বাতাসী

রাজডাঙা, কলকাতা


বাতাসী
তপশ্রী পাল
রাজডাঙ্গা, কলকাতা

[দরজার বেলের আওয়াজ]
গিন্নি – ক্যা অ্যা অ্যা অ্যা? একে বলে সারাদিন কাজের পরে এই একটু জিরেন দিচ্ছি, তার মধ্যে আবার বেল! উঃ জ্বালাতন হয়ে গেলুম!
[দরজা খুলে]
তুমি ক্যা! এই ভর সন্ধেবেলা! বলি, অতো বড় ঘোমটা টেনে রেখেছো কেন?
বাতাসী – আঁমিঁ বাঁতাঁসীঁ গঁ! তুঁমিঁ কাঁজেঁরঁ লোঁকঁ খুঁজঁতেঁছিঁলেঁ তাঁইঁ এঁনুঁ – তা আমরা গাঁ ঘরের মানুষ তো, ঘোমটা টেনে থাকি। আর একন তো এই ঘোমটাই মাক্সের কাজ করে গো!
গিন্নি – হুম, এই লকডাউনের ক মাস তো কাউকে ঢুকতে দিইনি! বাসন মেজে মেজে হাতে হাজা ধরে গেছে! ঘর ঝাঁটমোছা করে করে কোমর সোজা করতে পারি না। রান্না করে করে হাত হলুদ! এমন খাটনি বাপু জীবনে খাটিনি! এখন লোক খুজছি খুব! কিন্তু ট্রেনও চলছে না, কেউ আসতেও পারছে না। তা তুমি করবে? গলাখান তো একেবারে ভাঙ্গা কাঁসি! 
বাতাসী – কঁরঁবোঁ বঁলেঁইঁ তোঁ এঁলুঁমঁ!
গিন্নি – তা কতো নেবে? কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁটপোছ? দেখছো তো – এই তিন ঘরের ফ্ল্যাট! আর লোক তো সাকুল্যে আমি আর কত্তা! ছেলেমেয়ে সব বাইরে!
বাতাসী – তাঁ তিঁনঁহাঁজাঁরঁ দেঁবেঁনঁ
গিন্নি – অ্যাঁ! বলো কি! বাপের জম্মে শুনিনি এতো রেট! না না বাপু চাইনে!
বাতাসী – কাঁজেঁরঁ লোঁকঁ বঁলেঁ কিঁ মানুষ নই? এঁকঁ এঁকঁ কাঁজঁ একঁ একঁ হাঁজাঁরঁ! কাঁজঁটাঁ কেঁমঁনঁ কঁরিঁ সেঁটাঁ দেঁখুঁনঁ আগে!
গিন্নি (মনে মনে) – তাও তো এই বাজারে একটা জুটেছে! রেখেইনি এইবেলা! খেটে খেটে হাড়মাস কালি! তারপর ট্রেন চালু হলে না হয় দেখেশুনে রাখা যাবে এখন! (জোরে) হুম, তা কোথা থেকে আসা হয়?
বাতাসী – লঁক্ষ্মীঁকাঁন্তঁপুঁরঁ!
গিন্নি – সে কি! ট্রেন তো বন্ধ! আসো কী করে! 
বাতাসী – হি হি হি হি হি হি! আমি বাঁতাঁসীঁ – বাঁতাঁসেঁ ভঁরঁ দিঁয়েঁইঁ চলে আসি! মঁজাঁ কঁচ্চিঁ – বাশ আছে – এটো আছে –ও আসার ইচ্ছে থাকলে ঠিক আসা যায়!   
 গিন্নি – বেশ, এসো কাল থেকে –
[ব্রেক মিউসিক]
[বেলের আওয়াজ]
গিন্নি – এতো সকালে আবার কে এলো! উঃ সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে! নাঃ আর পারা যায় না!
[দরজা খুলে]
গিন্নি – ও তুমি! তা এতো সকালে!
বাতাসী – (নাকি সুরে) কতো বাড়ি কাজ করি বলো তো! সকাল সকাল না এলে হয়?
গিন্নি – অ! তা আমার এখানে বাপু একটু পরের দিকে এলেই ভালো! যাকগে এখন লেগে পড়ো কাজে! (মনে মনে) এতোদিন কৌটো বাটাগুলো পড়েই ছিলো! সব নামিয়ে দিয়েছি! বাসনের রাশি নামিয়ে দিয়েছি! বুঝবে বাছাধন! 
বাতাসী – (নাকিস্বরে) – রান্নাঘর কোনদিকে? দেখিয়ে দাও! আর কাপড়চোপড় সব ভিজিয়ে রেখেছো তো? (ঘড়ি দেখে) আমি বাপু ঠিক আধ ঘন্টার বেশী সময় দিতে পারবোনি! 
গিন্নি – বলো কি! তিন হাজার টাকা নেবে! আধ ঘন্টায়! 
বাতাসী – তোমার কাজ হলেই তো হলো! আমি কি এখেনে ঘুমোতে এয়েছি?
[খানিক পরে]
গিন্নি – অ মা! ঐ তো কাপড় কাচার আওয়াজ পাচ্চি! এর মধ্যে অতো বাসন মাজা হয়ে গেল! দেখি গে তো কেমন মাজলো! বাঃ ঝকঝক করছে সব! বাসনের এমন চেকনাই কতোদিন দেখিনি! যাক বাবা! কাজ ভালো! কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি – কী করে যে –
গিন্নি (হুঁহুঁ করে গান গাইতে গাইতে) – হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে- 
বাতাসী – হি হি হি হি – নাচবে নাকি? সরো দিকি ঝাঁট দি!
গিন্নি – নাও, কতোদিন ঠিক করে ঝাঁটপাট পড়ে নি, ভালো করে ধূলোগুলো বার করো দিকি! (একটু পরে) বাপরে এই সামনে ছিলো! এই পিছনে! এই ডানে! এই বাঁয়ে! ব্যাস! সব ধূলো ঝেটিয়ে বিদায়! হয়ে গেলো? কী অলুক্ষুণে কান্ড! কী করে? এতো তাড়াতাড়ি! অথচ ঘর তো পোষ্কার! কিচ্ছুটি বলার নেই! কিন্তু কেমন যেন লাগছে! বলি অ বাতাসী – তুমি ঘর ঝাঁট দিলে না নেত্য করে গেলে বাছা!
বাতাসী – এতো বাড়ি কাজ – তাড়া তো আছে না কি?
গিন্নি – ক বাড়ি কাজ করো তুমি?
বাতাসী – একুশ বাড়ি!
গিন্নি – অ্যাঁ!! উঃ মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো! ও গো শুনছো? কী বলে গো! এএএকুশশশ বাড়ি!! অরে বাবা! ও মা! কোথায় গেলো গা! অই তো বারান্দা মুছছে! ওরে বাবা! হাত চলছে না মেশিন! আশ্চর্য ! [একটু পরে] বারান্দা থেকে অতো রোদ্দুর আসছে – মেয়েটার ছায়া পড়ছে না তো! [একটু পরে] অ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাই তো আমি দাঁড়ালুম! হ্যাঁ, আমার দিব্বি ছায়া পড়ছে – ও বাবা! এ কাকে ঘরে ঢোকালুম! রাম রাম রাম রাম! রাম রাম রাম রাম! আই মেয়ে, তুমি কে বলো তো! ভূত না অপদেবতা?
বাতাসী – ইঁইঁইঁ – ভূঁত বলেই তোমার অমন বাসনের রাশ মেজে তুললুম! তিন বালতি কাপড় কেচে তুললুম! মানুষ হলে পারতো?
গিন্নি – রাম রাম রাম রাম! তা-তা-তা তু-তু-তুমি বাপু ভূত হলে কী করে! 
বাতাসী – টেঁরেঁনেঁ কাঁটাঁ পঁড়েঁ! সকালে কাজে আসবো - টেরেন ছেড়ে দিচ্ছে দেখে তাঁড়াঁহূঁড়োঁ কঁরেঁ রেঁলঁলাঁইঁনঁ দিয়ে দৌড়লুম! পিছনে আর একটা টেরেন এসে মেরে দিলে! (ফোঁপাতে ফোঁপাতে) বাড়িতে বুড়ো বাপ, অনেকগুলো ভাই বোন! বাপ টেরেনে লজেন বিক্কিরি করতো! লকডাউনে সব বন্ধ! বাড়িতে ভাইবোনগুলো খেতেঁ পাচ্ছেনি! আমি তো বাড়ির সামনের আশশ্যাওড়া গাছে বসে সবই দেখতে পাচ্ছিলুম – মরেও শান্তি নেই, মুক্তি নেই! তা ভূত হলে তো টেরেনও লাগে না, বাসও লাগে না! লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে কলকেতা বাতাসে উড়ে উড়ে দশ মিনিট! খিদেও পায় না, তেষ্টাও পায় না! আর এখন আমার হাতপা চলে ঝড়ের বেগে! হাত পৌঁছে যায় মগ ডালে! আই আই দ্যাখো – তোমার ওজন অন্তত আশি কেজি! তোমায় তুলে ফেললুম! 
গিন্নি – মরে গেলুম! মরে গেলুম! ছাড়! ছাড়! নামা নামা!  
বাতাসী – হি হি হি হি! এখন প্রাণ ভরে রোজগার করি, আর লুকিয়ে টাকাগুলো ঘরে বাপের পোটলায় রেখে আসি! কেউ আমারে দেখতেও পায় না! ভাইবোনগুলোর সঙ্গে কথা কইতে ইচ্ছে হয়, বাপের আদর খেতে ইচ্ছে হয় – কিন্তু পারি না! আজ যাআআআআই – কাল আসবো গিন্নি মা – আ আ আ আ
গিন্নি – রাম রাম রাম রাম! অগো শুনছো –
[নাটক শেষের বাজনা]

1 Response

  1. পাপিয়া says:

    দুর্দান্ত। ওহহহ কি মজার

বৈশাখী ২০২৪