অন্ত্যজ ডোম সমাজ, কতটকুই বা জানি আমরা তাদের সম্পর্কে! অতীত কাল থেকে বৃহত্তর সমাজের এক কোণে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা এক আলাদা অচ্ছুৎ সমাজ ( যদিও এখন তাদের মধ্যে শিক্ষার কিঞ্চিৎ আলো প্রবেশ করেছে,কিন্তু সে আলো সমগ্রতাকে ছুঁতে পারেনি)। সাহিত্যিক শ্রী মণিশঙ্কর তাঁর দক্ষ সুললিত কলমে তুলে ধরেছেন রুখাশুখা রাঢ় অঞ্চলে বসবাসকারী এই ডোমদের জীবনের কথা, উৎপত্তি,বিভিন্ন উপগোষ্ঠীতে বিভাজন,তাদের সহজ সরল ধর্মীয় বিশ্বাস,তাদের জীবিকা,তাদের বন্ধনহীন জীবনে বন্ধনের কথা,তাদের শিল্প সংস্কৃতি। তিন পুরুষ ধরে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক বিবর্তনের কথা,না কোনও ঐতিহাসিক দলিল নয়,যুক্তি দিয়ে কোনো তথ্য ভিত্তিক আলোচনা নয়, তুলে ধরেছেন উপাখ্যান আকারে,যা ডোমরা বংশ পরম্পরায় বিশ্বাস করে এসেছে,সেই বিশ্বাস কে তিনি বিশ্বাস করেছেন এবং বিশ্বাসযোগ্য ভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। বৈশাখের এক গুমোট দুপুরের পর পশ্চিমে জমে ওঠা কালো মেঘকে যখন উড়িয়ে দিলো এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঠিক তখনই জন্ম হলো কালুডোমের। হত দরিদ্র ডোমদের বিভিন্ন রকম রোষানলে পুড়তে পুড়তে বাঁচতে হয়,তারা জানে এটাই তাদের ভবিতব্য, দেবতার অভিশাপ তারা মেনে নেয়,ধম্মরাজের থানে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে বিপদ উদ্ধারের প্রার্থনা জানায় আর মনে মনে ভাবে কেউ হয়তো পৃথিবীতে নেমে আসবে তাদের শাপমুক্ত করতে,যেমন একদিন এসেছিল তাদের পূর্বপুরুষ কালুবীর।এক প্রবল ঝড় বিদ্যুতের রাতে দেবতার সাথে লড়াই করে টিকিয়ে রেখেছিল নিজেদের অস্তিত্ব।ঠিক সেই রকমই এই শিশুর জন্ম হতেই যখন মেঘ কেটে গেল তখন তার বাবা, পঞ্চপ্রধান বিষাণ ঘোষণা করলো কালুবীর আবার ফিরে এসেছে তাদের রক্ষা করতে,কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে সে প্রথা ভেঙে ফেললো,ষষ্ঠীর আগেই শিশুকে বের করে আনলো জনসমক্ষে, যার খেসারৎ দিতে হলো ডোমদের,প্রলয়ে তাদের ঘরদোর তছনছ হয়ে গেল,বিষাণ সংসার হারিয়ে বিবাগী হলো,ছোট্ট কালুর আশ্রয় হলো দুধমার কাছে। কালু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে,তার উদাসী মনের আশ্রয় হয় পাতার বাঁশী।“ কালুর কাছে প্রকৃতিই ছিল সব।তার দুঃখের সাথী।তার কান্নার দোসর,তার সুরের যোগানদার।এমন কি তার ভালোলাগা মন্দলাগার ভাগীদারও”।শিল্পীর মনে যে এক তীব্র অস্থিরতা থাকে,অসুখ থাকে,এক সর্বগ্রাসী আগুন থাকে তাকে লেখক খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কালুর চরিত্রে ।তার অতৃপ্তি তাকে নিয়ে যায় পালাগানের দিকে,যা কিনা বাজুনিয়া ডোমদের নিষিদ্ধ। স্ত্রী লক্ষ্মী তাকে স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে নিঃস্বতার কুয়োতে ঝাপ দেয় । আবার প্রথা ভাঙে, আবার অমঙ্গলের ছায়া। প্রতিটি নারী চরিত্রকে অসাধারণ ভাবে সৃষ্টি করেছেন লেখক, প্রতিটি নারী অসম্ভব দৃঢ়,তেজী,স্বাধীন,এবং সময় ও সমাজের কুসংস্কারকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে। অথচ তাদের কোমল রূপটিও কেমন সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন, মরমী কলমে নারী হৃদয়ে মাতৃত্বের জন্য হাহাকার ফুটে উঠেছে। “ওরে নিঠুর বিধি একটি বাছা দে আর কিছু চাইনা বিধি মরণকালে মুখে আমার অগ্নি দেবে কে?” লক্ষ্মী যখন মনের থেকে অনেকটা দূরে,তখন জন্ম নেয় কালুর হৃদয়,বদলে যাওয়া সমাজের হৃদয়।লক্ষ্মী তার সমস্ত ক্ষোভ,সমস্ত না পাওয়া দিয়ে হৃদয়কে গড়ে তোলে কালুর প্রতিপক্ষ করে,ডোম সমাজের সমস্ত প্রথার প্রতিপক্ষ করে ।আর কালু তার মনের সমস্ত দাউদাউ নিয়ে একা থেকে আরো একা হতে থাকে। কাক যেমন পালক পড়ে ময়ূর সাজে এই গাঁ ও তেমন সভ্যতার পালক পড়ে ময়ূর সাজতে চায়, ঠিক এইভাবে সমস্ত গ্রামই আজ নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে।সবার আগে এগিয়ে আসে যুব সমাজ এবং একদল ধূর্ত লোক পয়সার লোভ,ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে,রক্তের মধ্যে যে উশৃঙ্খলতা থাকে তাকে চাগিয়ে দিয়ে, তাদের কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় মুনাফা লোটার উদ্দেশ্যে।হঠাৎ একদিন প্রবল শব্দে কেঁপে উঠলো ডোমপাড়ার ঘরের দেওয়াল। পাথর খাদান হবে, পাথর ভেঙ্গে চিপস তৈরি হবে।সব উঠতি ছেলেরা কাজ পাবে,কাঁচা পয়সা। তাদের ডোমবৃত্তি ছেড়ে ভালোভাবে বাঁচবে।ডোমসিনির দিকেও পা বাড়ায় পাথর খাদান। সভ্যতার উন্নাসিক পদক্ষেপ।কালু হাহাকার করে ওঠে “অনত্থ্য হঁইয়ে যাবেক হে!অনত্থ্য হঁইয়ে যাবেক। অতবড় পাপ যে ধম্মে সইবেক নাই রে।”ডোমসিনিকে ডোমরা ঠাকুর মনে করে,“জিয়ন্ত ঠাকুর,রাত বিরেতে পাড়ায় ঘুরে বুলে,পাহারা দেয় ডমপাড়াকে, বিপদে আপদে রইক্ষ্যা করে।” হৃদয় যেন তার ডোমজন্মের সমস্ত ক্ষোভ উগড়ে দেয়,“কী রইক্ষ্যাটা করিচে শুনি?থাইলে বছর বছর জলে ঝড়ে ক্যানে পড়ে যায় ডোমরার ঘর?ক্যানে তারার প্যাটে দুবেলা দুমুঠা ভাত থাকে নাই?ক্যানে বল?ক্যানে ছুটোলোক বলে ডোমরাকে সুবাই দুচ্ছাই করে?সোব ঠাকুর ঠাকুর করেই মল্লি ছির জেবনটা --” কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনর্থ ঘটলো,ক্রেসারে কাজ করতে গিয়ে হৃদয়ের ফুসফুসে পাথর গুঁড়ো চেপে বসে।ঢলে পড়ে মৃত্যুমুখে,উমির সাথে সংসার গড়ার সাধ অপূর্ণ থেকে যায়।বেশিরভাগ গ্রামবাসীই ভুগতে থাকে শ্বাসকষ্টে।অসহায় মধুডাক্তার,এই গল্পের কথক, যিনি বিপদে আপদে ডোম সমাজকে আগলে রাখেন। কিন্তু শোকে পাথর হয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। প্রাণ তো প্রাণই নয়, যদি তাতে সামগ্রিকতার বোধ না থাকে,এই বোধই তো পারে সব সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে জীবনকে মোহনীয় করে তুলতে, এ পৃথিবীতে সবার সব টুকু অধিকার ফিরিয়ে দিতে। কালু আবার পালা বাঁধে,উমি গায় “জনম দুখিনী আমার অ গ পিকিতি মা আমরার হাতে পালে তুমি কত যাতনা লোভ তাড়সে কেউ বুজিনা কী দুঃখু আনচি ঘরে” ।। কালু ডোমের উপাখ্যান মণিশঙ্কর লেখক মণিশঙ্কর প্রচ্ছদ মণিশঙ্কর প্রকাশক প্ল্যাটফর্ম মূল্য ৩৫০ টাকা