অবলুপ্ত সভ্যতা ও এক ভারতীয় সাধু

মিনোয়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ

প্রাচীন এক সভ্যতা। হরপ্পা মহেঞ্জদরো তথা সিন্ধু সভ্যতার বিবরণ নয়। সে নিয়ে লেখাপত্র পড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পাকিস্তানে গিয়ে সারে চার হাজার বছর আগের হরপ্পা মহেঞ্জদরোর নিদর্শন চাক্ষুষ করা সাধারণ ভারতীয় পর্যটকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই আশ মিটিয়ে দেখেছিলাম আর এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। মিনোয়া সভ্যতা (Minoan civilization)। মায়া সভ্যতা নয় কিন্তু। মিনোয়া (Minoan) সভ্যতা। প্রাচীন, অতি উন্নত এক জীবন চর্যার নিদর্শন। চার হাজার বছর আগে (2000 BC) গ্রীস দেশের এক সভ্যতা। বলা হয় ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা (সিন্ধু সভ্যতাও ব্রোঞ্জ যুগের)। ইউরোপের প্রাচীনতম এবং অতি উন্নত। দু’চোখ ভরে দেখলাম হারিয়ে যাওয়া মিনোয়া সভ্যতার নিদর্শন।

পাথরের ঘর, দেওয়ালে উজ্জ্বল চিত্র

ছড়িয়ে আছে ভাঙা পাথরের ইমারত। বিশাল রাজ প্রাসাদ। ইমারতের দেওয়ালের গায়ে টিকে আছে সেই যুগের রঙিন চিত্রকর্ম—ফুল ফল পাতা। বহু ভগ্ন অট্টালিকায় এখনও দৃশ্যমান মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের হরেক তৈজস পত্র। মাটির হাড়ি (মটকা), রকমারি পটারি। কোথায় দেখেছিলাম ইউরোপের আদি সভ্যতা? অবশ্যই ইউরোপ মহাদেশে। বিজ্ঞানের এক আলোচনা সভায় গবেষণা পত্র পরিবেশনের ডাক পেয়ে গেছিলাম গ্রীসের অন্তর্গত ক্রিট নামের ভূমধ্যসাগরীয় এক দ্বীপে। গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে পৌঁছে সেখান থেকে বায়ু পথে (Augeans Airlines) কিম্বা জাহাজেও যাওয়া যায়। দিল্লী থেকে বিমানে এথেন্স। সেখান থেকে হাওয়াই জাহাজে ক্রিট। সেখান থেকে আবার ভূমধ্য সাগরের জলরাশি ঠেলে ফিরেছিলাম এথেন্স। রাজধানী এথেন্স নয়, আপাতত ক্রিট দ্বীপের কাহিনী। ভূমধ্য সাগরে গ্রীসের অধীনে কয়েকশো দ্বীপ। সৌন্দর্য আর ঐতিহাসিক উপাদানে ঠাসা প্রত্যেকটি দ্বীপ। ক্রিট তেমনই একটি দ্বীপ। আকারে ভূমধ্যসাগরের বহু দ্বিপের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। ক্রিটের কাছেই আরেক দেশ তুরস্ক। দ্বীপটির অধিকার ঘিরে তুরস্ক আর গ্রীসের মধ্যে অতীতে যুদ্ধ হয়েছে অনেক বার। ক্রিট দ্বীপটি এবং তার সভ্যতার সাথে জড়িয়ে ছিল দর্শন বিজ্ঞান যুদ্ধ শিল্প চর্চা, সবই। আর একে জড়িয়ে আছেন আর এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব, বিশ্বজয়ী এক বাঙ্গালী যুবক। মহাজ্ঞানী অসীম সাহসী পরিব্রাজক। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। ক্রিটে আবিষ্কৃত প্রাচীন সভ্যতা দর্শন কালে বারে বারেই মনে হবে তাঁর কথা। আসছি সে প্রসঙ্গে। তার আগে ক্রিটের আরও কিছু কথা। আছে পাহাড়, সমতল ভুমিও। কোথাও রুক্ষতা, কোথাও আবার সবুজ আঙুর ক্ষেত, জলপাই অরণ্য। উঁচু নিচু রাস্তা। আছে বাস স্ট্যান্ড, বড় বন্দর, একাধিক মিউজিয়াম। ক্রিটের প্রধান শহর এবং বন্দরের নাম হেরাক্লিয়ন। উন্নত শহর। প্রশস্থ রাজপথ। মসৃণ পথে ছুটছে অত্যাধুনিক গাড়ি, যাত্রীবাহী বাসও। সমুদ্রের গা-ঘেঁসে শহরটির অবস্থান। এখানকার বহু হোটেলের এক তলায় ভূমধ্যসাগরের জল ঢেউ তুলতে থাকে। ভূমধ্যসাগর তীরে এই হেরাক্লিয়ন শহরেই দেখা মিলবে অতি উন্নত এক সভ্যতার নিদর্শন। প্রাচীন মিনোয়া সভ্যতা। ক্রিট দ্বিপে গড়ে ওঠা প্রাচীন মিনোয়া সভ্যতার রাজধানীর নাম নসস (Knosos)। নসসকে কেন্দ্র করেই মিনোয়া সভ্যতার বিস্তার। বহুতল বাড়ি। উঁচু মানের পয়প্রনালি আর দেওয়ালের গায়ে আঁকা অসাধারন ছবি। সব কিছুই জানান দেয় অতি উন্নত মানের এক জীবনযাত্রা। সেই জীবন যাত্রা এখনও বহমান ক্রিট বাসীর নাচ গান বাড়িঘর শিল্প সাহিত্যে। এমনকি ধর্ম চারনেও। এখানকার খাওয়া দাওয়াও ভিন্ন ধরনের। আর একটি কথা। ভারতীয়দের খুব সম্মান এখানে। পরিবারের সব সদস্য একসাথে থাকে, যেমনটি দেখা যায় আমাদের ভারতে। বড় ভাই দেখভাল করেন বেকার ভ্রাতা বা অবিবাহিত বোনকেও। আমাদের মতই এখানে পাড়া কালচার। রোড সাইড ধাবা। রুটি না থাকলেও রাইস আছে। কাবাব আর রোস্ট মিলবে অনেক রকম। নাচ গান তো থাকবেই। পথে ঘাটে রেস্টুরেন্টে ইচ্ছে হলেই শরীর দুলিয়ে এরা নেচে নেয়। মিনোয়া সভ্যতার এই নিজেকে বহিরাগত মনে হবে না। যেন আমি এদেরই একজন, আর এরাও আমার স্বজন। মাটির নিচে চাপা পড়েছিল মিনোয়ান সভ্যতা। ক্রিট দ্বিপটিই উঁচু নিচু। পাহাড় আর পাথর চারদিকে। তার মধ্যে শক্ত মাটি আর পাথরের ঢিবি। আলাদা ভাবে চোখে পড়বার মত কোন উঁচু ঢিবি নয়। কিন্তু তেমনই এক ঢিবির নিচে আবিষ্কৃত হল ইউরোপের প্রাচীনতম সভ্যতা। ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ আর্থার ইভান্স (১৮৫১-১৯৪১) প্রচুর পরিশ্রম করে উদ্ধার করেছিলেন মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা উন্নত মিনোয়া সভ্যতা। খনন কাজ শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর শুরুতেই (১৯০১) (সম্ভবত এখনও সম্পূর্ণ হয়নি খনন কাজ)।


আরকিওলজিস্ট, আর্থার ইভান্স

আর্থার ইভান্সকে কেউ কি বলেছিলেন খনন কাজ শুরু করতে? পঞ্চাশ বছর বয়সী ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ খনন শুরু করলেন কোন্‌ প্রমাণ বা অনুমানের উপর ভিত্তি করে? এখানেই আসছে ভারতের সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ। [ সূত্রঃ 1. Complete works, Volume 5, Swami Vivekananda; 2. On historicity of Christ, chapter 8, Of notes of some wanderings with Swami Vivekananda]। এছাড়া অন্যান্য সূত্রের কথাও লিপিবদ্ধ আছে বিবেকানন্দ সংক্রান্ত অনেকের লেখায়। মূলত উল্লিখিত দুটো সূত্রের উওর ভিত্তি করেই স্বামীজী আর ক্রিটের যোগসূত্র বর্ণনা করছি। লন্ডন থেকে ভারতে ফিরছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। নেপল্‌স থেকে পোর্ট সইদের (পোর্ট সুয়েজ) পথে। সাল, জানুয়ারী ১৮৯৭। স্বপ্ন দেখলেন স্বামী। শ্মশ্রু গুম্ফ মণ্ডিত এক বৃদ্ধ ঋষি তাঁর সামনে। ঋষি বললেন, ‘জাহাজ এখন তুরস্কের কাছ দিয়ে ক্রিট দ্বীপ পেরিয়ে যাচ্ছে। তুমি কি আমাদের উদ্ধার করতে এসেছ (effect our restoration)? আমি সেই প্রাচীন সন্ন্যাসী সংঘের একজন (Therâputtas; থেরা অর্থ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, আর পুত্তাস মানে সন্তান), যে সংঘের উৎপত্তিস্থল ভারতবর্ষ। আমাদের জানানো হয় যে যীশুখৃষ্ট আমাদের শিক্ষিত করেছেন। আদত কথা, তেমন কোন মানুষের জন্মই হয়নি কখনও। আমার কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে, যদি এই জায়গার মাটি খনন করা হয়’। স্বামীজী বলছেন, ‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন জায়গা খননের কথা বলছেন আপনি?’ বৃদ্ধ ঋষি কাছের একটা জায়গা আঙুল তুলে চিহ্নিত করলেন। তারপর বললেন, ‘এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল’। স্বামীজী বলছেন, ‘ঘুম ভাঙতেই আমি জাহাজের উপর তলার ডেকের দিকে ছুটলাম। ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথা দিয়ে যাচ্ছি আমরা? উত্তর পেলাম, ওই দেখ তুরস্ক, কাছেই ক্রিট দ্বীপ। …এখন মধ্যরাত। আমরা আছি ক্রিট থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে।’ ঘটনার পরবর্তী অংশ আরও আশ্চর্যের। স্বামী বিবেকানন্দ ইংল্যান্ডের এক আরকিওলজিস্ট বন্ধুকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘দেখো তো আমার স্বপ্ন দর্শনের মধ্যে কোন সত্যতা লুকিয়ে আছে কিনা!’ স্বামীজীর স্বপ্ন দর্শন ১৮৯৭ সালে। ইংল্যান্ডের এক আরকিওলজিস্ট বন্ধুকে সেই বছরেই চিঠি লেখেন স্বামীজী। আর ক্রিট দ্বিপে খনন কাজ শুরু হল ঠিক তিন বছর পর, সাল ১৯০১। খনন কর্তা ইংল্যান্ডের আরকিওলজিস্ট, আর্থার ইভান্স। স্বামীজী কাকে চিঠি লিখেছিলেন? ইংল্যান্ডের সেই আরকিওলজিস্ট বন্ধু কে ছিলেন? আরথার ইভান্স অথবা অন্য কেউ? উত্তর জানা নেই। কোন ইতিহাসবিদ, স্বামীজী-গবেষক আমাদের গোচরে আনলে বড়ই উপকৃত হই। আর স্বামীজীর মৃত্যুর পর কলকাতার ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকা জানাল, এক ইংরেজ পুরাতত্ববিদ ক্রিট দ্বীপে খনন কাজ চালিয়ে খৃষ্টান ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন’।


মিনোয়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ (রাজ প্রাসাদ)


ফসল সংরক্ষণের মাটির পাত্র (মটকা)

খনন কাজ খুবই কষ্টসাধ্য এবং ব্যয় বহুল। বহু সময়েই মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা অতীত ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আর্থার ইভান্স ক্রিটের মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা মিনোয়া রাজাদের প্রাসাদ, নসস (Knoss) আবিষ্কার করেছেন। পৃথিবীর গোচরে এনেছেন মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা ইউরোপের প্রাচীনতম এক সভ্যতা। আমাদের ভারতবর্ষও এক প্রাচীন সভ্যতার দেশ। ভূমধ্য সাগরের তীরে ক্রিট দ্বীপে আবিষ্কৃত আরেক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখতে পেলে আমাদেরও ভালো লাগবে।


মিনোয়া রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ


মিনোয়া রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ


মিনোয়া রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ

ছবি লেখকের ক্যামেরায় [লেখক পরিচিতিঃ Dr. Soumitra Kumar Choudhuri, M.Sc., Ph.D., পূর্বতন বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700026]

বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত