কর্তামা

হালিসহর, উত্তর চব্বিশ পরগণা

বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। বুলবুলি পা চালিয়ে হাঁটছে।
নমিতাদি আজ আগে চলে যাবে।
কর্তামা বাড়িতে একা।
মেঘলা দিন, বিকেল না গড়াতেই সন্ধে।
বুড়ো মানুষ যদি ভয়টয় পান! অবশ্য কর্তামার মত সাহসী মানুষ দুটি হয়না।
ছেলেরা কত সেধেছে তাদের সাথে বিদেশে থাকবার জন্য। কর্তামা কিছুতেই রাজী হন না।
বলেন, দেশের মাটিতে তাঁর শিকড় গাঁথা আছে।
অত বড় বাড়ি! বিরাট বিরাট জানলা দরজা, কড়ি বরগা, থামে, দেওয়ালে সব কিসের যেন মূর্তি! কত রঙীন কাঁচ, সব নাকি ইতালি না কোন দেশ থেকে আনা! বুলবুলিকে যেদিন মেসো প্রথম দিয়ে গেল, তার চোখে ধাঁধা লেগে গেছিল!
বুলবুলি যেন অথৈ সাগরে এসে পড়েছিল। 
অথচ কর্তাবাবা চলে যাবার পরেই সব ওলোটপালট।
চাকরবাকর আস্তে আস্তে সব কমে গেল। এখন বাড়িতে সে, নমিতাদি আর কর্তামা। দাদারা বিদেশবিভূঁইয়ে চাকরিবাকরি নিয়ে থিতু। ছোড়দাদাবাবুর বিয়ে হল। বড়দা বিয়ে করেননি। কেন, সেকথা বুলবুলির জানতে ইচ্ছে হলেও কর্তামাকে জিজ্ঞেস করতে ভয় করে।
যতই ভালোবাসুক কর্তামা, আসলে বুলবুলি কাজের লোক বৈ তো কিছু নয়। 
বুলবুলি সেই কাকভোরে আসে, সব কাজ সেরে দুপুরে বাড়ি ফিরে মেসোকে দুটি রেঁধে দিয়ে সন্ধেবেলা ফেরে। কর্তামাকে রাতপাহারা দিতে। তবে আজকাল সন্ধেবেলা আসাটা তার এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সন্টাদের দলটা গলির মুখটায় বসে গজল্লা করে। মদগাঁজা খায়। তাকে দেখতে পেলেই বিরক্ত করে! কতদিন পিছু পিছু আসে। একদিন তো হাত ধরে টানাটানি! কর্তামা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, বুলবুলি দেখেছে সেদিন, কর্তামার দাপট!
সন্টা কেন্নোর মত গুটিয়ে পালিয়ে গিয়েছি
আজকে সন্টারা কেউ নেই। রোয়াকটা বিলকুল ফাঁকা!
বুলবুলি একটু অবাক হলো। এমনটাতো কোনদিন হয় না। যাক গে যাক! আপদগুলোকে না দেখতে হলেই শান্তি।
কড়কড় করে কোথায় যেন বাজ পড়লো একটা। চোখ ধাঁধিয়ে গেল বুলবুলির।
ইস, একটু আগে আসতে পারলে কত ভাল হতো!
মেঘলা পেয়ে চোখটা লেগে গেছিল! 
নমিতাদি কী ভাববে কে জানে! মানুষের মন তো! ভাবতেই পারে, বুলবুলি ইচ্ছে করে দেরি  করল!
নিজের ওপরে রাগ হচ্ছে তার এখন।
বাড়ির উঁচু গেটটা হাট করে খোলা! সদর অবধি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে।
নমিতাদি কি বেরিয়ে গেল? সে না আসতেই!
বুলবুলি ভিতরে ঢুকে গেটটা আটকে দিল।
"বিষ্টিবাদলার দিন, কি হয় বলা তো যায়না!"
বাড়িটা থমথম করছে।
"একি, সদর দরজাটাও যে খোলা!"
ভিতর থেকে খুব আস্তে টিভির আওয়াজ আসছে।
বুলবুলি ঢুকে ছাতাটা একপাশে মেলে দরজা বন্ধ করে হাঁক দিল, "কর্তামা! কর্তামা!"
"নাহ, কোন সাড়াশব্দ নেই, গেলেন কোথায় কর্তামা?"
পেঁচানো সিড়ি বেয়ে বুলবুলি ওপরে উঠছে।
টিভির আওয়াজটা এখন জোরে। কর্তামা বোধহয় টিভি দেখছেন!
পর্দাটা হাওয়ায় দুলছে। বুলবুলি ভিতরে ঢুকলো।
না, কর্তামা’র চেয়ারটা ফাঁকা!
হাতলে ঠেকা দেওয়া সোনার মুখ বাঁধানো লাঠিটা।
হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে যেন!
বিছানাটা তেমন টানটান করেই পাতা। সকালে সে সাদা ফুলতোলা চাদরটা পেতেছিল। 
কর্তামা কি দুপুরে বিশ্রাম নেননি আজ?
ঝুলবারান্দার পর্দাটা একটু সরানো। বুলবুলি ছুটে গেল।
ফাঁকা।
শুধু একটা পোড়া বিড়ির গন্ধ নাকে ঝাপটা মারল।
সন্টা! সে কি করে এখানে আসবে?
কোথায়? কেউ তো কোথাও নেই!
বুলবুলির ভয় করছে এবার!
ফাঁকা সিঁড়ি, বৈঠকখানা, এমনকি বাথরুমেও কর্তামা নেই!
"কর্তামা? কর্তামা! কোথায় আপনি?"
উত্তর নেই। 
চট করে বুলবুলি ছাদটা ঘুরে এল। সেখানেও কেউ নেই।
বৃষ্টির দাপট বাড়ছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া।
বুলবুলি দিশেহারা। খুব কান্না পাচ্ছে তার।
দ্রুতপায়ে সদর দরজার দিকে এগোল।দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করল কে?
প্রচন্ড ভয়ে বুলবুলি চিৎকার করে উঠলো,
"কর্তামা!"
দপ্ করে সব আলো নিভে গেল।
পিছনে যেন কার পায়ের শব্দ। 
সেই আওয়াজ ছাপিয়ে
দূর থেকে একটা লাঠির ঠুকঠুক শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে...

বৈশাখী ২০২৪