অভিশপ্ত

বড়িশা, কলকাতা

"বীরের দেহ চিতায় যাক বা কবরে, তার আত্মার গতি স্বর্গে!" - আমার ঠিক পিছন থেকেই রাজস্থানী আর হিন্দির মিশ্রণে চাপা স্বরে বলে উঠল কেউ, "গতি নেই শুধু বিশ্বাসঘাতকের!"

চমকে উঠে পিছন ফিরতেই, দেখতে পেলাম তাকে। দীর্ঘ বিশীর্ণ দেহ, ধূলিমলিন জীর্ণ বেশ। বয়স নির্ণয় দুঃসাধ্য। অযত্নলালিত কেশে জটার আকৃতি। শ্মশ্রু-গুম্ফমণ্ডিত অক্ষৌরিত মুখে আশ্চর্য জীবন্ত শুধু কোটরাগত দু'টি চোখ। তার চেয়েও বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার গ্রীবা বেষ্টন করে থাকা বহু পুরোনো একটা ক্ষত।

সভয়ে দু'পা পিছিয়ে এলাম। এই সমাধিক্ষেত্রে এসে পাগলের পাল্লায় পড়ব, ভাবি নি। অবশ্য তার আগে বলে নেওয়া ভালো, হিন্দু রাজার কেল্লায় সমাধি দেখতে পাব, এ-ও ছিল আমার ধারণার বাইরে!

ছেলে প্রবাসী। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী সুযোগ পেলেই চলে যাই ভারতের আনাচে-কানাচে। এক বন্ধুর পরামর্শে এবারে এসেছি জয়পুর থেকে দেড়শ' কিলোমিটার দূরের এই দেউলগড়-এ। অখ্যাত, কিন্তু নিরালা আর সুন্দর জায়গা। 

দেউলগড়। না, এর ইতিহাসে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। চিরন্তন হয়ে নেই কোনো অসমসাহসী মহারাণার বীরগাথা। এটি ছিল একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য সামন্তরাজ্য। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সেই কুখ্যাত পাঠান আগ্রাসনে যখন কম্পমান সমগ্র রাজপুতানা, তখন অন্যান্য ছোটখাটো জনপদের মত এটিও যায় পাঠানের অধিকারে। যুদ্ধে পরাজয় ও মৃত্যু হয় এখানকার রাজা অজয়সিংহের - গাইড বুকে এটুকুই শুধু পড়েছি।

দেউলগড় নামের মূলে দেবালয়। অজয়সিংহের এই কেল্লা থেকে এক কিলোমিটার দূরে দেবী ভবানীর সেই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ কালই দেখেছি আমরা। কেল্লা আর মন্দির, দু'য়েরই  অবস্থান উঁচু এক পাহাড়ের উপর। এখানেই ছিল প্রাচীন দেউলগড় নগর। গাড়িতে চড়াই ভেঙে গতকাল সকালেই আমরা সেই পাহাড়ে উঠে এসেছি।

অন্য অনেক জায়গার মতই দুর্গ ও সন্নিহিত অঞ্চল অধিগ্রহণ করেছেন রাজস্থান সরকারের পর্যটন বিভাগ। প্রাচীন ভগ্নাবশেষ যতদূর সম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে তাঁরা এখানে তৈরী করেছেন বিলাসবহুল হোটেল। ঐতিহ্য আর আধুনিক স্বাচ্ছন্দ্যের মেলবন্ধন।

আপাততঃ সেই হোটেলেই আমাদের আস্তানা। আজ সামান্য জ্বর আসায় গৃহিণী ছিলেন ঘরেই। মধ্যাহ্নভোজনের পর আমি একা-একা ঘুরে দেখছিলাম আশে-পাশে। পায়ে-পায়ে চলে এসেছিলাম হোটেলের পিছন দিকটায়।

হোটেলে অতিথি আর কর্মচারী, দু'য়েরই সংখ্যা কম। এদিকটা তাই সম্পূর্ণ নির্জন। ঘুরতে-ঘুরতে পা আটকে গেল আন্দাজ একশো মিটার দূরের একটা সমতল জায়গায় এসে।

কবর! পর-পর বেশ কয়েকটা! প্রতিটি কবরের উপর কোনোকালে মুসলমানী কায়দায় রচিত হয়েছিল সমাধিবেদী। এখনও কোথাও-কোথাও রয়েছে তার চিহ্ন। আরো অবাক হলাম সেই গোরস্থানের সামনে পর্যটন দপ্তরের সাইনবোর্ড দেখে। ইংরাজিতে যা লেখা আছে, তার সারমর্ম - এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত সেনাপতি জয়মল্ল এবং তাঁর পঞ্চাশ বীর সেনানী।

তাজ্জব ব্যাপার! রাজপুত সৈন্যরা ছিল হিন্দু। চিতার বদলে তাদের দেহ সমাধিতে কেন?

সেই জনহীন মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছি, এমন সময় আমার পিছনে যেন মাটি ফুঁড়েই উঠে এল সে। সেই কিম্ভূত মূর্তি!

আমি সরে যেতে চাইলেও, সরতে দিল না আগন্তুক। জ্বলন্ত দুই চোখের দৃষ্টি আমার মুখের উপর নিবদ্ধ রেখে কয়েক পা এগিয়ে এল সে।

এই পূণ্যভূমিতে শুধু ওই পঞ্চাশ বীরই নয়, ছিল এক বিশ্বাসঘাতকও! নিজের মাতৃভূমিকে সে তুলে দিয়েছিল শত্রুর হাতে। বাবুজী কি শুনবেন সেই কাহিনী?

এতক্ষণে তার উদ্দেশ্য ধরতে পেরে মনে-মনে একটু হাসলাম। যেকোনো ট্যুরিস্ট-স্পটেই এই জাতীয় নিষ্কর্মা ভবঘুরের দেখা মেলে। কিছু কাঞ্চন-মূল্যের বিনিময়ে পর্যটককে তারা শোনাতে চায় সেখানকার গৌরবময় ইতিবৃত্ত। সে আখ্যানে ইতিহাসের থেকে কল্পনার ভাগই বেশী। তা-ও আবার অশিক্ষিত মানুষের অপরিশীলিত কল্পনা!

সেই প্রলাপ শুনতে চাই না কোনোমতেই, তাই একটু কঠোর স্বরেই তাকে বললাম, "ইনাম মিলবে না বাপু! আসতে পারো তুমি।"

ইনাম? - তার গলায় স্পষ্ট বিস্ময়ের আভাস। ইনাম তো সে পেয়ে গেছে কবেই! - গলার কাটা দাগে হাত বুলোতে-বুলোতে সে বলল - পড়ে আছে শুধু তার গল্পটা!

এবার অবাক হওয়ার পালা আমার। এমন কথা আশা করি নি। যা-ই হোক, পয়সা চায় না যখন....

"বেশ!" - হুকুম দিলাম আমি, "তাহলে শুরু করো তোমার কিসসা!"

হিন্দী ও রাজস্থানীর মিশ্রভাষার সেই বিবৃতির অনেক শব্দই আমার অচেনা, তবু মূল ভাবটি বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। সেই ভাব যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে আমার নিজের ভাষায় তুলে ধরলাম সেই আশ্চর্য আখ্যান।

...চিত্রসিংহ বিশ্বাসঘাতক? এ কথা যারা বলে, তারা কি একবার ভেবে দেখেছে তার দিকটা?

রূপ না গুণ, কিসের অভাব ছিল তার? ছিল না শুধু ভাগ্য! অজয়সিংহের থেকে সে বয়সে বড়, মাথাতেও উঁচু আধহাত! তবুও অজয় সবার নয়নের মণি, সে নয়। কেন?

কারণ অজয় রাজার ছেলে, আর সে রাজার ভাইপো!

ছোটবেলা থেকেই সে তফাতটা টের পেয়ে এসেছে হাড়ে-হাড়ে। ছেলেরা যখন একসাথে পড়তে বসে, আচার্যের ঝোঁক থাকে যেন শুধু অজয়েরই দিকে। অস্ত্রশিক্ষাতেও তাই। খেতে বসেছে তারা, সবচেয়ে ভালো পদটি চাকর-দাসী সবার আগে এনে দিল অজয়ের পাতে। 

ছেলেবেলা থেকেই তো মুখ বুজে সমস্ত কিছু সহ্য করে এসেছে চিত্রসিংহ। ভেবেছে, বড় হলে পাল্টে যাবে সব। কিন্তু পাল্টাল কই?

তরুণ অজয়ের বিয়ে হল রণথম্ভোরের এক সামন্তরাজের মেয়ে কমলাবতীর সাথে। রূপে-গুণে তার তুলনা মেলে না। আর চিত্রসিংহের ঘরণী? থাক, না বলাই ভালো তার কথা!

এরপর কালের নিয়মে অথর্ব হলেন বুড়ো রাজা সুজনসিংহ। সিংহাসনে বসল অজয়। কিন্তু চিত্রসিংহ? নামেই রাজার দাদা, আসলে সে নগণ্য পারিষদ মাত্র!

এত কিছুর পরে সে যদি একটু সুরাপান করে, তাহলেই লোকে তাকে বলবে মদ্যপ? সামান্য সুখের আশায় যদি নিজের মহলে মেয়েদের নাচগানের আসর বসায়, লোকে বলবে চরিত্রহীন?

সে বিচক্ষণ। খাওয়া-পরার অভাব নেই, তাই সুস্থ শরীরকে খামোখা ব্যস্ত করতে চায় না। শিকার-কুস্তি-তলোয়ারবাজী না-পসন্দ্ বলেই লোকে তাকে বলবে ভীরু-অলস?

শত অপমানেও সে রা কাড়ে নি। কিন্তু শেষমেষ একদিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল অজয়সিংহের স্পর্ধা!

তখন সেই ভয়ঙ্কর সময়। দিল্লীর সুলতান তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে শিকারী বাজের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রাজপুতানার উপর। রণথম্ভোর আর মেবার জয়ের পর তাঁর চোখ আশেপাশের ছোটখাটো রাজ্যগুলির দিকে।

একদিন রাজা অজয়সিংহের দরবারে দূত এসে খবর দিল, দেউলগড়ের উদ্দেশ্যে এগোচ্ছে পাঠান ফৌজ!

...."আর তাদের নেতৃত্বে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি!" - কথককে বাধা দিয়ে বললাম আমি। বিদ্রূপের লোভ সম্বরণ করতে পারি নি, কারণ ভেবেছিলাম, হিন্দী সিনেমার দৌলতে ওই একটি নামই আছে বাছাধনের গোচরে!

আলাউদ্দীন এখানে আসেন নি তো! - একটু বিস্মিত হয়েই সে বলল - দু'হাজার দুর্ধর্ষ সৈনিক নিয়ে এসেছিলেন তাঁর সেনাপতি জাফর খাঁ।

অপ্রতিভ হয়ে চুপ করলাম। আগন্তুক আবার কুড়িয়ে নিল তার ছিন্ন কাহিনীসূত্র।

...চিন্তিত অজয়সিংহ সভা ডাকলেন, উপায় জানতে চাইলেন অমাত্যদের কাছে।

চিত্রসিংহের কথা বরাবর সোজা-সাপটা। উপায় তো একটাই - বাতলে দিল সে।

দেউলগড়ের সৈন্য সাকুল্যে চারশ'। এ নিয়ে তো আর দু'হাজার পাঠানের মোকাবিলা চলে না। সুতরাং দূত-মারফত দিল্লীর সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া হোক! পাঠানো হোক উপঢৌকন। তার সাথে ওরা যদি চায় কিছু সুরা আর নারী....

অসন্তোষের গুঞ্জন উঠল সভায়। হাত তুলে সভাসদদের থামিয়ে দাদার দিকে ফিরলেন অজয়সিংহ। দুই চোখ তাঁর রোষে লাল।

বয়সে বড় না হলে এই কথার জবাব তিনি দিতেন অসির আঘাতে! এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাক চিত্রসিংহ!

অপমানিত চিত্রসিংহ চলে এল সভা ছেড়ে। দোর দিল নিজের মহলে। বাইরে বেরোলেই তো শুনতে হবে লোকের টিটকিরি!

ঠিক চারদিন পরে পাঠান সেনা এসে পৌঁছল পাহাড়ের নীচে।

অজয়সিংহ তলব করলেন সেনাপতি জয়মল্লকে। তার হাতে পঞ্চাশজন বিশ্বস্ত সৈন্য দিলেন, আর দিলেন দুর্গ রক্ষার ভার। বাকি সৈনিকদের নিয়ে যুদ্ধে চললেন রাজা স্বয়ং। চিত্রসিংহকে কেউ ডাকল না।

একটুখানি সুবিধা অজয়সিংহের ছিল।

যে রাস্তা ধরে এই পাহাড়ে উঠে এসেছেন বাবুজী, সেই পাকা সড়ক তো ছিল না তখন! একটিমাত্র পথ ছিল উপরে ওঠার। সেই গিরিপথ জায়গায়-জায়গায় খুব সঙ্কীর্ণ, পাশাপাশি দু'-তিনটে মানুষ যেতে পারে কোনোমতে। এখান থেকে প্রায় দুই ক্রোশ নামলে ওরকম একটা সরু জায়গা, তার দু'ধারে উঁচু খাড়া পাহাড়।

দু'পাশের সেই দুই পাহাড়ের মাথায় সৈন্য নিয়ে ঘাঁটি গাড়লেন অজয়সিংহ। পাঠানরা যেই সে পথে এগোতে যায়, উপর থেকে এসে পড়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে তীর আর পাথরের চাঁই।

বেশ খানিকটা ক্ষয়-ক্ষতির পর পাঠান সেনা পিছু হঠল। আহত বাঘের মত তারা অবরোধে বসল পাহাড়ের সানুদেশে।

ওদিকে চিত্রসিংহ-ও বসে নেই। তার মাথায় জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। মহলে বসে সকালের ভৈরোঁর আলাপে আর সন্ধ্যার নূপুরের রুণুঝুনুতে সে শুনতে পাচ্ছে একটিই সুর।

শোধ চাই! অপমানের শোধ চাই!

ভাবছে সে। ভাবছে অবিরাম। ভাবতে-ভাবতেই বেরোল পথ!

জাফর খাঁ-র কাছে গিয়ে বশ্যতা স্বীকার করবে সে। গোপনে পাঠান সেনাকে পাহাড়ের উপর নিয়ে এসে পতন ঘটাবে দেউলগড়ের। তারপর দিল্লীশ্বরের অধীনে সে-ই হবে রাজা!

...."কিন্তু পাঠানদের সে উপরে আনবে কোন রাস্তায়?" - মগ্ন উৎকন্ঠায় প্রশ্ন করলাম আমি, "তুমিই তো বলেছ, পাহাড়ে ওঠার ওই একটি বই পথ ছিল না!"

ছিল তো পথ! - আমার মুখে খরদৃষ্টি হেনে বলল আগন্তুক।

....পথ ছিল। ভবানী-মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে কবেকার প্রাচীন সুড়ঙ্গ নেমেছিল পাহাড়ের মাঝ-বরাবর এক গোপন গুহায়। সেই গুহা থেকে কঠিন নয় নীচে নামা। এ পথের হদিশ জানা ছিল শুধু মন্দিরের পূজারী আর জনাকয় রাজপুরুষের। চিত্রসিংহ তাদের একজন।

সন্ধ্যা পার করে মহল থেকে বেরোল সে। তখন কৃষ্ণপক্ষ। আকাশের চাঁদও যেন মুখ লুকিয়েছে তার কীর্তি দেখে।

নগরে রক্ষী নেই, সকলেই যুদ্ধে। অনায়াসেই মন্দিরে ঢুকল চিত্রসিংহ। তারপর সুড়ঙ্গপথে নীচের গুহায়। পাঠান শিবিরে গিয়ে সে যখন আত্মসমর্পণ করল, রাত তখন দুই প্রহর।

ধুরন্ধর সেনাপতি জাফর খাঁ সময় নষ্ট করলেন না। মূল বাহিনী রইল পাহাড়ের নীচেই। দু'শ বাছাই সৈন্য আর চিত্রসিংহকে নিয়ে ভোরের আগেই তিনি এসে লুকিয়ে থাকলেন সেই গোপন গুহায়।

পরদিন বেলায় দারুণ যুদ্ধে অজয়সিংহকে ব্যস্ত রাখল নীচের পাঠানরা। সেই ফাঁকে সুড়ঙ্গে পা রাখলেন জাফর খাঁ।

মন্দিরে তখন দেবীর ভোগ দিচ্ছেন বৃদ্ধ পুরোহিত। চকিত হয়ে তিনি দেখলেন, গর্ভগৃহের গুপ্তদ্বার ঠেলে ঢুকছে পাঠানরা! তাদের সাথে চিত্রসিংহকে দেখে ব্যাপার বুঝতে তাঁর এক লহমাও লাগল না।

পূজারী হলেও তিনি রাজপুত। চোখের নিমেষে ভোগের থালা ছুঁড়ে ফেলে টেনে নিলেন দেবীর খড়গ।

তাঁর প্রাণহীন দেহ পায়ে দলে নগরে ঢুকল শত্রু। সাধারণ মানুষ দিশাহারা। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কেউ-কেউ। দুর্দান্ত সৈন্যের সামনে সে বাধা উড়ে গেল ঝড়ের মুখে কুটোর মত।

জয়মল্ল কিন্তু তাদের সাহায্য করতে এগোল না। রাজ-অন্তঃপুরিকাদের প্রাণ ও মান বাঁচানো তার প্রথম কাজ। তার নির্দেশে বন্ধ হল কেল্লার সিংহদুয়ার।

খবর পেয়ে উদভ্রান্ত অজয়সিংহ বাহিনী ফেরালেন কেল্লার দিকে।

ফল হল আরো ভয়ানক। গিরিবর্ত্মের পাহারা সরে যেতেই দীন্-দীন্ রবে সবেগে উপরে উঠতে লাগল মূল সুলতানী ফৌজ।

তখন সামনে পাঠান, পিছনে পাঠান! খাঁচায় বন্দী সিংহের মতই শেষ অবধি লড়ে গেলেন বীর অজয়সিংহ। অস্ত্রের আঘাতে-আঘাতে জর্জরিত শরীর ছেড়ে একসময় বেরিয়ে গেল প্রাণটা। সমুদ্রের মধ্যে বুদ্বুদের মত পাঠান সেনার মাঝে লুপ্ত হয়ে গেল তাঁর সামান্য বাহিনী।

রাজপুত-রক্তে হোরি খেলে জাফর খাঁ এবার তাকালেন দুর্গের দিকে।

কেল্লার সিংহদুয়ার ভাঙতে শত্রুর বেশীক্ষণ লাগল না। কিন্তু কাঠ আর লোহার অবরোধ পেরিয়ে তারা পড়ল আরেক বাধার মুখে। সে বাধা রক্ত-মাংসের।

পঞ্চাশজন সৈন্য নিয়ে কেল্লার আঙিনায় দাঁড়িয়ে সেনাপতি জয়মল্ল। ভয়ের লেশ নেই কারুর চোখে-মুখে।

সে এক অসম অদ্ভুত লড়াই! রক্তের গন্ধ পাওয়া বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল পাঠান সৈন্য। চমৎকৃত জাফর খাঁ-র চোখের সামনেই তাদের হঠিয়ে দিল সেই পঞ্চাশ রাজপুত।

একবার, দু'বার, বার-বার! সাগরের ঢেউ যেমন সামান্য বালির তীরে বাধা পেয়ে ফিরে-ফিরে যায়, তেমনই সুলতানী বাহিনী হার মানল হাতে গোণা ক'জন রাজপুত যোদ্ধার সামনে।

কেল্লার পতন তারা ঠেকিয়ে রাখল প্রায় এক প্রহর। তারপর দিনের শেষ আলোটুকুও যখন ফুরিয়ে এসেছে, বিস্মিত-বিচলিত পাঠান সেনাপতি মরিয়া চেষ্টায় তাঁর দু'হাজারী ফৌজের পুরোই চালিয়ে দিলেন সেই পঞ্চাশ ক্লান্ত সৈনিকের উপর।

তখন, ভোরের একটি ফুঁয়ে যেমন নিভে যায় রাতের প্রদীপ, তেমন করেই হঠাৎ শেষ হয়ে গেল তাদের সব প্রতিরোধ। তাদের নিথর শরীর ডিঙিয়ে পাঠান সেনা ঢুকল দুর্গে।

তারপরের কাহিনী ধ্বংস, হত্যা আর অত্যাচারের।

শত নিষ্ঠুরতার মাঝেও কিন্তু জাফর খাঁ ওই পঞ্চাশ বীর সেনানীর যোগ্য সম্মান দিতে ভোলেন নি। তাঁর আদেশে ওদের দেহের অপমান করে নি কেউ। মুসলমান সেনা নিজেদের রেওয়াজ মেনে গোর দেয় ওদের।

সেই সমাধিই আজ দেখছেন বাবুজী!

....দীর্ঘ কথকতা শেষ করে নিঃশ্বাস ফেলল বক্তা।

"আর সেই চিত্রসিংহ? কি হল তার?" - ক্ষোভে প্রায় গর্জে উঠলাম আমি, "রাজা হয়ে বসল বুঝি?"

না! - ম্লান হাসি খেলে গেল তার বিষণ্ণ মুখে - বিশ্বাসঘাতকের পুরস্কার কি, জাফর খাঁ তা বিলক্ষণ জানতেন! তাই চিত্রসিংহ যায় কয়েদখানায়। ফাঁদে-পড়া ইঁদুরের মত কাটায় জীবনের শেষ ক'টা মাস। তারপর ঘাতকের তরবারির আঘাতে আলাদা হয়ে যায় তার ধড় আর মুণ্ড!

ডান হাতের পাঞ্জায় অসি-চালনার ভঙ্গী করে নিজের গ্রীবার বীভৎস ক্ষতের দিকে নির্দেশ করল সে!

খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে থেকে আমি সশব্দে হেসে উঠলাম।

গল্প ফেঁদেছে মন্দ নয়! হয়তো ইতিহাসের বিকৃত ভগ্নাংশ শুনেছে বাপ-ঠাকুর্দার মুখে। তার সাথে মিশিয়েছে স্বকপোল-কল্পনা। কাহিনীর বুননে প্রেরণা যুগিয়েছে তার নিজের গলার ওই বিদঘুটে কাটা দাগ!

ইনাম দেব না বলেছিলাম। কিন্তু এ বৃত্তান্ত অবশ্যই পুরস্কার-যোগ্য!

"একটু দাঁড়াও!" - বলে হাত দিলাম পকেটে। মানিব্যাগ বার করে তুলে নিলাম একটা নোট।

চোখ সরেছিল এক পলকের জন্য। আবার সামনে তাকাতেই হতবাক!

সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি আমি একা। যেমন সহসা এসেছিল, তেমনই চকিতে অন্তর্হিত হয়েছে সেই আশ্চর্য আগন্তুক!

কিন্তু চারিদিকে খোলা মাঠ! গেল কোথায়?

এইসময় কি কারণে সেদিকে আসছিলেন হোটেলের ম্যানেজার। আমাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি এসে কেতাদুরস্ত ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলেন, "এনি প্রবলেম, স্যার?"

প্রবলেম বলতেই ভদ্রলোক অগ্নিশর্মা!

"আপনিও পড়েছেন সেই পাগলের পাল্লায়?" 

তাঁর কাছেই জানলাম - হোটেলের পত্তন হওয়া ইস্তক জ্বালাচ্ছে ওই পাগল। হঠাৎ-হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে একলা অতিথিকে পাকড়াও করে শোনায় তার উদ্ভট কাহিনী!

স্থানীয় মানুষ ওকে চেনে বহুদিন যাবৎ। কিন্তু কবে থেকে আছে, কোথায় থাকে, কি খায় - বলতে পারে নি অতি-বৃদ্ধরাও।

নামটা অবশ্য শুনেছে কেউ-কেউ। চিত সিং।

চিত সিং! বিশ্বাসঘাতক চিত্রসিংহ! স্তব্ধ বিস্ময়ে স্থাণু হয়ে রইলাম আমি।

সেটা আমার ক্রোধের লক্ষণ ভেবে ম্যানেজার তড়িঘড়ি বললেন - কোনো চিন্তা নেই। লোকজন এনে এখনই তিনি ধরবেন ওই পাগলকে। তুলে দেবেন পুলিশের হাতে।

ওই অবস্থাতেও হাসলাম মনে-মনে। মহাকালের নিষ্করুণ মুঠিতে যে ধরা পড়ে আছে, হোটেলের সামান্য কর্মচারীর সাধ্য কি তাকে ধরে!

মুক্তি পায় নি চিত্রসিংহের অভিশপ্ত আত্মা। কোন্ বিস্মৃত অতীত থেকে নবাগত মানুষকে সে বার-বার শুনিয়ে আসছে তার কৃতঘ্নতার ক্লেদাক্ত কাহিনী। শুনিয়ে যাবে আরো কত যুগ ধরে। হয়তো এ-ই তার পাপস্খালনের পথ, এভাবেই তার মুক্তি।

কতদিনে? উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে!

1 Response

  1. Mousumi Mukhopadhyay says:

    খুব ভালো লাগল।

বৈশাখী ২০২৪