এই পাহাড়ের দেশে আসার আগে পাহাড় টাহাড় সম্বন্ধে অমলের ধারণাই ছিল না। চেনা সমতলের মফস্বল শহরের সঙ্গে কোনও মিলই নেই এখানকার চালচলনে। বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই অফিসে ছুটির তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। অফিস মানে ডিএম অফিস। কালিম্পং তো এখন জেলা। অমল কাজ করে এ'খানেরই ডিএম অফিসে। সদ্য বদলি হওয়া কনিষ্ঠ কেরানি। অমলের মা বাবা ভাই বোন, মানে বলতে গেলে ত্রিসংসারে কেউই নেই। থাকবার মধ্যে ছিল এজমালি এক মামাবাড়ি। তা সেই তারাও বহুদিনই যোগাযোগহীন। তাই যখন এখানে পোস্টিং হল, অন্য কেউ হলে ভাবত পানিশমেন্ট ট্র্যান্সফার, অমল মোটেই তা ভাবেনি। একলা মানুষ। কলকাতাকে টা টা জানিয়ে এক কথায় চলে এসেছে এখানে। একটা ঘরভাড়া নিয়েছে, একটু বাইরের দিকে। জলটা সমস্যা। নিজেই খেটেখুটে নিয়ে আসে কাছেরই একটা ঝোরা থেকে। আর খাবার জল, কুড়ি লিটারের জার কিনে নেয়। নিজের যা রান্না চালে ডালে ফুটিয়ে নেওয়া আর ওমলেট, চিকেন-সেদ্ধ নিজেই করে নেয়। নেট কানেকশন বাসায় আসে না। টাওয়ার নেই। বন্ধুদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেঞ্জারে হাই হ্যালোটুকু সেরে নেয়, অফিসে কাজের চাপ না থাকলে, অফিসের নেটে। সেই অমলের হঠাৎই বিয়ে হয়ে গেল। হঠাৎ বলছি বটে, কিন্তু হঠাৎ নয় ঠিক। মানে অমল ঠিক হঠাৎ বলে ভাবে না তার এই বিয়েটাকে। যেন আগের থেকেই ঠিক করা ছিল। মাঝে মধ্যে বিকেলের ঝোঁকে অফিস ফেরতা বাস স্ট্যান্ডের দিকে কোনও খাবার জায়গায় ঢুঁ মারতো বেচারি। সে দিনও তেমনই। নির্জন এক রেস্তোরাঁয় কোণার দিকে বসে স্মৃতির জাবর কাটছিল কফি স্যান্ডউইচের অর্ডার দিয়ে। পাশের টেবিলে বসেছিল এক মেম সাহেব। মাঝে মধ্যেই সাহেব মেমসাহেবদের দেখা মেলে এই শহরে। অল্প বয়েসি মেয়ে। হয় ট্যুরিস্ট নয়ত এই পাহাড়ি শহরে অনেক কটা চার্চ তারই কোনও একটারঅধিবাসিনী! অমল খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি মেয়েটাকে। ক'দিন পরেই রবিবার দুপুরে আবার দেখা হল অদ্ভুত জায়গায়। জনশূন্য ভাঙাচোরা লেপ্রোসি হাসপাতালের চত্বরে। অমল খুব নিমগ্ন হয়ে প্রায় ধ্যানমগ্ন যেন, তাকিয়েছিল বিরাট নীল ক্যানভাসে আঁকা পাহাড়টার দিকে। মাঝের খাদ আর নদীর পরে ওই সবুজ পাহাড়টা, ওটা নাকি ভুটান। অমল যেখানে বসেছে তার পাশেই আবছা জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি বস্তির দিকে নেমে গেছে আঁকাবাঁকা পায়ে হাঁটা রাস্তা। অনেক নিচে বয়ে যাচ্ছে নীলচে সবুজ এক নদী। মাঝে তীব্র ঢালের এক খাদ। মাথা ঘুরে ওঠে সেদিকে তাকালে। কিছু প্রজাপতি অমলকে প্রদক্ষিণ করে বলতে গেলে প্রায় ছুঁয়ে, হাওয়ায় ভেসে আবার উড়ে যাচ্ছে ওই খাদের ওপরে! পাখির ডাক সচরাচর শোনা যায় না এসব জায়গায়। হঠাৎই কাছেপিঠে কোথাও ডেকে উঠল একটা পাখি। বেশ কয়েকবার ডাকটা শুনে ধ্যানভঙ্গ হল অমলের। পাখিটাকে খুঁজে দেখতে হচ্ছে। সেই খুঁজতে গিয়েই আবিষ্কার করল পাখি নয়, আবার সেই মেয়েটাকে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হাসল অমল। দুটি কারণ অপ্রতিভতার। এক নম্বর সে ইংরেজিতে তত সড়গড় নয়। অথচ সাহেব মেমসাহেবদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলা দস্তুর। যেমন ট্যাক্সিওয়ালাদের সঙ্গে জানো না জানো কথা বলতে হয় হিন্দিতে। আর অপ্রতিভতার দু'নম্বর কারণটা হল সে আসলে কোনও পাখির ডাক শোনেনি। মেয়েটা মুখে আঙুল ঢুকিয়ে আওয়াজ করছিল। যাকে আমরা বলি সিটি মারা। যাকে, আদ্যন্ত একটি অসংস্কৃত কাজ বলে জানে সংস্কৃতিবান বাঙালিরা। এই মেমসাহেব সিটি মারছে আবিষ্কার করে কেন যেন অমল নিজেই বেজায় লজ্জিত হয়ে পড়ল। অনভ্যস্ত ইংরেজিতে আলাপের চেষ্টা করতেই সেই কন্যা, যার নাম একটু বাদেই জানা যাবে, সেই ইসাবেলা লোপেজ বলল, “আপনি বাঙালি? আমি কিন্তু বাংলা বুঝি। বলতেও পারি!” মেয়ে আদতে স্প্যানিশ। কলকাতার ‘নির্মল হৃদয়ে’ ছিল গত দু'বছর। এ'খানে এসেছে কোনও কনভেন্টের টিচার হয়ে মাস ছয়েক আগে। “মুখে আঙুল পুরে সিটি দেওয়া কোথায় শিখলেন? কলকাতায় এসে?” “কলকাতায় এসে সিটি দিতে দেখেছি বটে এখানের লোকজনকে। পুজোর ভাসানে, খেলায় জেতার মিছিলে, অন্য আনন্দের জমায়েতেও। কিন্তু আমার শেখা অনেকই আগে।” অবাক অমল জিজ্ঞেস করল, “বেলেল্লাপনা এই সিটি বাজানো শিখলেন মেয়ে হয়ে?” বলেই লজ্জায় জিভ কাটল মনে মনে। বেলেল্লাপনার আবার নারীপুরুষ হয় নাকি? ব্যাপারটা যে আদৌ বেলেল্লাপনা নয়, বুঝল কিছু পরেই। “আপনারা এখানে সিটি বাজানো বলতে যা করেন সেটা কিন্তু অশিক্ষিত ব্যাপার!” “না শিক্ষা অশিক্ষার ব্যাপার না মিস লোপেজ। ভদ্রতা অভদ্রতার ব্যাপার। ওটা মানে সিটি বাজানোটা আমাদের এখানে খুব ভদ্র ব্যাপার বলে ভাবা হয় না!” “অথচ আমি কিন্তু এই বিদ্যে রীতিমতো ক্লাস করে, পয়সা খরচ করে শিখেছি। আমাকে আপনি এই ব্যাপারে শিক্ষিত বলতেই পারেন!” “আ-আপনি এই সিটি মারায় শিক্ষিত?” “সিটি নয়, মিঃ অমল, হুইসল। এটাকে হুইসল ল্যাঙ্গুয়েজ বলে। আমার দেশেও সবাই এই ভাষা জানে না। বোঝেও না।” অমল আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে আরও বিস্তৃত ভাবে বলল মেয়ে, “আমার দেশ স্পেন। আপনাকে একটু বুঝিয়ে বলি।” এই অবধি বলেই নিজের মোবাইলে ম্যাপ বলে গুগল অ্যাপটা খুলে ফেলল ইসাবেলা লোপেজ। “এই যে দেখুন। এই হল স্পেন মেইনল্যাণ্ড। আমার এখনের বাড়ি গ্র্যানাডায়। আর অনেকটা দূরে এই যে, দেখতে পাচ্ছেন, এই যে প্রায় আফ্রিকার কোলে এই দু'টো ফুটকি, দাঁড়ান জুম করে দেখাই। ইসস, নেটটা এত স্লো এখানে... টাওয়ারই নেই...” কমার্স নিয়ে পড়াশুনো করা অমল এই ম্যাপট্যাপ দেখে ঘাবড়ে গিয়েই বোধ হয় ওই চত্বরে একটু বসবার জায়গা খুঁজছিল। একটা বেঞ্চ মতন জায়গা যেখানে আগে বসেছিল চোখের ইঙ্গিতে সেই দিকটা দেখিয়ে বলল, “একটু বসি?” “চলুন তাই। আমিও আপনাকে বোঝাই হুইসলের ব্যাপারটা।” মনে হল নতুন ছাত্রটিকে পেয়ে তরুণী শিক্ষিকাটি এই পড়ন্ত দুপুরে বেশ খুশি। বেঞ্চে বসে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, বিদেশের কথা ছেড়ে দিন, আপনার দেশেরই কঙথঙ বলে কোনও গ্রামের নাম শুনেছেন?” ‘এ তো ভালো বিপদে পড়া গেল’,মনে মনে ভাবল অমল। এর চেয়ে এই মেয়ে বাংলা না জানলেই তো ভালো ছিল। কিম্বা রায়চকের সেই হোটেল র্যাডিসনে সৌমিকদের পিকনিকে গিয়ে যা হয়েছিল, সেই রকম যদি হত। সে এক কাণ্ড। মনে পড়তেই মেমসাহেবের এই ইন্টারভিউয়ের মধ্যেও গুবগুবিয়ে দুঃখ মেশানো হাসি উথলে উঠল মনে। এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতির বছর তিনেকের একরত্তি ছেলেটা রায়চকের হোটেলের লনে খেলছিল। বাবা মা দাঁড়িয়েছিল কাছেই। ভেতরে পিকনিকের সোরগোল ভালো লাগছিল না। অমল বাইরে দাঁড়িয়েছিল তাই। দোষের মধ্যে দোষ, দেবশিশুর মত দেখতে বাচ্চাটাকে লনে নেমে কোলে নিতে গেছিল বেচারি অমল। ওর বাবা সতর্ক দৃষ্টিতে নজর রাখছিল। অমল হাত বাড়াতেই সেই বাবা, গর্জন করে উঠল, "ডোন টাচ, ডোন টাচ" বলে। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে পিছিয়ে এসেছিল অমল। ইউরোপিয় সাহেব বোধ হয় ভেবেছিল, ছেলের গায়ে যদি অমলের রঙ লেগে যায়। কিম্বা সংক্রামক কোনও দুরপনেয় সাউথ এশিয়ান ট্রপিকাল অসুখ। এই মেমসাহেবের দেখি সেই রকম ইউরোপিয় ভয় কিছুই নেই। দিব্যিএকই বেঞ্চে বসল। আর কী দুঃসাহস, অমলকে চমকাচ্ছে অমলের দেশেরই কী না কী জিজ্ঞেস করে। অবশ্য অমল মনে মনে লজ্জাও পেল। যা জিজ্ঞেস করেছে ওর জানা নেই। সত্যি বলতে কী ওর পড়াশুনো, যাকে বলে জেনারেল নলেজ বড়ই কম। আগ্রহহীন সব বিষয়েই। অমলের মনে হল সত্যিই পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। স্বীকার করল, “না, মানে ইয়ে...” “আমি কিন্তু ওই গ্রামে গেছি! ওই কঙথঙে। মানে এই হুইসলের সূত্রেই। গ্রামটা মেঘালয়ে। শিলং আর চেরাপুঞ্জির মাঝখানে।” “ওইখানেও কি লোকেরা আপনার মত হুইসল দিতে পারে?” “ঠিক তা নয়, জানেন। হুইসলে তো ভোকাল কর্ড লাগে না। ওরা কিন্তু গলা দিয়েই মানে ভোকাল কর্ড দিয়েই আওয়াজ করে। মিউজিক্যাল টোন। সেই সুরেলা নানান পিচ আর ইনটেনসিটির ওঠা পড়ায় ওরা গ্রামশুদ্ধ মানুষ পরস্পরকে চেনে। প্রত্যেকের মা ছোটোবেলায় বাচ্চাকে ওই যে সুরেলা টোনে ডাকে ওই ইউনিক ডাকটিই হয়ে দাঁড়ায় তার ডাকনাম। আর প্রত্যেকেরই একটা করে আলাদা ডাকনাম ওই গ্রামে। সবাই তা বোঝে আর সেই নামে মানে সেই সুরেলা নোটে ডাকেও।” “আপনার এই সিটি মানে হুইসিলে ওই ভোকাল কর্ড লাগে না?” “লাগে নাই তো। এই যে দেখুন!” বলেই মুখের ভেতর এবার আর এক হাতের আঙুল না, দু'হাতের তর্জনী মুখে ঢুকিয়ে তীব্রস্বর বাজায় সুন্দরী। আর সেই মুহূর্তে সেই শব্দে ভেতরে কোথাও ভেঙে যায় অমল। এই মেয়েটাকে মনে হতে থাকে সত্যিই মানুষ নয়, যেন অপার্থিব এক পাখি! যেন ওই প্রজাপতিদেরই মত, চাইলেই ভেসে আসতে পারে খাদের ওপর থেকে পাক খেয়ে। চটকাটা ভেঙে যায় ইসাবেলার পরের কথায়। “দেখেছেন, কথায় কথায় ইভনিং প্রেয়ারের সময় হয়ে গেল। আজ আর না। পরের দিন আবার বলব।” কিন্তু অমলের এই পাঠ ফুরোয় না। পরের রবিবার, তার পরের রবিবার এবং তার পরে মেসেজ আর টেলিফোনে। ইতিমধ্যে অমল জেনে ফেলেছে ইসাবেলার জন্ম দক্ষিণ স্পেনের কাডিস রাজ্যের বোলোনিয়া বলে সমুদ্রপাড়ের এক গ্রামে। সে'খান থেকে সে বড় হয়ে পড়তে গেছিল মাদ্রিদ ইউনিভার্সিটিতে। ওখানেই সে এই হুইসল ল্যাংগুয়েজ শেখে। ভারতবর্ষেরও প্রেমে পড়ে সেখানেই। “মাদ্রিদেই বুঝি এই হুইসল ল্যাংগুয়েজের চল?” “আরে না না, তাই তো আমায় যেতে হল লা গোমেরা বলে স্পেনেরই এক দ্বীপে। সে অনেকদূরে। প্রায় আফ্রিকার কোলের কাছে। সে'খানে লোকেরা এই ভাষায় কথা বলে। সে'খান থেকেই পুরোপুরি রপ্ত করেছি এই শিসের ভাষা। সেখানে স্কুলেও এই ভাষা শেখানো হয়।” “অন্য ভাষায় কথা বলতে পারে না কেউ ওখানে?” “বাঃ রে, তা পারবে না কেন? পারে তো। আর বলেও। কিন্তু তার সঙ্গে এই হুইসলের ভাষাও শেখে। এই তীব্র শিসের আওয়াজ গলার আওয়াজের থেকে অনেক বেশি দূরে যেতে পারে। এমনকি ছ'সাত কিলোমিটার অনায়াসেই। এই পাহাড়ের তলা থেকে ওই পাহাড়ের চূড়া অবধি। আমিও শিখেছি। আর সেই শেখা যাতে ভুলে না যাই, তাই এখানে এসে প্র্যাকটিস করি সময় পেলে।” এতদিনে সেই প্রথম দিনের হুইসল শোনার ব্যাখ্যা পেল অমল। অমল জানল শিস দিয়ে যোগাযোগের প্রথা নতুন নয়। পৃথিবীর আরও কিছু জায়গায় এখনও এ ভাবে কথা বলা হয়। গোমেরার শিস-ভাষায় মোটামুটি একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা কাঠামো আছে। এই ধরনের ভাষাগুলির মধ্যে এই ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা সর্বাধিক। প্রায় ২২ হাজার মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। এই অতুলনীয় ভাষাকে তাই ইউনেস্কো ২০০৯ সালে ‘মাস্টারপিস অব দি ওরাল অ্যান্ড ইনট্যাঞ্জিব্ল ওয়র্ল্ড হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’-র সম্মান দিয়েছে। এই এত সব কথা অমলকে বলেছে ইসাবেলা। না, একদিনে নয়। অন্য অনেক কথার ফাঁকে ফাঁকে। অনেক দিন ধরে। এর মধ্যেই সম্বোধন পালটে গেছে ওদের। “জানো অমল, ওখানেই চার্চে আলাপ হল সিস্টার অ্যাগনেসের সঙ্গে। উনিই আমায় বললেন কলকাতার ‘নির্মল হৃদয়ে’র কথা। আমার আগ্রহ দেখে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। “ওঃ, সেই তোমাদের সেই সৌখিন ভলান্টিয়ার ট্যুরিজমের নেশা?” “মোটেই না। আমি থাকব বলেই এই দেশে এসেছি।” ইসাবেলা গোমেরার চার্চ ঘুরে োখানের সিস্টারদের সঙ্গেই কলকাতার ‘নির্মল হৃদয়ে’ এসেছিল। সেখানে বছর দুয়েক কাটিয়ে সে এসেছে কালিম্পংএর এক কনভেন্টের টিচার হয়ে। ইসাবেলা অমলকে বলেছে নিজের কিশোরী বেলার গল্প। যুবতী বেলার গল্পও। প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রথম ব্রেক আপের পর সুতীব্র ডিপ্রেশন। সে ছিল কার্লোস ওর্তেগা নামের এক ছেলে। কেন যে সম্পর্কটা ভাঙল আজও বোঝে না। তার সঙ্গেও আলাপ ওই হুইসল ল্যাংগুয়েজ শিখতে গিয়েই। সেও এই হুইসল ভাষার ছাত্র ছিল। লা গোমেরায় গিয়ে তার সঙ্গে এই ভাষা শেখার সময়েই আলাপ। ছেলেটা ছিল একটু পাগলমত। কবিতা লিখত। ‘রইল ঝোলা চলল ভোলা’ ভঙ্গীতে একদিন ইউনিভার্সিটির কাজ আর লেখাপড়া শেষ না করেই, ইসাবেলাকেও ছেড়ে ভেসে পড়ল। আক্ষরিক অর্থেই ভাসল। মার্চেন্ট নেভিতে। আসলে ওর রক্তে ছিল সমুদ্র। বলতও সেই কথা। অমলও ওকে বলেছে নিজের বড় হওয়া। ইসাবেলা জেনেছে মা বাবা না থাকা অমলের মামাবাড়িতে কোনরকমে মানুষ হবার ইতিহাস। মফস্বল শহরে টিউশনি করে কায়ক্লেশে একলা বড় হবার গল্প। আর তারপরে এই চাকরি। আলাপ থেকে প্রলাপের দূরত্ব বেশি না। যদি দু'টি মোটামুটি নিঃসঙ্গ প্রাণ কাছাকাছি আসে। বছর দেড়েক আলাপের পরেই, তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল। আমতার অমল মাজি আর কোন সুদূরের পাসারো নিনা। এই নতুন নাম ইসাবেলা নিজেই দিয়েছে নিজেকে। অমল তাকে ডাকে মেয়ে পাখি। স্প্যানিশে সে'টাই পাসারো নিনা। অফিসের গায়ে পড়া দু'একজন সিনিয়র বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, "দেখো ভায়া, ওই বিদেশি কবুতর তোমার বাঁশের খাঁচায় টিকবে তো? দানা খেয়ে উড়ান না দেয় শেষে!” অমলের তেমন বন্ধু কেউ নেই। শুধু অফিসেরই বসাকদা আর বাড়িওয়ালা নবীন রাই ওর এই বিয়েয় সাক্ষী দিয়েছে। ঝামেলা ছিল। বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে এদেশি কারুর বিয়ের আইনি ঝামেলা অনেক। বিয়ের বছরখানেক গড়িয়েছে সবে। এর মধ্যেই একদিন মুখ ঝলমল করে উঠল মেয়ের। কী ব্যাপার? মুশকিল এটাই যে এই মেয়েটা নিজেকে লুকোতে পারে না। ভারতের বন্দরে এসেছে কার্লোস ওর্তেগার জাহাজ। ইমেইলে জানিয়েছে সে, কালিম্পংয়ে আসবে ইসাবেলার সঙ্গে দেখা করতে। তাই মেয়ের এত আনন্দ। অমলকে তার সেই খুশির কথা লুকোলো না মেয়ে। “জানো, মেইলে ও বলেছে আজও আমাকে আগের মতই...” “আজও তোমাকে কী বলেছে আগের মতই?” “ধ্যাৎ, বলব না। সে তোমাকে কিছুতেই বলা যায় না...” খিল খিল করে হেসে উঠল তার পাসারো নিনা। অমল সেই আওয়াজে যেন শুনল যত্নের ফিনফিনে কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ল কোথাও। দিন তিনেক বাদে তার স্কুলে যাওয়ার আগে হুড়মুড় করে ছাদে দৌড়ুলো ইসাবেলা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বলতে বলতে গেল "কার্লোস এসে গেছে।" অমল পেছন পেছন উঠল। ছাদে দিয়ে শুনল পাখির ডাক। এ'পাশ থেকে ইসাবেলা। অন্য কোনও খান থেকে জবাব আসছে ওই পাখির ডাকেই। ইসাবেলা হাসিমুখে ভুরু নাচিয়ে অমলকে বলল, “জানো, বলল ছুটি নিতে। ওর জাহাজ ছাড়বে দিন পনেরো বাদে।" ছুটি নিয়েও নিল। কার্লোস একটা হোটেলে উঠেছে। ইসাবেলা আর অমল ওকে হোটেল ছেড়ে নিজেদের আবাসে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। এল না অবিশ্যি। সে এক ভারি চমৎকার স্বর্ণকেশ যুবক। অমল মনে মনে ভাবল সত্যিই ইসাবেলাকে এর পাশেই মানায়। সে ভারি বেমানান। ইসাবেলাও একদিন অমলকে ঠাট্টা করে বলল, “কী গো, কার্লোস রাজি হলে, ভেসে পড়ব নাকি ওর সঙ্গে?" ঠাট্টা করে বলা কথাই। কিন্তু অমলের বুক ভেঙে যায়। ঈর্ষায় আর অসহায়তায়। সত্যিই তো সে কে। এই নীল নয়না কোথা থেকে এসে তাকে বাঁধনে জড়িয়েছে। কিন্তু তার কতটুকু জানে সে? কীই বা দাবী তার? কীই বা তার নিজের গুণপনা? অমল সেই অর্থে ছুটি পায়নি। ডিএম অফিস। সামনেই ইলেকশন। কার্লোস কিন্তু অমলের অনুপস্থিতিতে বিব্রত নয়। ইসাবেলাও না। দুজনে সাক্ষাৎ হলেই সারাক্ষণ অমলের অজানা স্প্যানিশে অবিরল কিচিরমিচির করে চলে। ইসাবেলা ওরই মধ্যে তার কার্লোসের জন্য নানা রকম রাঁধে। আর কার্লোস হোটেলে ফিরে যাবার পরও অবিরল চলে ওদের আলাপ। সেই পাখির ডাক। ছাদে উঠে... মুহুর্মুহু ডাক ভেসে যায় হুইসল ভাষায়। এ'পাশ থেকে ও'পাশে। একদিকে অফিসের চাপ, অন্যদিকে তীব্র ঈর্ষা। পুড়ে যেতে থাকে বেচারি অমল। ওরা বোঝে হয় তো কিম্বা বুঝেও বোঝে না। দেখতে দেখতে কার্লোসের যাবার দিন চলে এল। কী সব সমস্যায় জাহাজের যাত্রা পিছিয়ে গিয়েছিল। কাজেই প্রথম পনেরোদিন পেরিয়ে একমাসের দিকে গড়িয়ে গিয়েছিল ওর স্থিতি। মে মাস পেরিয়ে এখন মধ্য জুন। পাহাড়ি রাস্তা জুন থেকে অক্টোবর অবধি একটু ভয়ের। তাই বলে যাতায়াত যে বন্ধ থাকে তা' নয়। কার্লোস রওনা হবে। কালিম্পং থেকে ভাড়া করা জিপে শিলিগুড়ি যাবে। সেখান থেকে বাগডোগরা হয়ে কলকাতা। পৃথিবীর বিশাল লবণাম্বুরাশি তাকে ডাকছে। ইসাবেলার মন খুব খারাপ। সকাল থেকে তার নাকের পাটা লাল। অমলের মনের ভেতর কী হচ্ছে সে নিজেও জানে না। এই কান্নাচাপা পরিকে দেখে একদিকে সেই ঈর্ষার আগুন। আবার কার্লোস চলে যাবে বলে তারও মন খারাপ। কিন্তু একই সঙ্গে সেই মন খারাপকে ঢেকে দিচ্ছে এক ধরণের স্বস্তি। অমল নিছকই এক বাঙালি ভদ্রলোক। ও মনে মনে জানে ব্যাপারটা নিচু মনের। কিন্তু এর হাত থেকে তার মুক্তি নেই। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কার্লোসের হোটেলে সি অফফ করতে এসেছে অমল আর ইসাবেলা। জিপে ওঠার আগে পাশ্চাত্য প্রথায়ই একে একে অমল আর ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালো কার্লোস। আলতো ঠোঁটে চুমু খেল ইসাবেলার গালে। জিপ ছেড়ে দিল। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকটায় গাড়ি ঘোরার পরপরই তীব্র স্বরে ভেসে এল পাখির ডাক। ক্রন্দনমুখী ইসাবেলা পাখি তার কান্না সামলে জবাব দিল মুখে আঙুল ঢুকিয়ে শিসের ভাষায়। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে হতে দৌড়ে গেল সেই তীক্ষ্ণ আওয়াজ। অফিস যাবার ঘণ্টা দুয়েক বাদে খবরটা পেল অমল। অফিসটা ডিএম অফিস বলেই পেল। কালিঝোড়ার বেশ কিছুটা আগে প্রবল বৃষ্টি আর ধসে তিস্তায় তলিয়ে গেছে বিদেশি নাগরিক সমেত একটা জিপ। এর পরের চার পাঁচটা দিন অবর্ণনীয় কাটল অমলের। না, কার্লোসের সেই জিপের কোনও খোঁজ প্রথমে পাওয়াই যায়নি। দু'দিনের মাথায় খোঁজ পাওয়া গেল ড্রাইভার আর কার্লোসের শরীরের। বিদেশি নাগরিক। কলকাতা দিল্লির এমব্যাসি আর নানা সরকারি প্রশাসনিক অফিসের ঘন ঘন ফোন ফ্যাক্স আর ইমেইল সামলে প্রশাসনিক ভাবে কালিম্পং থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক সিমেট্রিতে সমাহিত করা হল অভাগা এক দেবদূতকে। অমলের মনের আর শরীরের অবস্থা তলানিতে। ইসাবেলাকে শেষ দেখা করানোর জন্য আনা যায়নি। সে খুব অসুস্থ। স্থানীয় ডাক্তার বলেছেন, পূর্ণ বিশ্রাম। নইলে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হবে। তা ছাড়া প্রবল বৃষ্টি হয়েই চলেছে অঝোর ধারায়। এরও তিনমাস পরের কথা। ইসাবেলাকে স্কুল থেকে দীর্ঘ ছুটি নেওয়াতে হয়েছে। সুতীব্র ডিপ্রেশন আর মনোবিকলন ছিল। কাটিয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। একটা অদ্ভুত লক্ষণ ছিল তার মানসিক বৈকল্যের। কখনও ছাদে উঠে ইসাবেলা নিজের মনেই হুইসল দিত। সেই প্রথম দিনে শোনা পাখির ডাকের মত। যেমনটি সে কার্লোস থাকার সময়ও দিত। ছাদে উঠলে অমল সঙ্গে থাকত। একা ছাদে যেতে দিতে ডাক্তারের মানা ছিল। সেই হুইসলের উত্তর আসত না বলাই বাহুল্য। আর দু'দিন বাদে ইসাবেলা বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া আদর্শ নার্সিং হোমে ভর্তি হবে। ডাঃ পূর্ণিমা তামাং ডেট দিয়েছেন। আজও রোজকার অভ্যাস মত ইসাবেলা ছাদে উঠেছে। অমল যথারীতি তার সঙ্গেই। ইসাবেলার গলায় সেই প্রথম দিনের পাখিটা আবার ডেকে উঠল। এবং কী আশ্চর্য, কোন পাহাড়ের থেকে যেন উচ্ছল জবাব ভেসে এল। এতদিন বাদে আবার সেই পুরোনো ইসাবেলা পূর্ণ চোখে ফিরে তাকাল অমলের দিকে। আনন্দ উজ্জ্বল সেই চোখ। অমল ওই পাখির ভাষা জানে না। কিন্তু স্পষ্ট অনুভব করল ইসাবেলাকে কেউ বলছে, "কোথাও যাইনি তো আমি। এই তো তোমার ভেতরে, তোমার আদরে মাখামাখি হয়ে আছি। আমি আসছি তোমার কোলে!"