অতিথি সম্পাদিকার কলমে: ভৌতিক ও অলৌকিক গল্প সম্পর্কে দু চার কথা

রাজডাঙা, কলকাতা

ভৌতিক গল্প সম্বন্ধে স্টিফেন কিং বলেছেন, “we need ghost stories because we, in fact, are the ghosts.” সত্যিই, ভূত মানে তো মানুষেরই অতীত! আবার এও বলা যায় যে মানুষের মনের মধ্যেই যত ভূতের বাস। আর সেখান থেকেই হয়তো উৎপত্তি অলৌকিক কান্ডের!

এ সম্পর্কে ঘোস্টল্যান্ডের কলিন ডিকি ভারি দামী কটি কথা বলেছেন, “We tell stories of the dead as a way of making a sense of the living. More than just simple urban legends and campfire tales, ghost stories reveal the contours of our anxieties, the nature of our collective fears and desires, the things we can’t talk about in any other way. The past we’re most afraid to speak aloud of in the bright light of day is the same past that tends to linger in the ghost stories we whisper in the dark!”

হ্যাঁ, আমাদের মনের সেই সব গভীর গোপন কথা যা আমরা দিনের আলোতে বলতে ভয় পাই, যে অতীত খুঁড়তে আমাদের বড়ো অনীহা, রাতের গভীরে ফিসফিস করে তারাই বুঝি প্রকাশ পায় ভৌতিক বা অলৌকিক হিসাবে।

তবে অবিশ্বাসীরাও আছেন বৈ কী! তাঁদের হয়ে একটি সার কথা বলে গেছেন রাজশেখর বসু মহাশয় (পরশুরাম)। তাঁর গল্পে, যেখানে এক ভূত অবিশ্বাসী গণিত শিক্ষক বলছেন “আত্মা = ০ (জিরো)। অতএব ভূত = ভগবান = √০ (রুটওভার জিরো)” অর্থাৎ সবই ইমাজিনারি!

তবে এ সব তত্ত্বকথা বাদ দিলেও যেখানেই অজানা, সেখানেই মানুষের চিরকালীন কৌতূহল আর জানার আগ্রহ! সেই অজানা জগতেই পাখা মেলে পাঠকের কল্পনা! মৃত্যুর পরের জগত আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা। তাই বুঝি ভূতকে নিয়ে এতো আগ্রহ, উৎসাহ এবং ভয়! আমরা তার রূপ কল্পনা করি, কেউ কেউ আবার দেখেও ফেলি! তাকে নিয়ে গল্প লিখি, ভয় পাই, গা ছমছম করে, তবুও সবার আগে পড়ি সে সব গল্প! হয়তো আত্মা যখন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারে না, সে বারবার ফিরে আসে। কখনো মানুষের বন্ধু হিসাবে,  কখনো অতৃপ্ত বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য অথবা কোন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। আবার কখনো এই বাস্তব জগতেই ঘটে যায় কিছু ঘটনা, হয়তো কোন এক ব্যক্তি বা সামান্য কোনো বস্তুকে ঘিরে, যাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক আখ্যা দেওয়া হয়। আপনি কারো সম্বন্ধে ভাবলেন আর তিনিও ঠিক সেই সময় আপনার সামনে উপস্থিত হলেন – যাকে বলে টেলিপ্যাথি! এ সবই সেই মন এবং পরাজগতের ধূসর ইতিবৃত্ত!

বাংলা সাহিত্যে এই ভৌতিক এবং অলৌকিক গল্পের শাখাটি প্রথম থেকেই বেশ পুষ্ট! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বড় বড় প্রায় সব সাহিত্যিকই কখনো না কখনো বিচরণ করেছেন এই শাখায়। কে ভুলতে পারে রবীন্দ্রনাথের কঙ্কাল কিংবা জীবিত ও মৃত গল্পগুলির কথা? অমর হয়ে আছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিশ্বাসী সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের সঙ্গে ভূতবিশ্বাসী বরদার তর্ক এবং গল্প! সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার গল্পে প্রায়ই মেলে প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডাকার কথা। আর মজার মোড়কে ভূতের রাজা, তার তিন বর এবং সমাজের সর্বস্তরের ভূতের নৃত্য তো বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছে সত্যজিতের “গুপি গাইন বাঘা বাইন” সিনেমায়। তাঁরই লেখা অলৌকিক গল্প “খগম” পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। বিখ্যাত হয়ে আছেন তারিণী খুড়োও তাঁর বলা গল্প নিয়ে।

ভূতেদের নিয়ে মজাও বড় কম হয়নি। উদাহরণস্বরূপ রাজশেখর বসু মহাশয়ের “ভুশুন্ডীর মাঠ” কিংবা অনতি-অতীতে “ভূতের ভবিষ্যত” সিনেমার কথা ভুললে চলবে না। পরবর্তীকালে এই ভৌতিক গল্পের শাখাকে বিশেষ পুষ্ট করেছেন অনীশ দে মহাশয়। ওঁর সম্পাদিত থান ইটের মতো মোটা “ভৌতিক অলৌকিক” সংকলনটি সব ভূতপ্রিয় বাঙ্গালী পাঠকের অবশ্যপাঠ্য।

বর্ষাকালের সঙ্গে ভূতেদের সম্পর্ক ওতোপ্রোত! আকাশে কালো মেঘ যখন ঘনিয়ে আসে! বাইরে বাতাস বয় শনশন! বৃষ্টির একটানা শব্দে মনে যেন তরঙ্গ ওঠে! সেই তরঙ্গ ইথারে ভেসে গিয়ে বুঝি সম্পর্ক স্থাপন করে পরাজগতের সঙ্গে! সেই সময় যদি তারিণী খুড়োর মতো গল্প বলার কেউ থাকেন সঙ্গে, আর থাকে মুচমুচে মুড়ির সঙ্গে গরম তেলেভাজা, তাহলে জমে যায় বর্ষার সন্ধেটা!

অতএব আড্ডা নিউ জার্সি, তাঁদের “অভিব্যক্তি” পত্রিকার বর্ষা সংখ্যায় এবার সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছেন সেই পরাজগতের কাহিনির সঙ্গে, যা শিহরণ জাগাবে পাঠকের শিরায় শিরায়! পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হবে পিছনে বুঝি কার নিঃশ্বাস পড়লো! ফিরে তাকাতেই হবে, কিন্তু তাকালে বিপদ ওঁত পেতেও থাকতে পারে!

আমার ওপর ভার পড়েছিলো জমা পড়া অজস্র গল্পের মধ্য থেকে সবচেয়ে রোমহর্ষক কয়েকটি কাহিনি বেছে নেওয়ার। সত্যিই এ এক দুরূহ কাজ। তবু সে কাজ সম্পন্ন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মূলত কয়েকটি দিকে নজর রেখে:- ১. গল্প বোনার মুন্সিয়ানা, যাতে গোগ্রাসে শেষ লাইন অবধি না পড়ে ছাড়া যাবে না; ২.গল্পের বিষয়ের নতুনত্ব, গল্পের ভাষা এবং ৩. নির্দিষ্ট শব্দসীমার মধ্যে একটি নিটোল ভৌতিক বা অলৌকিক গল্প হয়ে ওঠা। মনে রাখতে হবে ভৌতিক এবং অলৌকিক গল্পেরও একটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। ঘটনার ঘনঘটা থাকলেই কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা আসে না।
     
অজস্র ধন্যবাদ আড্ডার বন্ধুদের এমন বিষয় চয়ন এবং আমাকে তার সম্পাদনার যোগ্য মনে করার জন্য। “অভিব্যক্তি”র পাতা এবার ভরে উঠেছে চমকপ্রদ কয়েকটি ভৌতিক ও অলৌকিক গল্প দিয়ে। পাঠকের ভালো লাগলেই প্রচেষ্টা সার্থক।              

তপশ্রী পাল  

2 Responses

  1. Mousumi Mukhopadhyay says:

    অতিথি সম্পাদিকার লেখা‌টি ভারি মনগ্রাহী। তিনি গল্পের মূল্যায়ন কী কী বিষয়ে‌র উপর ভিত্তি করে করেছেন তা ও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে যা মূল্যায়নের স্বচ্ছতা রক্ষা করেছে। পরশুরাম থেকে অনীশ দেব পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ভৌতিক জার্নির উল্লেখ্য ও চমৎকার লাগল।

  2. Tapasri Pal says:

    মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ

শ্রাবণী ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত