কেরালার স্তনকর প্রথা ও প্রতিবাদিনী নাঙ্গেলী

ভারতের বুকে জাতিগত ভেদাভেদের ব্যাপারটি সবসময়ই ছিল। অঞ্চল ভেদে সেগুলি কোথাও একটু বেশী ছিল তো কোথাও একটু কম ছিল। তবে সব জায়গাতেই বিধবা নারীদের অবস্থা প্রায় একইরকমের ছিল। যে বাংলা নবজাগরণের জায়গা ছিল, সেখানেও সতীদাহ প্রথার মতন বর্বর প্রথা ছিল।

এটা ঠিক যে সতীদাহ প্রথা অতীব বর্বর প্রথা ছিল কিন্তু তাতে সরাসরি নারীত্বের কোনো অপমান হত না। বরং যিনি সতী হতেন তাকে "দেবী"র তকমা দেওয়া হত। মনে করা হত কেবল ঐ সতী নারীর জন্য ঐ পরিবারের সবাই জীবনে যত পাপই করুক না কেন তারা স্বর্গে যাবেই যাবে।

কিন্তু ধরুন যদি দেশে এমন কোনো প্রথা চালু থাকে যার দ্বারা বহু নারী প্রতিমূহুর্তে অপমানিত ও লজ্জিত হয়? তাদের অর্ধনগ্ন হয়ে স্তনদ্বয় সবার সামনে দেখিয়ে বেড়াতে হচ্ছে? তখন কেমন লাগবে?

শুনে কেউ হয়ত প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইবে না কিন্তু এমনই অসভ্য ও বর্বর প্রথা একসময় ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কেরালাতে চালু ছিল!!! ভারতের মতন রক্ষণশীল দেশে এমন অসভ্য প্রথা কোনোকালে ছিল এটা ভাবতেও লজ্জা হয়।

বাংলায় একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে "বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ / বামনি চিনি কেমনে?"
এর মানে হল, গ্রামাঞ্চলে পুরুষেরা খালি গায়েই ঘুরে বেড়াত। তাই কার গায়ে পৈতে আছে আর কার গায়ে নেই সেটা দেখে কে ব্রাহ্মণ এবং কে ব্রাহ্মণ নয় সেটা সহজেই বোঝা যেত। কিন্তু মহিলাদের দেখে সেটা বোঝার উপায় ছিল না। এটা ঠিক যে তখনকার দিনে ব্লাউজ পরাকে 'বিলাসিতা করা' বলে মনে করা হত। কিন্তু নারীদের সারা শরীর তো বটেই মুখ পর্যন্ত ঘোমটা দিয়ে ঢাকা থাকত। সর্বপরি
তারা ব্লাউজ না পরলেও তার বিকল্প পথ তাদের জানা ছিল। কিন্তু কেরালাতে নিম্ন শ্রেণীর মহিলাদের নিজের জাতের কারণেই সবসময়ে স্তন উন্মুক্ত করে রাখার নির্দেশ ছিল! এখানে কোনো বিকল্প পথ রাখা ছিল না।

সময়টা ছিল ১৯ শতকের একেবারে প্রথমদিক। ভারতে তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্ব চলছে। বর্তমান কেরালা রাজ্যের ৯০ শতাংশ জায়গা নিয়ে ছিল তখন ছিল ত্রিভাঙ্কুর রাজ্য। সেখানেই এই অসভ্য আইন ছিল। আইনটা কার নির্দেশে কেন তৈরি করা হয়েছিল সেটা জানা নেই। কিন্তু ত্রিভাঙ্কুর রাজ্যে ব্রাহ্মণ ব্যতীত হিন্দুধর্মের অন্য কোন জাতের নারীরা নিজেদের স্তন আবৃত রাখতে পারত না। নিচু জাতির নারীদের স্তন রাখতে হত অনাবৃত এবং উন্মুক্ত, তা তিনি যে বয়সের নারীই হোন না কেন। স্তন ঢেকে রাখতে চাইলে নারীদের বা তার পরিবারকে "স্তনকর" দিতে হত! যাকে স্থানীয় ভাষায় "মূলাক্করম" বলা হত।

ব্যাপারটি শুনতে খুব অবাক লাগলেও ভারতের মতন রক্ষণশীল দেশের একটি রাজ্যে ৭০ বছর ধরে এমন জঘন্য প্রথাই চালু ছিল।

কেরালাতে তখন চারটি সম্প্রদায়ভুক্ত দুটি জাতের লোকই বসবাস করত। তারা হলেন নায়ার, নাম্বুদিরি, নাদার এবং এজাভস। এর মধ্যে নায়ার ও নাম্বুদিরি ছিল ব্রাহ্মণ সম্পদায়ভুক্ত এবং নাদার ও এভাডস ছিল নিম্ন সম্প্রদায়ভুক্ত। উঁচু জাতির পুরুষ বা মহিলার সামনে নীচু জাতির পুরুষেরা তো বটেই, মহিলারা
পর্যন্ত বুক ঢাকতে পারত না। তাদেরকে নিজেদের স্তনকে প্রকাশ্যে উন্মুক্ত করে রাখতে হত। যদি নীচু জাতির মহিলারা উঁচু জাতির পুরুষদের সামনে নিজেদের স্তন ঢেকে রাখত তবে সেটাকে উঁচু জাতির লোকেদের অপমান মানা হত। এর জন্য তাদের একটি কর দিতে হত যাকে "স্তন কর"(BREST TAX) বা "মুলাক্করম" বলা হত।

নীচু জাতির মহিলাদের কাছে দুটোই উপায় থাকতো। হয় তাদের নিজেদের স্তন সবার সামনে উন্মুক্ত করে রাখতে হত অথবা তাদের "স্তনকর" বা "মুলাক্করম" দিতে হত। তবে এই "স্তনকর" কিন্তু সবার জন্য সমান হত না। এই স্তন করের পরিমাণ নির্ভর করত স্তনের আকারের উপর। যার স্তন যত ছোট তাকে তত কম স্তনকর দিতে হত আর যার স্তন যত বড়, স্তনকে আবৃত রাখতে গেলে তাকে ততো বেশী পরিমাণ "স্তনকর" বা "মুলাক্করম" দিতে হত।

সবচেয়ে নিন্দনীয় বিষয় ছিল এই স্তনকর নির্ধারনের সময় এক পরপুরুষ প্রকাশ্যেই নিম্নবর্গের মহিলাদের স্তনে হাত দিয়ে তার মাপ নিত। অনেক সময়ই কোনো মহিলার স্বামীর সামনেই তার স্ত্রীর স্তনে হাত দিয়েই এই মাপ নেওয়া হত। নীচুজাতির লোক হওয়ার কারণেই সেই ব্যাক্তিদের স্ত্রীর অপমান মুখ বুজে সইতে হত। মাথায় রক্ত চড়ে গেলেও তাদের কিছুই করার থাকত না। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করলেই পরিবারটিকে গ্রামে একঘরে করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।

এছাড়াও কেরালার বেশ কিছু এমন মন্দির ছিল যেখানে প্রবেশ করতে গেলে পুরুষ নারী নির্বিশেষে গায়ে কাপড় রাখা চলত না। কেরালাতে পুরোহিতদের ভগবানের সমতুল্য মানা হত। তাই মানুষ যেমন ভগবানের কাছে যেতে লজ্জা বোধ করে না, তেমন পুরোহিতদের কাছেও কোনো লজ্জা করলে চলত না। মহিলারা যদি কিছু গায়ে জড়িয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করত তবে পুরোহিতদের কাছে সেই অধিকার ছিল যে, তারা সেই কাপড় টেনে অথবা ছুরি দিয়ে কেটে খুলে দিতে পারত।

১৮১৩ সালে এক বৃটিশ দেওয়ান কোলোনীল জন মুনরো ঘোষণা করেন "যদি নীচু জাতির লোকেরা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন তবে আর তাদের স্তনকে উন্মুক্ত করে রাখতে হবে না এবং মুলাক্করমও দিতে হবে না। তারা নিজেদের লজ্জা নিবারণ করতে পারবে। এই কথা ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেরালার নীচু জাতির লোকেরা দলে দলে খ্রীষ্টান হতে থাকেন। তারপর থেকে তারা সাদা রঙের একটি লম্বা পোষাক পরত। যার ফলে পুরো শরীরই তাদের ঢাকা থাকত। কেরালার জনসংখ্যার প্রায় ৩০% খ্রীষ্টান হওয়ার পিছনে এই স্তনকরের মত অসভ্য প্রথাই একমাত্র কারণ।

নাদার জাতির লোকেরা খ্রীষ্টান হয়ে গেলেও উচ্চবর্ণীয়রা তখনও তাদের গায়ে কাপড় দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রাখলো। ১৮২০ সালে খ্রীষ্ঠধর্ম গ্রহণ করা নাদার জাতির লোকেদের জন্য তৈরি করা বিদ্যালয় এবং চার্চ জ্বালিয়ে দেওয়া হল। গ্রামাঞ্চলে বহু নিম্নবর্ণের লোক খ্রীষ্টান হলেও তাদের তখনও
"মুলাক্করম" দিয়ে যেতে হচ্ছিল। অবস্থার কোনো পরিবর্তন হতে না দেখে বেশ কিছু নাদার জাতির লোক শুদ্ধি প্রথার মাধ্যমে আবারও হিন্দু ধর্মে ফেরত চলে আসেন। তবে সেই সংখ্যা ছিল বড়ই নগণ্য।

১৮২৮ সালে ত্রিভাঙ্কুর সরকার একটি বিশেষ ধরনের কাপড়ের জ্যাকেট তৈরি করে করে, ঠিক যেমনটা নায়ার জাতির মহিলারা পরে। কিন্তু ত্রিভাঙ্কুরের তৎকালীন রানি একটি নির্দেশিকা জারি করে সেই পোষাক বাতিল ঘোষণা করেন। ভাবতে খুব অবাক লাগে, একজন মহিলা হয়ে তিনি কিভাবে অন্য মহিলাদের সম্মানের কথা ভাবলেন না!

এরপরের ত্রিশ বছরও প্রায় একই রকমের গেল। কিন্তু ১৮৫৯ সালে এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় নাদার সম্প্রদায়ের মেয়ে "নাঙ্গেলী"। ৩৫ বছর বয়সী নাঙ্গেলী কৃষ্ণবর্ণের হলেও দেখতে খুবই সুন্দরী ছিল। বার বার অপমান সহ্য করতে করতে সে একদিন সিদ্ধান্ত নেয়, যাই হয়ে যাক না কেন সে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে নিজের স্তনকে আবৃত রাখবে। নাঙ্গেলীর স্বামীও তার এই সাহসী পদক্ষেপে তাকে সঙ্গ দিয়েছিল।

এরপর থেকে নাঙ্গেলী গায়ে কাপড় দিয়েই বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে থাকে। একদিন নাঙ্গেলী শুল্ক সংগ্রাহকের নজরে পড়ে। তারা নাঙ্গেলীর কাছে স্তনকর দাবী করে। নাঙ্গেলীর কাছে তখন অর্থ না থাকার কারণে শুল্কগ্রাহকেরা তার বুকের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিতে যায়। নাঙ্গেলী তখনই তার মাথার ঝুড়ি থেকে কাটারি বার করে উল্টোপাল্টা ভাবে চালাতে থাকে। শুল্ক গ্রাহকেরা ভয় পেয়ে
পিছিয়ে আসে। 

পরদিনই শুল্ক গ্রাহকেরা দলে আরো ভারী হয়ে নাঙ্গেলীর বাড়িতে এসে তাকে এবং তার স্বামীকে শাসানির সুরে বলে যায় "স্তন ঢেকে রাখলে মুলাক্করম দিতেই হবে। নাহলে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হবে।"

নাঙ্গেলীরা যথেষ্ট গরীব ছিল। তাদের সংসারই ঠিকভাবে চলত না। তাই তাদের পক্ষে স্তনকর দেওয়া সম্ভব ছিল না। এদিকে নাঙ্গেলী কোনোভাবেই তার স্তন উন্মুক্ত রাখতে রাজী নয়। প্রায়ই শুল্ক গ্রাহকেরা তার বাড়িতে স্তনকর নিতে হাজির হচ্ছিল। ক্রমাগত তার উপর স্তনকরের বোঝা বেড়েই যাচ্ছিল।

অবশেষে নাঙ্গেলী একদিন কর দিতে রাজী হল। শুল্ক সংগ্রাহকেরা স্তনকর নিতে এলে সে তাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে চলে যায়। প্রথমে সে নিজের আরাধ্য দেবতাকে পুজো করে। তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের দুটি স্তন কেটে একটি কলাপাতায় শুল্ক সংগ্রাহকদের হাতে শুল্কস্বরূপ তুলে দেয় তার রক্তমাখা দুটো স্তন।

এমন ঘটনায় শুল্ক গ্রাহকেরা অবাক হয়ে যায়। নাঙ্গেলী যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে, "এই জিনিসটার জন্যই তো কর গুনতে হত!! নিয়ে যান এই দুটুকরো মাংস। এটা না থাকলে আর কোনো করও দিতে হবে না।"

একটি নিচু জাতের মেয়েকে এতটা সাহসী পদক্ষেপ নিতে দেখে শুল্কগ্রাহকেরা সবাই ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনায় প্রতিবেশীরাও সবাই বিস্মিত হয়ে যায়। এদিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে নাঙ্গেলী আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

নাঙ্গেলীর স্বামী নাঙ্গেলীকে খুবই ভালোবাসত। শ্মশানে যখন নাঙ্গেলীর চিতা দাউদাউ করে জ্বলছিল তখন হঠাৎ সেই জলন্ত চিতায় নাঙ্গেলীর স্বামী প্রবেশ করে এবং স্ত্রীর সাথে সহমরনে যায়। ভারতের ইতিহাসে সেটাই ছিল স্ত্রীর জ্বলন্ত চিতার মধ্যে প্রবেশ করে সহমরণে যাওয়া কোনো পুরুষের প্রথম এবং শেষ ঘটনা।

ইতিহাসে এই "পুরুষ সতী"-র নাম সেভাবে উচ্চারিতই হয় না। কিন্তু যে প্রতিবাদের আগুন নাঙ্গেলী জ্বালিয়ে দিয়েছিল সেই প্রতিবাদ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। নাঙ্গেলীর মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর পুরো ত্রিভাঙ্কুর রাজ্য জুড়ে উচ্চবর্ণীয় ও নিম্নবর্ণীয়দের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ বেধে যায়। নিম্নবর্ণীয়রা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে "আমাদের বাড়ির মহিলারা নিজেদের স্তন ঢেকে রাখবে এবং তার জন্য কোনোরকমের স্তনকরও দেবে না।"

সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করলে ত্রিভাঙ্কুরের রাজপরিবারই স্তনকরকে "অবৈধ" ঘোষণা করে বাতিল করতে বাধ্য হন। নিজের অজান্তেই মেয়েটি ১৮৫৯ সালে ভারতে এক বিরাট জাতি দাঙ্গার বীজ বপন করে যায়। কেরালা তো বটেই, পুরো দক্ষিণ ভারত জুড়ে অঙ্গে কাপড় রাখার দাবিতে নিম্নবর্ণের মানুষরা যে দাঙ্গা করেছিল তা ইতিহাসে "কাপড় দাঙ্গা" নামে বিখ্যাত।

মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। অথচ নিজের জীবনের বিনিময়ে পুরো কেরালার নারীদের আব্রু রক্ষা করেছিলো বীরাঙ্গনা নাঙ্গেলী এবং অবশ্যই ভারতের একমাত্র পুরুষ সতী নাঙ্গেলীর স্বামী।  

3 Responses

  1. তপশ্রী পাল says:

    লেখাটা পড়ে শিউরে উঠলাম। ভালো লাগলো।

  2. Dibban Guha says:

    Excellent writing. You’ve beautiful unfolded a dirty past veiled in time today. Bravo my child. God bless you.

  3. Payel says:

    নাঙ্গেলি আর স্তনকর ..দুটো বিষয়ই জানতাম.. কিন্তু

    ‘পুরুষ সতী দানা ছিল না…সত্যি শিউরে ওঠার মত..

বৈশাখী ২০২৪