বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনের মূল কথা হল চতুরার্য সত্য। বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি এই চারটি সত্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। দুঃখকেই প্রথম ও প্রধান সত্য বলে ধরা হয়েছে। দুঃখের কারণ হল দ্বিতীয় সত্য। দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব, এটি হল তৃতীয় সত্য। চতুর্থ সত্য দুঃখনিবৃত্তির উপায় অষ্টাঙ্গিক মার্গ অবলম্বন। অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলঃ সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক সত্য, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি। বুদ্ধ যে সময় তাঁর ধর্মমত প্রচার করেছিলেন, তখন সমাজে তীব্র জাতিগত বিভাজন ছিল। আমরা বিভিন্ন বৌদ্ধ আখ্যান থেকে জানতে পারি সেই ভয়াবহ জাতি বিদ্বেষের কথা। এমনকী এজন্য যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল। যুদ্ধের কারণ ছিল মহারাজ প্রসেনজিতকে শাক্য বংশীয়রা গোপনে ক্ষত্রিয় কন্যা বলে দাসী কন্যা বিবাহের জন্য দান করেন। এর ফলে ঘোর যুদ্ধ হয় এবং শত শত শাক্যদের প্রাণ যায় ও কপিলাবস্তু নগর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তখন বুদ্ধ জীবিত এবং ধর্মপ্রচার রত ছিলেন, তবুও এই যুদ্ধ তিনি চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারেননি। বুদ্ধ সমাজ থেকে জাতিভেদ প্রথা তুলে দিতে বলেননি। তবে তিনি প্রচার করতেন জাতি দ্বারা নয়, গুণ দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিচার হয়। তিনি বলেছেন দুঃখ মুক্তি বা নির্বাণ লাভে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার। সৃষ্টিকর্তা, শাশ্বত আত্মা, কর্মফল এইসব বিশ্বাস ত্যাগ করে শুদ্ধ চিত্তে চেষ্টা করলে সকলের পক্ষেই নির্বাণ লাভ সম্ভব। দুঃখমুক্তির উদ্যম করলেই তা থেকে মুক্তি সম্ভব। মানষের ভেতর অসীম শক্তি আছে, এই বিশ্বাস, আশা ও ভরসা তাঁর আগে আর কেউ এমন করে দেননি। বুদ্ধ আত্মার অস্তিত্ব আছে কি নেই তার উত্তরে হ্যাঁ বা না বলেননি। তিনি বলেছেন, আত্মা আছে কি নেই, জগৎ অনন্ত কিনা কিংবা মৃত্যুর পরেও মুক্তপুরুষের অস্তিত্ব থাকে কিনা এইসব জানা মুক্তি লাভের জন্য নিষ্প্রয়োজন, তিনি তাই এইসব প্রশ্নের বিষয়ে নীরব থেকেছেন। এখন দেখে নেওয়া যাক বুদ্ধের আগে ভারতবর্ষে ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা, মুক্তি সম্পর্কিত ভাবনা, পাপ পুণ্য বা আত্মা সম্পর্কে বুদ্ধের পূর্ববর্তী ধর্মপ্রচারকেরা তাঁদের মতবাদে কে কে কী কী বলেছেন। সেখান থেকে বুদ্ধের দর্শন বা ধর্মীয় ভাবনার স্বরূপ আমরা নির্ণয় করতে পারব। বুদ্ধ তাঁর পূর্বজদের মতামতের থেকে প্রয়োজনীয় অংশটুকু গ্রহন এবং অপ্রয়োজনীয় অংশ বর্জন করে একটি উদার, যুক্তিগ্রাহ্য ও সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদ প্রচলন করেছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক তাতেই সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছিল। মানুষ চিরকালই গল্প শুনতে ভালবাসেন, বুদ্ধ তাঁর ধর্মমত গল্পকথার মাধ্যমে তুলে ধরতেন বলে সাধারণ মানুষ সহজেই তাঁর ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বুদ্ধের আগে ও তাঁর সমসাময়িক কয়েকজন ধর্মপ্রচারক বা দার্শনিকদের নাম পাওয়া যায় দীর্ঘ নিকায়ের শ্রামণ্যফল সূত্রে। এটিই হল সবথেকে প্রাচীনতম ও নির্ভরযোগ্য মূলগ্রন্থ, যেখানে বুদ্ধের বলা কথাগুলি বা দীর্ঘ সুত্তগুলিকে একত্রিত করা হয়েছে। শ্রামণ্যফল সূত্রে (পালি সামঞ্ঞ ফল সুত্ত) আমরা প্রথম তদানীন্তন সমাজের ধর্মপ্রচারকদের নাম পাই। মোট ছয়জনের নাম সেখানে পাই। এই সূত্রের ঘটনাটি হল রাজা অজাতশত্রু মগধের সিংহাসনে বসেছেন। এই সিংহাসন তিনি দখল করেছেন তাঁর পিতা বিম্বিসারকে হত্যা করে। নানা কারণে অজাতশত্রু সিংহাসন লাভের বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকে এই পাপ কাজটি করেছিলেন। বিম্বিসারকে তিনি বন্দী করে কারাগারে অনাহারে রেখে হত্যা করেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পরেই তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। বলা হয়, বুদ্ধের বিরোধী দেবদত্তের প্রোচনায় তিনি পিতাকে হত্যা করেন। প্রাথমিকভাবে বুদ্ধ বিরোধিতা করলেও অজাতশত্রু বুদ্ধের শরণলাভের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষত দেবদত্তের মৃত্যুর পর থেকে। তাঁর বুদ্ধের অলৌকিক আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পর্কে তখন নানা কারণে বিশ্বাস স্থাপিত হয়েছিল। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। তবে তিনি বুদ্ধের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। অজাতশত্রুর রাজপরিষদের রাজবৈদ্য জীবক ছিলেন বুদ্ধের উপাসক। বুদ্ধ জীবকের আম্রকাননে তাঁর সাড়ে বারোশো শিষ্যদের নিয়ে যখন অবস্থান করছিলেন, সেই সময় কার্তিক মাসের এক পূর্ণিমার রাতে যাকে পালি সাহিত্যে বলা হয়েছে কৌমিদী রাত্রি, সেই রাতে রাজপুরীর ছাদে তাঁর পাত্র মিত্রদের নিয়ে বসে অজাতশত্রু বলেন, “এমন অপূর্ব সুন্দর জ্যোৎস্না রাতে আমি এমন কারো কাছে যেতে চাই, যিনি আমার মনে শান্তি এনে দিতে পারবেন। তাঁর পার্ষদেরা তখন নানা তীর্থিয়দের নাম বলছেন। তখনই আমরা ছজন আচার্যের নাম পাচ্ছি। অজাতশত্রু কিন্তু নিজের মুখে বুদ্ধের নাম বলেননি। কারণ তাঁর আগেই অনেক তিক্ত ঘটনা ঘটে গেছে। এমনকী কয়েকবার বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টার পেছনেও যে অজাতশত্রুর হাত আছে, তা-ও সবার জানা আছে। তিনি তখন সুকৌশলে বলছেন, “সবাই নানা জনের নাম বলছে, তবে জীবক এখনও পর্যন্ত কিছু বলেনি। জীবক কি এ বিষয়ে আমাকে কোনো দিশা দেখাতে পারবে?” অজাতশত্রু জানতেন জীবক বুদ্ধের উপাসক, অর্থাৎ বুদ্ধের গৃহী শিষ্য। তিনি কখনোই বুদ্ধ ছাড়া অপর কারো নাম বলবেন না। জীবক তখন অজাতশত্রুকে বুদ্ধের কথা বলছেন। সেই মুহূর্তেই অজাতশত্রু বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হলেন। তখন পাঁচশো স্ত্রী হাতি আনা হল। তাতে রাজা ও তাঁর অনুচরী ও প্রমীলা বাহিনীরা প্রত্যেকে উঠলেন, এবং সকলে তখন জীবকের আম্রকাননের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। হাতিগুলির আগে আগে পথ দেখিয়ে চলেছে মশালধারী পদাতিক বাহিনী এবং সবার মাঝখানে জীবক ও রাজা অজাতশত্রু চলেছেন। এরপর রাজার সঙ্গে বুদ্ধের বহু কথোপকথন হয়। সেখানে আমরা অজাতশত্রুর কথার মাধ্যমে তদানিন্তন সমাজের আচার্যদের দর্শন ও ধর্মীয় মতামত সম্পর্কে জানতে পারি। এবং অজাতশত্রু বুদ্ধের কথায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে নিজের পূর্বকৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বুদ্ধ তাঁকে ক্ষমা করেন এবং অজাতশত্রু বুদ্ধের উপাসক হয়ে, বুদ্ধের, ধর্মের ও সংঘের শরণ নেন। এই সুত্তটি ছাড়া মজ্জিম নিকায়, অঙ্গুত্তর নিকায় ও প্রাচীন জৈন ধর্মগ্রন্থাদিতেও এইসব ভিন্ন মতাবলম্বীদের নাম পাওয়া যায়। সেই সময় তাঁরা সকলেই তখন বহু শিষ্যদের আচার্য হিসেবে সমাজে বেশ বিখ্যাত ছিলেন এবং সকলেই মগধ কিংবা কোশলরাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। কারণ তখন সমৃদ্ধশালী মগধ ও কোশল, চম্পা বাৎস্য ইত্যাদি ছিল জ্ঞানচর্চা ও সাধনার প্রাণকেন্দ্র। বুদ্ধের আগমন ও তাঁর ধর্মপ্রচারের ফলে এইসব আচার্যদের প্রতি জনগণ ক্রমশ আগ্রহ হারাচ্ছিলেন। বুদ্ধ দুটি রাজ্যেরই রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। ফলতঃ এই আচার্যরা তাঁদের লাভ সৎকার হারিয়েছিলেন। তখন সমাজে মোট ছয়জন নতুন ধর্মাবলম্বী বা তিত্থিয়রা ছিলেন। তাঁরা হলেন: পুরাণ কাশ্যপ মক্খলি গোশাল অজিত কেশকম্বলী পকুধ কচ্চায়ন সঞ্জয় বেলত্থিপুত্র নিগন্থ নাথপুত্ত ১) পুরাণ কাশ্যপ – এক ব্রাহ্মণ পরিবারের দাসীর সন্তান ছিলেন পূরণ কাশ্যপ। তাঁর পিতা বা প্রভু তাঁকে দ্বার রক্ষীর কাজ দেন। চোর একবার তাঁর পরনের কাপড় চুরি করে নিয়ে গেলে, তাঁর পিতা তাঁকে আর পরনে কাপড় দেননি। মনের দুঃখে তিনি গৃহত্যাগ করেন। বনের ভেতর দিয়ে বহদূরে গিয়ে একটি গ্রামে আশ্রয় নেন তিনি। গ্রামবাসীরা তাঁকে পরনের বস্ত্র দিতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সমস্ত পাপ জয় করেছি। পাপ থেকেই লজ্জার উৎপত্তি। আমার বস্ত্রের দরকার নেই। এরপর গ্রামবাসীরা তাঁর পুজো করতে শুরু করেন। তাঁর পাঁচশো প্রধান শিষ্য ছিল। শ্রাবস্তী নগরে থাকতেন তিনি। পূরণ কাশ্যপ বলতেন, শুভকর্ম অর্থাৎ দান, ত্যাগ, শীলপালন এবং অশুভকর্ম যেমন প্রাণীহত্যা, মিথ্যাচার, চুরি, অপবিত্রতা ইত্যাদির ফলে কোনো পুণ্য বা পাপ হয় না। তাঁর মতবাদকে বলা হয় অক্রিয়াবাদ এবং তাঁর সমর্থকদের বলা হয় অক্রিয়াবাদী। ডঃ বেণীমাধব বড়ুয়া এই মতবাদকে ব্যাখ্য়া করেছেন Passivity of Soul হিসেবে। অর্থাৎ জীবের আত্মার উপর পাপ বা পুণ্যের কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ আত্মা নিরপেক্ষ ও অপরিবর্তনীয়। পূরণ কাশ্যপ জৈন তীর্থঙ্কর শীলাঙ্কের মতবাদ অনুযায়ী সাংখ্য এই তত্ত্বের উপর জোর দিয়েছেন। প্রতিটি কার্য নিয়তি দ্বারা পূর্ব নির্ধারিত, কোনো প্রাণী বা শুভ বা অশুভ কোনো উদ্যম দ্বারাই এর পরিবর্তন করতে পারে না। বৌদ্ধ শাস্ত্রে অক্রিয়াবাদীদের সমালোচনা করা হয়েছে। কারণ এই দর্শনে সমর্থনকারীরা শুভ কর্মেও অনাসক্ত হয়ে উঠতে পারেন। ২) মক্খলি গোশাল – একটি গোশালায় দাসীর গর্ভে ইনি জন্ম লাভ করেন বলে তাঁর নাম হয় গোশাল। ইনি দাস হিসেবে মনিবের গৃহে থাকার সময় একবার ঘি নিয়ে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে যাচ্ছিলেন। এই সময় তাঁর পদস্খলন হওয়ায় ঘি মাটিতে পড়ে যায়। তাঁর প্রভু রেগে গিয়ে তাঁর বস্ত্র কেড়ে নেন। বিবস্ত্র অবস্থায় বনে পালিয়ে যান এবং পরে একটি গ্রামে আশ্রয় নেন। তাঁর বহু অনুগামী ছিল। ইনি আজীবক সম্প্রদায়ের আচার্য ছিলেন। ইনি প্রথম জীবনে জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের অনুসারী ছিলেন। পরে তিনি নিজে তাঁর স্বাধীন মতবাদ প্রচার করেন। তিনি বলেন, প্রতিটি জীবকে বাধ্যতামূলক অসংখ্য জন্ম নিতে হবে। এভাবে সে ততদিন মুক্ত হতে পারবে না, যতদিন না তার আত্মশুদ্ধি ঘটছে। প্রাণীর এই জন্মান্তরে পরিভ্রমণকে তিনি একটি সুতোর মাকুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুতোর শেষ অর্থাৎ পূনর্জন্মেরও শেষ অর্থাৎ বিমুক্তি। এই দর্শনের উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এতে পাপ ও পুণ্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকী অতীত কর্মের কোনো প্রভাবও জন্মান্তরে থাকে না। মজ্ঝিম নিকায়ে এই মতবাদকে অহেতূকা ও অক্রিয়াদৃষ্টি বলা হয়েছে। অঙ্গুত্তর নিকায়ে বলা হয়েছে এই মতবাদ সৎ প্রচেষ্টার পরিপন্থী। ডঃ বড়ুয়া বলেছেন, সম্ভবত গোশাল বোঝাতে চেয়েছেন যে, বিভিন্ন স্তরের জন্মান্তর আছে এবং তা অনির্দিষ্ট ও অসীম। গোশালের মতে পৃথিবীতে ছয় প্রকার মানুষ আছেন। তাঁরা বিভিন্ন প্রকার গুণের বিশিষ্টতায় বিভিন্ন। বুদ্ধঘোষ বলেছেন, এই মতে বীর্য বা চেষ্টার কোনো ভূমিকা নেই। মক্খলি গোশাল ও তাঁর অনুসারীরা সকলেই ভিক্ষাজীবী ছিলেন। গাছের ছালের উপর তাঁরা নানা ভয়ানক অত্যাচারের চিত্র এঁকে জন্মান্তরে পাপের ফল গৃহস্থদের বোঝাতেন। যাতে গৃহীরা পাপকাজে ব্রতী না হয়, এবং দান ও পুণ্য কাজ করেন তাই তাঁরা প্রতিটি গৃহে ঢুকে সেই দীর্ঘ ও নানা চিত্র সম্বলিত গাছের ছালটি খুলে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেন। গৃহস্থ ভিক্ষা দিলে ছালটি গুটিয়ে নিয়ে বিদায় নিতেন। পরবর্তীকালে গোটানো কাগজের উপর দেবদেবীর চিত্র আঁকার যে পদ্ধতি সমাজে প্রচলিত হয়, বলা হয় তা মক্খলি গোশালের পদ্ধতির পরিবর্তীত রূপ। ৩) অজিত কেশকম্বলী – ইনিও পূর্বজীবনে একজন দাস ছিলেন এবং প্রভুর আদেশ ও গালি সহ্য করতে না পেরে সন্ন্যাসধর্ম অবলম্বন করেন। তিনি নিজের মাথা সর্বদা মুণ্ডন করতেন এবং নিজের মাথার চুল দিয়ে বস্ত্র নির্মাণ করে, তা পরতেন। তাঁর মতে একটি লতা ছেদন করা এবং একটি প্রাণীবধ দুটিই একরকম এবং সমান পাপ। প্রাণীবধ করা ও প্রাণীকে খাওয়াও সমান অপরাধ। ইনি বস্তুবাদী ছিলেন। তাঁর মতে প্রতিটি জীব চারটি মহাভূতের সমষ্টি। যেমন পৃথিবী, জল, অগ্নি, এবং আকাশ বা শূন্য। মৃত্যুর পরে মায়িক শরীর বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এই চারটি মহাভূতে ফিরে যায়। জীবের মন বা তার Organ of Sense আকাশ তত্ত্বে গিয়ে মিশে যায়। জীবের পূনর্জন্ম নতুনরূপে পৃথিবীতে আসা এই মতবাদ সমর্থন করে না। সুতরাং পুণ্যফল বা পাপকর্মের কোনো প্রভাব নেই। ডঃ বড়ুয়া বলেছেন অজিতের মতাদর্শে আত্মা বা Soul এর কোনো পৃথক অস্তিত্ব নেই। দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মা আকাশ তত্ত্বে গিয়ে মেশে। মজ্ঝিম নিকায়ে অজিতের মতবাদের সমালোচনা করা হয়েছে, কারণ এখানে অসত্য ও অসৎ কাজকে সমর্থন করা হয়েছে, এবং জীবকে অনন্ত ভোগসুখে নিমজ্জিত হতে বলা হয়েছে। ডঃ বড়ুয়া এই সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, অজিতের দর্শনে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর জীবের আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। সুতরাং যত পুণ্যকর্ম জীবন থাকতেই পালন করা শ্রেয়। এটাই অজিতের নীতিগতবোধ। অজিতের এই মতবাদ ভারতের প্রাচীন বৃহষ্পত্য লোকায়ত দর্শনের অনুসারী। এই দর্শনটি পরে চার্বাকের মতবাদ হিসেবে জনপ্রিয় হয়। নিকায়ে এই মতবাদকে উচ্ছেদবাদ বলা হয়েছে। যেখানে মৃত্যুর পর জীবের সম্পূর্ণ বিনাশের কথা বলা হয়েছে। (Annihilation after death) ৪) পকুধ কচ্চায়ন – ইনি ব্রাহ্মণবংশে এক দরিদ্র বিধবার গর্ভে জন্মগ্রহন করেন। বলা হয়, তিনি ককুধ বৃক্ষের (অর্থাৎ অর্জুন গাছ) তলায় জন্মান। তাই তাঁকে বলা হয় ককুধ বা পকুধ কচ্চায়ন। কেউ কেউ বলেন তাঁর পিঠে একটি ককুধ বা কুঁজ ছিল বলে তিনি ককুধ নামে পরিচিত হন। অভাবের তাড়নায় ইনি সন্ন্যাস নেন। পরবর্তীকালে তাঁর অনেক শিষ্য হয়। ইনি এবং তাঁর অনুসারীগণ মনে করতেন শীতল জলে বহু কীট থাকে। তাই এরা সবাই উষ্ণ জল পান করতেন। নদী বা জলধারা পেরিয়ে যেতে হলে তাঁরা খুব দুঃখিত হতেন, কারণ নদীতে নামলে, নদীর শীতল জলে থাকা অসংখ্য কীট তাঁদের পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা যাবে বলে তারা মনে করতেন। ইনি বলতেন জীব হল সাতটি বস্তুর সমষ্টি। পৃথিবী, জল, বাতাস, আগুন, সুখ, দুঃখ এবং জীব বা আত্মা। এই তত্ত্বগুলির সৃষ্টি বা বিনাশ ঘটানো যায় না। তাই যে কোনো কাজ, ভাল বা মন্দ সবই হল আপেক্ষিক। তাই তরবারি দিয়ে কোনো প্রাণীর হত্যার অর্থ হল কিছু বস্তুর মধ্যে তরবারি স্থাপন। এই মতবাদকে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে অক্রিয়াবাদ এবং শাশ্বতবাদ বলা হয়েছে। অক্রিয়াবাদ কারণ, কোনো কাজের কোনো প্রভাব নেই এবং শাশ্বতবাদ কারণ এলিমেন্ট বা বস্তুর কোনো পরিবর্তন হয় না। এই মতবাদ সমালোচিত হয়েছে, কারণ এতে মানুষের নৈতিক পতন হবে। পাপকর্মের কোনো কুপ্রভাব নেই এ কথাই এই মতবাদ সমর্থন করে। ৫) সঞ্জয় বেলত্থিপুত্র – ইনি বেলাস্থি নামক দাসীর গর্ভে জন্মান। তাঁর মাথায় সঞ্জ ফুলের মত একটি মাংসপিণ্ড থাকায় তিনি সঞ্জয় নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বলতেন, এই জন্মে যারা যেভাবে বিদ্যমান আছে, পরজন্মে তারা ঠিক সেভাবেই জন্মাবে। দ্বিপদ, চতুষ্পদ, বহুপদ প্রাণিগণ পরজন্মে অবিকল স্বীয় অবয়ব লাভ করবে। তাঁকে অজ্ঞেয়বাদী বলা হয়েছে। কারণ ইনি নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের উত্তর দিতেন না। বা অনেকসময় উত্তর দিতে অস্বীকার করতেন। যেমন, জীবের মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থান কী? সুকর্ম ও পাপ কর্মের ফল কি শুভ বা অশুভ হয়? তথাগত মৃত্যুর পরেও জগতে বর্তমান থাকবেন কি? এইসব প্রশ্নের তিনি কোনো উত্তর দিতে চাননি। এইজন্য বৌদ্ধরা তাঁর সমালোচনা করেন। তাঁকে তাঁরা বলেন অমরবিক্ষেপিকা। তবে তাঁকে অক্রিয়াবাদী বলা হয়নি। সারীপুত্র ও মৌদ্গলায়ন আগে তাঁর শিষ্য ছিলেন। ৬) নির্গ্রন্থ বা নিগন্থ নাথপুত্র – ইনি পোশাক পরতেন না। তাই গ্রন্থিহীন বা নির্গ্রন্থ নামে পরিচিত হন। নাথপুত্র অর্থাৎ জ্ঞাতপুত্র। অর্থাৎ যিনি সর্বজ্ঞ বা সব জানেন। পালিতে জ্ঞ কে ঞ উচ্চারণ করা হয়। ঞাত পুত্র থেকে নাথপুত্র কথাটি এসেছে। ইনি জৈন ধর্মমত প্রচার করেছেন। এর আগে আরও তেইশজন আচার্য ছিলেন। জৈন ধর্মে নয়টি বস্তুর উপস্থিতি মানা হয়। যেমন জীব, অজীব, পুণ্য, পাপ, আস্রব, সম্বর, বন্ধ, নির্জর, এবং মোক্ষ। জীব অর্থাৎ চেতন প্রাণ এবং অজীব অর্থাৎ অচেতন পদার্থ জীব তার কার্য সম্পাদন করে অজীবের সহায়তায়। যেমন আত্মা বা মন শরীরের মাধ্যমে তার কার্য সম্পাদন করে। এই কার্যের ফলে যে “কর্ম” সম্পাদিত হয় তাতে দেহীর পাপ বা পুণ্যফল সঞ্চিত হয়। কর্মের ফল জীবের উদ্দেশ্যে প্রবাহিত হয়, যাকে বলে আস্রব। আবার যখন মন বুদ্ধি ও চেতনা এমনভাবে কাজ করে যখন আস্রবের প্রভাব আর থাকে না, তখন হয় সম্বর। আস্রব ক্ষয় করে কর্মের অন্তে বা বন্ধ এ পৌঁছায় জীব। এবং ক্রমে তার মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটে। নাথপুত্রের অনুগামীদের পরিব্রাজক বলা হত। তারা বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করতেন। মহিলা পরিব্রাজকেরাও এই মতাদর্শ পালন করতেন। তারা নিজেদের চুল মাথার উপর উঁচু করে বাঁধতেন বা মলিবদ্ধ রাখতেন। তাই তাদের বলা হত মলিবদ্ধ পরিব্রাজক। নারী বলে তাদের পৃথক করে দেখা হত না, বরং তাদের পরিব্রাজিকার পরিবর্তে পরিব্রাজক বলা হত। এই ছজন ধর্মপ্রচারকদের একসঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে তীর্থিয়। এবং তাঁদের অনুসারীদের তীর্থিক বলা হত। এই ছজনেরই বহু শিষ্য ও শিষ্যা বর্তমান ছিল। পরবর্তী কালে বুদ্ধ ধর্মপ্রচার করা শুরু করলে এক কুলপ্লাবী বন্যার মত বৌদ্ধ ধর্ম সর্বত্রগামী হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং এই তীর্থিয়দের গতিবিধি সীমিত হয়ে পড়ে।