আলোকবর্তিকা

কলকাতা-৭০০০০৮

  
"কিরে হ'লো তোর মেয়ের?" কমলা মাসির কর্কশস্বরে কেঁপে উঠলো মালা। তার মেয়ের পনেরো বছর বয়স হল। যৌনপল্লীর নিয়ম অনুযায়ী আজ তার অভিষেক- এই ব্যবসার হাতেখড়ি। মালা অনেক চেষ্টা করেছিল তার মেয়ে তারাকে এই পাঁক থেকে বের করবার। কিন্তু পনেরো বছর বয়স হতেই মাসি আর কোনো অজুহাতই শুনল না। সুন্দরী তারার জন্য বেশ শাঁসালো পার্টি হাতে আসতেই তার হাতে তুলে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ সেই বাবু কিছুক্ষণের  জন্য তারাকে নিয়ে যাবেন অন্যখানে -এই কড়ারে অনেক বেশি টাকা দিয়েছেন মাসিকে। ক্রন্দনরত তারাকে হাজির করা হ'ল তাঁর সামনে। মাঝবয়সি মানুষটি তাকে নিয়ে গিয়ে উঠলেন একটি বিশাল গাড়িতে। গাড়ি চলল এগিয়ে,বেশ কিছুটা দূর গিয়ে তা থামলো একটি দু'তলা বাগান ঘেরা বাড়ির সামনে। তারাকে নিয়ে ঢুকলেন সেই বাড়িতে। তাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে বাবুটি ভেতরে চলে গেলেন।
বিরাট সেই ঘরে বসে ভয়ে কাঁপতে লাগল তারা। কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকলেন বাবু। বললেন-"ও মেয়ে এদিকে তাকাও দেখি।" 
তাঁর গলায় কি যেন একটা ছিল-যা তারাকে তাঁর দিকে তাকাতে বাধ্য করল। তখন উনি বললেন-"সামনের দেওয়ালে ঐ ছবিটি দেখছ?" তারা তাকিয়ে দেখল -তারই বয়সী একটি মেয়ের ফটো দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে। উনি বললেন-"আজ ওর কথাই তোমাকে বলব।"
তারার সামনের সোফাটিতে বসলেন তিনি। বলতে শুরু করলেন-"আমার ঐ একটি সন্তান-শাল্মলী। বড়ো ছটফটে উজ্জ্বল একটি তারার মত। পড়াশুনো,নাচ সবেতেই তার খুব উৎসাহ। ইস্কুলের গাড়ি করে ইস্কুলে যেত,আর সামনের পাড়ার নাচের ইস্কুলে একাই যেত। সেই হল কাল ।একদিন নাচের ক্লাসে গিয়ে আর ফিরল না।অনেক খোঁজ করে জানা গেলো কখন সবার অলক্ষ্যে বেপাড়ার একটি ছেলের সাথে তার ভাব হয়েছিল। সুযোগ বুঝে ঐদিন পালিয়েছে। মা মরা মেয়ে- হয়তো আমার ওকে বড়ো করার ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি রয়ে গেছিল। দুশ্চিন্তায় তো আমি পাগল হয়ে গেলাম। পয়সার তো আমার অভাব নেই, বুঝতেই পারছ। বিভিন্ন জায়গায় তার খোঁজ করে সন্ধান পেলাম ঠিকই, কিন্তু ততোক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। যাকে বিশ্বাস করে সে ঘর ছেড়েছিল,সে তাকে নিয়ে গিয়ে তোলে এক পতিতাপল্লীতে। না না, মা আমার কারুর কাছে বিকিয়ে যায়নি, তার আগেই সে আত্মহত্যা করেছিল।" বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে এল। সামনের জাগ থেকে জল খেয়ে তিনি আবার শুরু করলেন-"অনেক ভেবে আমি ঠিক করলাম যে-পতিতাপল্লীতে গিয়ে ঐ বয়সী একটি মেয়েকে আমি তুলে এনে তার দায়িত্ব নেব-এই ভাবেই আমার মেয়েটাকে ফিরে পাব। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে তারপর তোমার সন্ধান পেলাম। তোমায় আমি লেখাপড়া শেখাব, কেউ টের পাবেনা।" এই বলে ভদ্রলোক তারাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে একজন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। তাঁকে  ভদ্রলোক বললেন-"ম্যাডাম,আপনাকে তো সব বলা আছে-এই হচ্ছে আপনার ছাত্রী। আমার কাজ শুধু আপনার কাছে একে এনে দেওয়া, তৈরি করার দায়িত্ব আপনার।"এতোক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে থাকা তারা একটু ধাতস্থ হয়ে ভদ্রলোককে প্রণাম করে বলল-"আমার জন্মদাতা বাবা কে তা আমি জানিনা-আপনি আজ আমার বাবার রূপ ধরে এসেছেন। আপনার স্বপ্ন সফল করাটাই এখন আমার লড়াই।" 
বেশ কয়েকবছর পর-আজ তাদের বড়ো আনন্দের দিন। লেখাপড়া শেষ করে তারা তার বাবার গড়ে তোলা 'শাল্মলী বিদ্যানিকেতন'এর দিদিমণি। এই বিদ্যানিকেতনে শিক্ষা পাবে যৌনপল্লীর ছেলেমেয়েরা। তারা হয়ে উঠবে তাদের আলোকবর্তিকা।এই শুভ কর্মের মধ্যে দিয়েই একসূত্রে বাঁধা হয়ে গেল আদরের দুলালি শাল্মলী আর পতিতাপল্লীর তারা।

1 Response

  1. পাপিয়া says:

    বেশ

বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত