গল্প ৪৯ – তৃষ্ণা বসাক

পাঠক একটা লাইন থেকে, এক একটা প্যারাগ্রাফ থেকে চাইলেই নতুন একটা গল্পের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেন
গল্প ৪৯ হাতে পাবার পর লেখিকাকে বলেছিলাম, আমি বিশ্বাস করি প্রিয় লেখক হয় না।প্রিয় কিছু গল্প হয় মাত্র।আশা করি আপনার এই গল্প সংকলন পড়ার পর আমি আমার মতে স্থির থাকতে পারব। 
হ্যাঁ, স্থির আছি।কিন্তু প্রিয় গল্পের তালিকায় এই বইয়ের কয়েকটা গল্প অবশ্যই যোগ করতে হয়েছে।কারণ গল্পগুলোই আমাকে তা করতে বাধ্য করেছে। তৃষ্ণা বসাকের কলমের জোর এতটাই যে আমি তাদের সাদরে গ্রহণ না করে থাকতে পারিনি।
প্রথমেই বলি, গল্প ৪৯ একটা আদ্যপান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক গল্পের বই।এই বইয়ের গল্পগুলোকে যদি ভাঙ্গা হয় তবে দুরকম বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এক, কিছু গল্প কোনও নির্দিষ্ট কাহিনী তৈরী করছে না, বা করতে চাইছে না এবং দুই, গল্পের এক একটা লাইন, এক একটা প্যারাগ্রাফ একটা গল্পের মধ্যে অনেকগুলো গল্প তৈরী করছে।প্যারাবোলা তৈরী করছে। এটা আমার বেশ মজাদার লেগেছে।পাঠক একটা লাইন থেকে, এক একটা প্যারাগ্রাফ থেকে চাইলেই নতুন একটা গল্পের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেন।এটা সব লেখক তৈরী করতে পারেন না। খুব দুঁদে লেখক যেমন পাঠকের সঙ্গে গল্পের মধ্যে কবাডি খেলা জারি রাখতে চান,লেখিকাও তেমনি পাঠকের সঙ্গে একটা অদৃশ্য খেলার মাঠ বিস্তার করেছেন এক একটা গল্পে।পড়তে পড়তে পাঠক হয়তো ভাবছেন,লেখিকাকে তিনি ছুঁয়ে ফেললেন প্রায়।পরের দান শুধু তাঁরই।ঠিক তখনই, খেলার চাল বদলে নিচ্ছেন লেখিকা।পাঠককে কাত করে বদলে ফেলছেন স্কোরবোর্ড। 
আর একটা বিষয় খেয়াল করার মতো।এই বইয়ের কিছু কিছু গল্প বিকেলের মতো শান্ত।তাড়াহুড়ো নেই।ঢিমেতালে যেন একটা ছাদে উঠছে কিছুক্ষণ একটু জিরিয়ে নেবে বলে।কিন্তু পাঠককে নিয়ে সে আসলে পৌঁছে যাচ্ছে ঝিলের ধারে।যার গভীরতায় পাঠক স্নান করতে বাধ্য।
এই পথ, এই জার্নিটাকেও মাঝে মধ্যে লেখিকা ভরিয়ে দিচ্ছেন হিউমারে।পর্যবেক্ষণের নানা রঙ্গে।উদাহরণ দেওয়া যাক।বাছা যাক ‘তবু’ গল্পটাকে।‘তবু’ গল্পটা এক মহিলা অফিসযাত্রীর।যিনি ছুটছেন ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাবেন বলে।অফিসে বায়োমেট্রিক আছে।এক মিনিটের লেট মানে লেটই।তিনটে লেট হলে একটা ছুটি কাটা যায়।বায়োমেট্রিক মেশিন জ্যাম, মেট্রোর সুইসাইড কিছুই বোঝে না।   
“…তাকে তো বলা যায় না, যতীন দাস পার্কে ভিড়ের চাপে মেট্রোর দরজা বন্ধই হচ্ছিল না, ওখানেই তিনমিনিট দেরি হয়ে গেল।কিংবা হরিশ মুখার্জি ক্রশিং-এ সিগিন্যাল পড়ে গেল, সে আর খোলেই না, কাঠফাটা রোদে পুড়তে পুড়তে শুনতে হল, “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে..” 
আজকেও সেরকম একটা দিন।মেট্রো ঠিকঠাক এলেও হরিশ মুখার্জি ক্রশিং-এ অদৃজা ঝাড়টা খেয়ে গেল।সিগন্যাল লাল হয়ে আছে তো আছেই।কানের কাছে তখন বাজছিল ‘বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে’...এই একটা গল্পের মধ্যে শব্দের,বোধের এই খেলা-এটাকে বেশ কিছু গল্পে খুব নিপুণতার সঙ্গে বুনেছেন লেখিকা।  
আসলে ‘তবু’ গল্পটা হল এক পৃথুলা মহিলার রোজনামচা।মোটা হওয়া নিয়ে যার দু;খ অবচেতনে খচখচ করে।একদিন অফিস যাত্রার আসা যাওয়ার পথে মেট্রোর এক যাত্রী যখন তার মোটা ভুঁড়ি দেখে জিজ্জেস করেন, হবু বাচ্চাটা ক মাসের, তখনই তার মাথায় বাজ পড়ে। সে জিম শুরু করে।ভুঁড়ি কমায়।কিছুটা রোগা হয়।কিন্তু তারপর,অনাগত সেই বাচ্চার জন্য তার মন বিমর্ষ হয়ে ওঠে।এতদিন স্ফিত পেটে যে মিথ্যে স্বপ্নটাকে সে বাঁচিয়ে রেখেছিল,লালন করেছিল, জিমে বাড়তি মেদ ঝরাতে গিয়ে সেই স্বপ্নটাকে কখন হারিয়ে ফেলে সে।
এরকম আর্বান হলোনেস বারবার ফিরে আসে তার বিভিন্ন গল্পে।যেটা সে করতে চাইছিল,করতে চায়,করার পর,আগের অবস্থার জন্য তার অফশোষ তাকে সম্পূর্ণ হতে দেয় না।আসলে কী চেয়েছিল সে,কোথায় যেতে হবে সেটাই যেন বারবার ফিরে আসে বিভিন্ন চরিত্রের ভেতরে।এই হলোনেস আসলে এক একটা গর্ত।একটা মায়া কিংবা কষ্ট।যাতে বারবার আঙ্গুল বোলাচ্ছেন লেখক এবং পাঠকও।
এবার একটা অন্য প্যাটার্ন বলি।ধরা যাক ‘আদর’ গল্পটাকে।দূরপাল্লার ট্রেনে করে ফেরার পথে এক যাত্রী আবিষ্কার করে, যে দক্ষিণী পর্ণস্টারকে সে পর্দায় দেখেছে,সেই পর্ণস্টারই বসে আছে কামড়ায় একটু দূরে।এই গল্পটায় পাঠক অধীর আগ্রহে কল্পনা করে একটা নাটকীর সমাপ্তির।কিন্তু গল্পটা যখন শেষ হয়,তখন পাঠকের হাতে একটা শিউলি ফুল ছাড়া আর কিছুই থাকে না।গল্পের চরিত্রগুলো মিলিয়ে যায় সাধারণ ভিড়ে।এই যে নাটকীয় শুরুয়াৎ দিয়ে শিশির সমাপ্তি এটাও লেখিকার গল্প লেখার আর একটা বৈশিষ্ট্য।নির্মাণ নৈপুণ্য।যা বারবার মুন্সিয়ানার সঙ্গে বপন করেছেন তিনি।কোথাও মনে হয়নি এ রান্নায় নুন বেশী হয়ে গেল বা হলুদ।প্রতিবার সঠিক মাপে রান্নাকে এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য যে বোধটুকু দরকার তা সুন্দরভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন লেকিকা এই বইয়ের বিভিন্ন গল্পে।
আর একটা বিষয় নজর কাড়ার মতো।এত ভিন্নভিন্ন বিষয় লেখিকা নির্বাচন করেছেন গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে,সেগুলো কখনো এত সাধারণ-যাদের ভেতর থেকে এক একটা তুখোড় গল্প নির্মাণ করেছেন লেখিকা,আবার কখনো এত আলাদা সাবজেক্ট লাইন-যেগুলো সাবজেক্ট হিসেবেই অন্য মাত্রার-সেসব বিষয়বস্তু নিয়েও বেশ কয়েকটা গভীর গল্প লিখেছেন লেখিকা।যেমন ধরা যাক, ‘পানিবাই’ গল্পটা।গল্পটা শুরু হচ্ছে একটা গন্তব্যে যাবার দুটো বাসস্টপেজ,দুটো রাস্তার বর্ণণা দিয়ে। একটা বাস স্টপেজে নামলে কিছুটা পেছনে ফিরতে হবে।আর একটা বাস স্টপেজে নামলে কিছুটা আগে হাঁটতে হবে।ঠিক জীবনের মতো।এখানেই গল্পের মূল সলতেটা পাকান লেখিকা যদিও গল্পটা কিন্তু তৃতীয় আর আর একটা পথ নিয়ে। মহারাষ্ট্রের তীব্র জলসংকটকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা এ গল্পে কিভাবে এক নীচুজাতের মেয়ের জীবন প্রবাহিত হয় তাই এই গল্পের উপজীব্য। চালচুলোহীন এক নীচুজাতের বাঙালি মেয়ের বিয়ে হয় শুধুমাত্র জল বয়ে আনার জন্য।সেখানে পুরুষ একাধিক বিয়ে করে শুধু দূরদুরান্ত কলসি করে জল বয়ে আনার জন্যই।কিন্তু গল্পটি শুধু জলের গল্প হয়ে থাকে না।তা হয়ে ওঠে তৃষ্ণার গল্প।শরীরের ,মনের এখনকি জীবনের।জীবন যেন এমন একটা গন্তব্যে যেখানে ঠিকঠাক বাস দাঁড়ায় না।সেখানে যাবার দুটো বাসস্টপেজ।হয় একটু এগতে হবে অথবা একটু পিছতে হবে।এই হিসাব মেলাতে মেলাতেই পাঠক দেখেন, তৃতীয় আর একটা পথ হয়তো ছিল,কিন্তু সে পথে আর আর যাওয়া হয় না।এই না যাওয়া পথ নিয়েই লিখেছেন লেখিকা।যে পথে গেলে হয়তো দেখা যেত “লকলকে ধানক্ষেতের পাশে একটা বাড়ি উঠছে।তার দরজায় পাল্লা নেই ,শুধু ফ্রেম।একজোটা চড়ুইপাখি মহানন্দে যাতায়াত করছে সেই ফাঁক দিয়ে।”(গল্প-দরজা)
বইটা শুরু হয়েছে ‘ব্ল্যাক হোল’ নামের এক গল্প দিয়ে।এক দাদা ও এক মানসিক ভারসাম্য হারানো এক বোনের সম্পর্ক নিয়ে এই গল্প।গল্পে একটা বর্তমান আছে আর একটা শিউড়ে ওঠা অতীত।কিন্তু কোনও ভবিষ্যৎ নেই।বইটার শেষ গল্প ‘সবুজ রান্নাঘর’।যে গল্পে একটা মডিউলার কিচেন বানানোকে ঘিরে সেজে ওঠে এক উন্মুক্ত ভবিষ্যৎ।  
কতগুলি গল্প বেশ জোরালো।‘কুমারসম্ভব’ তার মধ্যে একটা।এই গল্প বলার ধরণে একটা ক্রমাগত হিন্দোল লক্ষ করা যায়।আবার ‘গন্ধ’ গল্পে লেখিকা প্রমাণ করেন তিনি কতটা শক্তিশালী। ভাল লাগে ‘অন্তিম স্টেশন’, ‘স্মৃতি পুরস্কার’, ‘টকিং মালতি’ , ‘দরজা’ ‘মহাপ্লাবন’ প্রভৃতি গল্পগুলোও।তবে সবচেয়ে ভাল লাগে গল্পগুলোর ফর্ম।নির্মাণ কৌশল। 
প্রকাশক কৃতির একটা ছিমছাম প্রকাশনা এই বই।সুন্দর বোর্ড বাঁধাই।প্রচ্ছদ অতু্লনীয়।তবে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ আছে।এই বইয়ের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও বিন্যাস করেছেন দেবাশিস সাউ।তাঁকে আলাদা করে একটা ধন্যবাদ জানাতে হয়।গোটা প্রচ্ছদ জুড়ে তিনি সাজিয়েছেন অনেকগুলো ফাঁকা কলসি।যা তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।হয়তো মেঘের দিকে।হয়তো বৃষ্টির দিকে। আসলে ফাঁকা কলসিগুলোই আপামর পাঠক।অপেক্ষা করছে।অপেক্ষা করছে...মেঘ ভর্তি গল্পের জন্য।সত্যিই, এমন গল্পের জন্যই তো অপেক্ষা করে থাকেন পাঠক।পরবর্তী গল্পের বইতে এই বইয়ের মতো, আবার তাঁদের পরিপূর্ণ করবেন লেখিকা।এই আশায় রইলাম। 


গল্প ৪৯।তৃষ্ণা বসাক।
কৃতি পাবলিকেশন।
প্রথম প্রকাশ। বইমেলা ২০১৯
প্রচ্ছদ দেবাশিস সাউ।


  

বৈশাখী ২০২৪