ব্যাপার তকমা দিয়ে গবেষণার জন্য সরকারি তরফে কোনও রকম অনুদান ধার্য করা হয় নি। উপরন্তু তাঁর সিনিয়ারের সাথে মতানৈক্য ঘটে। আর তারপরেই  ঠাকুরদাদা চলে আসেন তাঁর পৈতৃক ভিটায়। একান্তে নিজের মতো করে কাজ করবেন বলে। ঠাকুরদার ওই ডায়রিতেই পেয়েছিলাম নাগেশ্বর নন্দীর কথা।
সবাই ডঃ অজয় দের কথা ভুলে গেলেও এই মানুষটাই না কী ঠাকুরদার সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখে গেছিলেন। আমাদের ফলতার বাড়িতেও বেশ কয়েকবার এসেছিলেন তিনি।

জানালার বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়েছে অনেকক্ষণ। ঘড়িতে আটটা। আর মাত্র তিন ঘণ্টা। আইডি পাসওয়ার্ড ইনভ্যালিড হয়ে যাবে। ভিতরটা অস্থির কষ্টে ছটফট করে উঠছে। আবারও এই ব্রেনটার জন্য আবেদন করে হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে। 
 আজ ঠাকুর্দার জন্মদিন। আজই যদি হাতে চলে আসত জিনিসটা। তবে আমার তরফ থেকে সেটাই ঠাকুর্দার জন্মদিনের সেরা উপহার হতে পারত। 

 হঠাৎ দমকা বাতাসের মতো মাথায় মতলবটা খেলে যায়। রিমোট সেনসরিং ডিভাইসটার স্ক্রিন অন করে লগইন করি। একটা শেষ চেষ্টা।
নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনের ত্রিমাত্রিক ছবিটা স্ক্রিনের উপরের ডানদিকের কোণে ফুটে উঠল। নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনের অতীত মেমোরি না খুঁজে এবার আমি  'নাইলোটিং ফাংগাস' আর 'অজয় দে' কথাটা লিখে ইনপুট করি। ডেটা আপলোড হতে কয়েকটা মাত্র মাইক্রো সেকেণ্ড লাগে।

আর তারপরেই অভাবনীয় ভাবে আমার মনিটরে দেখায় যে নাগেশ্বর নন্দীর হিপোক্যাম্পাসে কিছু মেমোরি জেনারেট করেছে। মুহূর্তকাল দেরি না করে ড্রেন করে স্টোর করে নিই আমার ল্যাপটপের মেমোরি কার্ডে। 

তার মানে হিপোক্যামপাস বা কর্টেক্স ছাড়াও নাগেশ্বর নন্দীর ব্রেনের অন্য কোথাও অন্য কোনও চোরা কাল কুঠুরিতে তার অতীত অপরাধের স্মৃতি তলিয়ে গেছিল বা লুকিয়ে বসে ছিল। যা ঠাকুরদার আবিষ্কার করা প্লাস্টিক ইটিং ফাংগাসের নাম আর ঠাকুর্দার নামটা দেখেই আবার হিপোক্যাম্পাসে ভুস করে ভেসে উঠেছে। 
মানুষের ব্রেন এক অপার বিস্ময়ের আধার। আর তাই আজও তার কদর। এর সাথে কোনও কৃত্রিমতা পাল্লা দিতে পারে নি এখনও পর্যন্ত।

আমার মনে হয় আমার হাতের মুঠোয় এখন আমার ঠাকুরদাদার অমূল্য স্বীকৃতির ইতিহাস।

একটা বোতামের চাপেই আমার ল্যাপটপের স্টোর হওয়া নাগেশ্বর নন্দীর মেমোরির রিটেন ভার্সানটা ডিসপ্লে হতে শুরু করে। 

'ফুলিশ অজয় দে। তোর অমূল্য নাইলোটিং ফাংগাস নিয়ে আর্টিক্যালটা আমার নামেই ছেপে ছিল নেচার পত্রিকা। তাতে তোর কী এমন ক্ষতি হত! এর জন্য গর্দভ আত্মহত্যা পর্যন্ত করে নিলি!'

ঠাকুর্দার ডায়েরির একটা অংশ পড়ে আমি এমনটাই আন্দাজ করেছিলাম। 

ঠাকুর্দার ডায়েরি অনুযায়ী সময়টা ছিল হেমন্তের শেষ। এক রাতে উল্কাবৃষ্টির সম্ভাবনার কথা ফলাও করে বেরিয়েছিল দেশের সবকয়টি প্রচলিত খবরের কাগজে। ঠাকুরদা যথারীতি পড়েছিলেন তার একতলার ছাদের পলি হাউসে। এমন সময় কিছু একটা জ্বলন্ত সবুজ রঙা আলোর তৈরি জিনিস তাঁর পলিহাউসের ছাদ ভেদ করে ভিতরে চলে আসে। সে রাতে খুব একটা ঠাহর করতে পারেননি। পরদিন একটা পাত্রে অদ্ভুত দর্শন কিছু  শ্যাওলার মতন প্যাচ দেখতে পেলেন তিনি। ওই পাত্রে তাঁর নিজের গবেষণা থেকে পাওয়া একটা তরল ছিল। তার রংটা হাল্কা হলুদ ছিল। কিন্তু এখন রঙটা কেমন যেন তুঁতে তুঁতে। আগে কখনও এমন ফাংগাসের পরিচয় পাননি তিনি। তাহলে কি উল্কাপাতের ফলে এই পরিবর্তন?

কদিন বাদে তিনি অবাক বিস্ময়ে দেখেন যে সেই পাত্র থেকে বেরিয়ে ওই অনামী ফাংগাসটা পাশের প্লাস্টিক টবটার গায়ে ছেয়ে গেছে  আর তার দুদিনের মধ্যেই প্লাস্টিকের টবের গাটা কেমন যেন জ্যালজেলে হয়ে গেল, আর তার দু একদিন বাদেই প্লাস্টিক টবটা পুরোপুরি ভ্যানিশ করে গেল।

আর কিছুদিনের মধ্যে ব্যাপারটাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে ফাংগাসটার প্লাস্টিক অথবা নাইলন জাতীয় পলিমারকে খেয়ে নিশ্চিহ্ন করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।
এই তথ্য তিনি শুধুমাত্র নাগেশ্বর নন্দীকেই জানিয়েছিলেন। আর তিনিই আগ বাড়িয়ে ফাংগাসটার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন।

এ পর্যন্ত তথ্য ঠাকুরদাদার ডায়েরি থেকে পেয়েছিলাম আমি।

আর ডায়েরি লেখেননি ঠাকুরদা। আত্মহত্যা করেছিলেন। মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস করে প্রতারিত হওয়ার ধাক্কাটা সহ্য করতে পারেননি!

আজ এই পর্যন্ত।
চরম ক্লান্তির মধ্যেও এক পরম তৃপ্তি বোধ অনুভব করছি মনে মনে।
কাল সকাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে আমার লড়াই। আমার ঠাকুরদাদার ন্যায্য স্বীকৃতি  আদায়ের লড়াই।

বৈশাখী ২০২৪