আগুন রঙের বুলেট – অনীশ দেব

বরাহনগর, কলকাতা

অনীশ দেব। রহস্য-রোমাঞ্চের বেতাজ বাদশা, সায়েন্স ফিকশন জঁরের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। কয়েক মাস আগে তাঁর অকালমৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যজগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করে তাঁরই লেখা একটি বই নিয়ে আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া।

আগুন রঙের বুলেট। ন'টি গল্প এবং একটি উপন্যাসিকায় মোড়া এই বইয়ের দু-মলাট। প্রতিটি লেখা পড়তে পড়তে আপনি ছিটকে যাবেন! রুদ্ধশ্বাস,টানটান গল্পগুলি আপনার মনে শিহরণ জাগাবেই!



গল্প:'আগুন রঙের বুলেট'। 
রনিক আর তিতিয়া। সুখী দম্পতি। তবে সেই সুখ বেশিদিন সইল না! হরিয়া যাদবের সঙ্গে নোনা সামন্তের এলাকা দখলের লড়াইয়ের মাঝে রাস্তায় একটি বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে শোনার বন্দুকের শিকার হয় তিতিয়া। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে যায় রনিক।ছক কষতে থাকে। নোনার বউ রেখার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। নোনার অদ্ভুত খেয়ালের কথা বলে রেখা। 'ভগবানের লটারি'। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দু'জন পরস্পর দুটি বন্দুক কপালে ঠেকাবে। একটি গুলিভরা,অন্যটি ফাঁকা। নোনা প্রতিবার লটারি জিতে যায়। কিন্তু রনিকের সঙ্গে এই 'লটারি' খেলতে গিয়ে নোনা সামন্ত হেরে গেল কেন? গল্পের সমাপ্তিতে রনিকের প্রতিশোধের মধ্যেও কোথাও মিশে গেছে রেখার স্বস্তির আভাস।



গল্প:'ট্রেনের কামরায় দেখা লোকটা'। 
আটটা দশের বজবজ লোকাল। গল্পের কথক নিত্যযাত্রী। প্রতিদিনই দেখেন একটি লোককে,সে যে কামরাতেই কথক উঠুন না কেন! এমনকি একদিন কথক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছেন, সেদিনও। এ কি নেহাতই কাকতালীয়। প্রতিটি স্টেশন এলেই লোকটা ক্রমশ চঞ্চল হয়ে উঠছেন। জানলার বাইরে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। কাকে? ভদ্রলোক জানালেন,তার‌ নাম পাপিয়া। তার প্রেমিকা। ভদ্রলোক পেশায় জ্যোতিষী। সেই সূত্রেই আলাপ। বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। নাকচ করে দিলেন পাপিয়ার বাবা কেশববাবু। ক্রোধে মত্ত হয়ে তুকতাক করে তাদের দোকান 'শাড়িঘর'-এর বদনাম ছড়ালেন ভদ্রলোক। সবাই 'শাড়িঘর'-এর শাড়ি পরে সুইসাইড করছে। কেশববাবুরা পালিয়ে গেলেও ভদ্রলোক জানলেন পাপিয়া ওর এক বন্ধুর বাড়িতে আছে‌। ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক। পাপিয়া আসেনি। আজও অপেক্ষায় দিন গোনেন ভদ্রলোক। আসবে কি পাপিয়া আজ?

গল্প:'পাতায় পাতায় পাপ'। 
বাবা,মা এবং ছেলের গল্প। বাবা রোজ মা'কে বলে, "তোর জীবনের পাতায় পাতায় পাপ"। মদ খেয়ে মাতলামি করে। মা'কে মারে। গালাগালি দেয়। মা সহ্য করে। কাঁদেও। ছেলের ইচ্ছে করে, মা'কে এই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে,একটু শান্তি দিতে।
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। অত্যাচার বেড়েই চলে। হঠাৎ একদিন বাবা আর ফেরে না। খুশির হাওয়া বয়ে যায়। মা গান গায়। একদিন মা'র বাগানে গিয়ে মনে হয়, বাদুড় করবীগাছের পাতা খাচ্ছে। কেন? চোখ চলে যায় করবীগাছের দিকে। সাদা করবী ফুলের রঙ লাল! কেন? মা কি সব বুঝতে পেরে যাবে?

গল্প:'খুনের আগে,খুনের পরে,এবং তারপর'।
রণদেব ওরফে রনি ড্রাগ নেটওয়ার্কের মেগা সাইজের মাফিয়া‌। তাকেই আজ 'মাইনাস'-এর প্ল্যান কষেছে গল্পের কথক। রনি থাকে সাউথ সিটি মলের একটা আলট্রামর্ডান হাইরাইজে। সিকিউরিটির চোখে ধুলো দিয়ে মারণাস্ত্র নিয়ে ঢোকে খুনি এবং যথাসময়ে খুন করে। ক্রাইম সিন নিখুঁত ভাবে সাজায়। পুলিশ আসে। সাব-ইন্সপেক্টরও। তল্লাশি শুরু হয়। পাওয়া যায় একটি ফোন। কললিস্টের লাস্ট নম্বরে ফোন করে ফেলে সাব-ইন্সপেক্টর? কী হয় তারপর?

গল্প:'অপারেশন সিলভার স্টার'। 
গল্পের নায়ক রোমান। তার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা বা অসুখ আছে। আসলে ওর মাথার দিকটা নর্থ পোল,পায়ের দিকটায় সাউথ পোল। রোমান হিউম্যান ম্যাগনেট। কাকা সিজারের সঙ্গে একদিন রোমান ব্যাঙ্কে যায়। সেখানে রুদ্ধশ্বাস ব্যাঙ্ক ডাকাতির মাঝে পড়ে কীভাবে ডাকাতদলকে ধরাশায়ী করে তার এই অদ্ভুত ক্ষমতার মাধ্যমে, তা জানতে হলে পড়তেই হবে টানটান উত্তেজনায় ভরপুর এই গল্প।

উপন্যাসিকা:'সংঘর্ষ'। 
গল্পের নায়ক 'মেহান'। মেহান চিরব্রতর পার্সোনাল সার্ভিস রোবট। চিরব্রত শিক্ষক। কাসুন্দীগঞ্জ অঞ্চলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ান তিনি। মেহান প্রতিবাদী। ফ্যান্টার দলবলের অত্যাচার সে মুখ বুজে সহ্য করে না। স্কুলের হেডমাস্টারমশাই চান স্কুলে একটা ফ্রি কম্পিউটার সেন্টার হোক‌। চেয়ারম্যানের নির্দেশ তার মনোনীত লোকাল কোম্পানিকে এর বরাত দেওয়া হোক। হেডমাস্টারমশাই তা চান না। 'সংঘর্ষ' বাঁধে‌। মেহানের বুদ্ধিতে অভিনব প্রতিবাদে অবশেষে রাজি হন চেয়ারম্যান। কীভাবে মেহানের 'ফোর ল'জ অফ হিউম্যানিটি' কাজ করে,তা জানতে গেলে এ উপন্যাসিকায় ডুব দিতেই হবে। মেহানকে ভালোবেসে ফেলবেন পাঠক,এটুকু বলতেই পারি।
এছাড়াও, আরও চারটি গল্প রয়েছে।
গল্পগুলির নামগুলির দিকে যদি খেয়াল করেন, তাহলে দেখবেন প্রত্যেকটি নামই আকর্ষণীয়। নামকরণের মুন্সিয়ানার জন্য লেখককে কুর্নিশ জানাই।
সৌজন্য চক্রবর্তীর আঁকা প্রচ্ছদ যথাযথ। পত্রভারতী প্রকাশনীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা লেখকের লেখা এই দশটি রুদ্ধশ্বাস, জমজমাট লেখা দু-মলাটে বন্দি করে পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য। 
তাহলে,আর দেরি কেন? পড়তে শুরু করুন, না হলে অনেক কিছু মিস্ করবেন!


বই:আগুন রঙের বুলেট।
লেখক:অনীশ দেব।
প্রকাশক:পত্রভারতী।
মূল্য:২০০ টাকা‌।
  

বৈশাখী ২০২৪