পাপিয়া গাঙ্গুলি পুনম ছোটোখাটো ফর্সা টুকটুকে একটি বিহারী মেয়ে। বাবার কাপড়ের কারবার বড়বাজারে। সেই সুত্রে কলকাতায় পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠা। সাজগোজ, কথাবার্তায় পাক্কা বাঙালি। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছে। কলকাতার বিখ্যাত ডান্সট্রুপে প্রথম সারির নাচিয়ে। সেই সূত্রে দেশ বিদেশে অনেক ঘুরেছে। হাসি খুশী প্রাণোচ্ছল মেয়ে। তবে এমন ফুলঝুরির মতো মেয়েটা এক এক সময় কোথায় যেন হারিয়ে যায় সকলের মধ্যে থেকেও। বন্ধুরা মজা করে । সেদিনও ছিল পুনমের উদাসী মন খারাপি দিন। বন্ধুরা চেপে ধরেছে। - কিরে কাঁচা প্রেম? - বাজে বকিস না । - বল না আমাদের জাম'বাবু কে হচ্ছে? - আমি বাড়ি চললাম। প্রক্সি দিয়ে দিস। - কারণ? - মেজাজটায় আজ সূর্য গ্রহন। - চল চল শকুন্তলাকে নৌকোয় তুলে আসি। সকলে মিলে পুনমকে বাসে তুলতে তার পিছু পিছু গেল। বাসস্টপের পাশে একটা ফুচকাওয়ালা বসে। পুনমের খেতে ইচ্ছা নেই তবু সকলে মিলে হাতে একটা শালপাতার বাটি ধরিয়ে দিল। ফুচকা, গল্প শেষ না হতেই বাস এসে গেল। ভিড় বাস। পুনম প্রায় অ্যারোবিক্স কায়দায় বাসের পাদানিতে ঝুলে পরলো। বাসটা দাঁড়ালো না আর স্টপেজে। চলতে শুরু করলো জোরে। পেছনের বাসকে টেক্কা দিতে। পরক্ষণেই ক্যাঁচ করে গাড়ির ব্রেক দেওয়ার আওয়াজ আর হৈহৈ রোল। বন্ধুরা পেছনে তাকিয়ে দেখলো অনেক ভীড়। পুনম যে বাসে ঝুলছিল সেটাও একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে। পৌঁছে দেখে পুনম রাস্তায় পরে আছে। রক্তে লাল... তার গা ঘেঁষে একটা নীল গাড়ি দাঁড়ানো। তড়িঘড়ি কলেজে খবর দিয়ে পুনমকে নিয়ে যাওয়া হলো সামনের সরকারী হাসপাতালে। প্রিন্সিপালও এসেছেন। পুনমের মা বাবাকে উনি ফোন করছেন। ঘন্টা খানেকের টেনশনের পর ডাক্তার এসে বললেন -ভয়ের কিছু নেই। -পুনম বেঁচে গেছে? - মাথা ফেটেছে আর হাত পা বিচ্ছিরি ভাবে কেটেকুটে গেছে শুধু । - দেখা করা যাবে? - ঘুমের মধ্যে আছে। সকলে আলোচনা করছে, পেছনের গাড়িটা ব্রেক দিয়ে না দাঁড়ালে কি হতো বলা যায়না। বাস থেকে পরে যাবার পর গাড়িটা এক হাত দূরত্বে এসে থেমেছে। পুনমের মা সমানে চোখ মুছছে। বাবা কঠিন মুখে বন্ধুদের থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নিচ্ছেন। সপ্তাহ খানেক পেরিয়েছে। পুনমের শরীর অনেক ঠিক কিন্তু মানসিক ভাবে সে বিপর্যস্ত। ভয় পাচ্ছে। ঘুমতে পারছে না। ঠিক কিসের ভয় পরিস্কার বলছে না। ডাক্তার বলেছে মনের ডাক্তার দেখাতে। কাউনসেলিং করলে পুনমের মনটা পড়া যাবে। মনের জগতের হদিস সহজে নিতে পারে জয়ীতা রায়। কলকাতার পরিচিত মনোবিজ্ঞানী। জয়ীতা আধুনিক সাজ পোশাকের এক মধ্য বয়সী মহিলা। ডাক্তার না ভেবে মডেল ভাবা যায়। কলার বোনের কাছে ট্যাটু করা। ছোটো চুল। নাকে একটা মাইক্রোস্কোপিক হীরে। প্রথম দেখাতেই পুনমের ভালো লাগলো। সুন্দর সাজানো একটি ঘর। অনেকটা লিভিংরুমের মত। জয়ীতার চেম্বার এটা। একজন মহিলা এসে হাল্কা সবুজ শরবতের গ্লাস দিলো পুনমকে আর জয়ীতাকে কফির মগ। - ব্রেকফাস্ট করছো? - হ্যাঁ - কি খেতে ভালোবাসো সকালে? - ডিম, টোস্ট জুস। - বাহ, আমারও তাই। আমরা গল্প শুরু করলে আরও অনেক মিল পাবো হয়তো। - আমরা গল্প কেন করব? -আমার চিকিৎসার পদ্ধতি বলতে পারো। - আচ্ছা। প্রথম দুদিন শুধু গল্প করলো জয়ীতা। সেশন শুরু হলো তারপর। - বাস থেকে পরে গেলে কি করে? - আমি বাসের হ্যান্ডেলটা নিজে থেকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। - কেন? - ঐ হাত দুটো... আমার হাতের ঠিক পাশে হ্যান্ডেলটা চেপে ধরলো৷ আমার হাতে ছোঁয়াও লাগলো যে! - কোন হাত দুটো? - যে দুটো হাত আমি স্বপ্নে দেখি। সেই দুটো হাত, ....উফফ - কি দেখ স্বপ্ন? - লোমশ নোংরা হাত। আমার শরীরে নোংরা মাখিয়ে দিচ্ছে... আটা মাখার মত শরীরটা পিষছে । নড়তে পারিনা। ব্যাথা.... । - কার হাত বুঝতে পারো? - লোমশ শক্ত হাত... - কোথায় দেখেছিলে এরকম লোমশ হাত? - কি জানি! - আচ্ছা পুনম এমন কোনো ঘটনা আছে যা তোমায় কষ্ট দেয়? যা তুমি কোনোদিন কাউকে বলতে পারোনি? - হমমম - আমায় বলবে? - আমি খারাপ হয়ে গেছি। - খারাপ কেন? - বলা যাবেনা। - কেঁদোনা । খুলে বলো। - খুব কষ্ট হয়। নোংরা লাগে। - আমায় বলো। আমি সব ঠিক করে দেব। - মা বাবা কাউকে বলবে না তো? - ডাক্তাররা পেশেন্টের কোনো কথা কাউকে বলেনা। - গরমের ছুটিতে পাটনা যেতাম মায়ের সাথে। ওটা আমার মামাবাড়ি। বাগানওয়ালা মস্ত বাড়ি। অনেকদিন থাকতাম।ভাইবোনদের সাথে খেলতাম। গরম তিলকুট তৈরী হতো বাড়িতে। রাতে খুব ঠান্ডা। লিট্টি চোখা খাওয়া হতো ঘি দিয়ে। সব ভাই বোনরা মিলে একসাথে খেতে বসতাম। খুব মজা হতো। অপেক্ষা থাকতো কবে পাটনা যাবো। আমি তখন ফাইভে পড়ি। সেবার গিয়ে দেখলাম একটা অচেনা ছেলে বাড়িতে। আমার থেকে অনেক বড়। স্বাভাবিক নয়। জড়ানো কথা। মুখ দিয়ে লোল গড়ায়। হাতটা একটু ব্যাঁকা। কোনো দুঃস্থ আত্মীয়। চিকিৎসা করাতে গ্রাম থেকে পাটনায় এসেছে। ছেলেটার চোখ দুটো কেমন যেন! আমার ওকে খুব নোংরা লাগতো। তাই দূরে দূরে থাকতাম। - কেন নোংরা লাগতো? - ঐ যে লোল পরতো আর হাত দিয়ে মুছতো। - আচ্ছা। তারপর.. - এক সন্ধেবেলা জোনাকির পেছন পেছন তিনতলায় চলে গেলাম । তখনও তিনতলা সম্পূর্ণ হয়নি। অন্ধকার। - চুপ করলে কেন? বলো তারপর? - জোনাকিটা হারিয়ে গেল। আমি ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ দেখলাম অন্ধকার থেকে ঐ ছেলেটা বেরিয়ে এলো। প্যান্টের চেন খোলা। ওর গোপন অঙ্গ দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো জ্বলছে। খুব ভয় পেয়েছিলাম।আসলে ভেবেছিলাম ভূত দেখছি। আমি পালাতে যেতেই ধরে ফেলল আমায়। শক্ত হাত। খুব জোর গায়ে। ছেলেটার মুখের লালা আমার মুখে লেগে যাচ্ছিলো। আমি ছাড়াবার চেষ্টা করছিলাম। আচমকা মেঝেতে ফেলে চেপে ধরে দুহাত দিয়ে পিষতে থাকলো.... আকস্মিকতায় আওয়াজ করতে ভুলে গেছিলাম । কিছুক্ষন বাদে নীচ থেকে কেউ আমায় ডাকলো। ছেড়ে দিলো তখন। কি শক্তি হাতে। - জল খাও পুনম। আজ যদি আর বলতে ইচ্ছে না করে বলো না৷ আমরা আরেকদিন বসবো। পুনম ঢকঢক করে জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করলো। যেন ওর কানে কোনো কথা ঢোকেনি। -আমি কাঁদছিলাম। ছেলেটি বলেছিলো কাউকে বললে রাতের বেলা ও আমার বিছানায় সাপ ছেড়ে দেবে। ওর নাকি পোষা সাপ আছে । ভয়ে কাউকে বলিনি কিছু। বায়না করে সেবার তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরে এসেছিলাম।ভেবেছিলাম আর কোনোদিন মামাবাড়ি যাবো না। পরে শুনেছিলাম ছেলেটা ছাদ থেকে পরে মরে গেছে। খুব আনন্দ হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো রূপকথার শয়তান রাক্ষসটা মরে গেছে। আমি বেঁচে গেছি। কিন্তু বাঁচিনি। ও আছে। কালো হাত দুটো আছে। - ছেলেটার হাতগুলো মনে আছে? তোমার স্বপ্নে দেখা হাতদুটোর মত ছিল? মনে করে বলো। - হতে পারে। আমি ওসব মনে রাখতে চাইনি। তবে ছেলেটার গায়ে অনেক লোম ছিলো ঠিকই। গায়ের রং মোষকালো ছিল। - তুমি কি ছেলেটাকে ঘেন্না করো না ভয় পাও? - জানিনা। হয়তো ভয় পাই। লোমশ হাত দেখলেই আতঙ্ক হয়! স্বপ্নেও আমায় ভয় দেখায়। একটা হাত সাপ হয়ে আমার গলাটা চেপে ধরছে। স্বপ্নটা আমি আর দেখতে চাইনা। ওষুধ দেবে? - পুনম তুমি যে ঘটনাটা আমায় বললে সেটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট । যেমন বাস থেকে পরে গিয়ে হলো। চিকিৎসা হলো। তোমার কাটাকুটি, মাথা ফাটা সব ঠিক হয়ে গেল। তোমার সাথে ঘটনাটাও সে রকম। একটা খারাপ মানুষ তোমায় কষ্ট দিয়েছিলো। এই পৃথিবীতেই সে নেই। তুমি যেমন মনে করেছিলে রাক্ষসটা মরে গেছে। রাক্ষসটা তার সাথে সব খারাপ জিনিস গুলো নিয়ে গেছে। তোমার গায়ে ওর ছোঁয়া লেগে নেই। তুমি এখন মুক্ত রাজকন্যা। সুন্দর সব কিছু ভাবো। তা এই রাজকন্যার রাজপুত্র আছে নাকি? ( একটু হাল্কা চালে জিজ্ঞেস করলো) - না নেই। একান্তে তার হাতটাও যদি লোমশ হয়ে যায়!! ভয় লাগে সম্পর্কে জড়াতে। -তুমি সেরে গেছো। তুমি ভালো আছো। এতটুকু মনে রাখো। কোনো লোমশ হাত দেখলে তুমি ভয় পাবেনা৷ সাহস করে তার মুখটাও দেখবে। তুমি বুঝতে পারবে যে লোমশ হাতের লোকটাকে তুমি ভয় পাও সে তোমার সামনের লোকটা নয়। তুমি একটা বিশেষ লোকের লোমশ হাতকে ভয় পাও। সে পৃথিবীতেই নেই। ভয়টাকে হারিয়ে দাও। তুমি পারবে। - আর স্বপ্নটা? - তুমি লোকটার কথা না মনে করে একটা রাজপুত্রর কথা ভাবো। দেখবে খারাপ স্বপ্ন আর আসছে না। এরকম সেশন কয়েকদিন চলার পর পুনম স্বাভাবিক হয়েছিল। অনেকদিন পরে জয়ীতার নামে এক ঝুড়ি ফুল এলো । সাথে একটা বিয়ের কার্ড। পুনমের বিয়ে।একটা ছোটো রঙীন কাগজে লেখা " রাজপুত্র খুঁজে পেলাম। আমেরিকা চলে যাচ্ছি। আপনি আসলে খুশী হবো। নতুন জীবন দিয়েছেন। ভালবাসা । - পুনম" । জয়ীতা খুব খুশি হলো। বিয়ের দিন জয়ীতার একটা কনফারেন্স ছিল৷ যেতে পারেনি। একগোছা ফুল পাঠিয়ে ছিলো। কয়েক বছর কেটে গেছে। পুনম সুস্থ হওয়ার পর পুনমের মা হোয়াটসঅ্যাপে জয়ীতার সাথে সৌহার্দ্য বিনিময় করত। ক্রমে জয়ীতার সাথে পুনমদের সম্পর্কটা একটু আলগা হয়ে এসেছে।সেইসময় একদিন পুনমের মায়ের একটা ফোন এলো। - জয়ীতা আমি মিসের রায় বলছি। তোমার পেশেন্ট ছিল পুনম। তার মা। - আরে মিসেস রয়, কেমন আছেন,? - আছি একরকম। - কেন একরকম কেন? ভালো নয় কেন? - জয়ীতা পুনম ভালো নেই। - সে কি! ও তো আমেরিকায় আছে। - হ্যাঁ। আমি কিছু বলবো না। তোমার সাথে ও কথা বলতে চায়। তুমি কি ভিডিও কলে সেশন করবে? - নিশ্চয়ই। ওকে আমার নম্বরটা দিয়ে যোগাযোগ করতে বলুন। - জয়ীতা,তুমি আমায় বাঁচালে। খুব উদ্বেগে দিন কাটছে। - চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। ভরসা রাখুন। ফোনটা ডিসকানেক্ট করে জয়ীতা পুনমের কথা ভাবছিলো। কি সুন্দর ফুলের মত মেয়েটা। আবার কি সমস্যা হলো। ভাবনায় ছেদ দিল মোবাইলের রিং। ইন্টারন্যাশানাল ফোন। - হ্যালো - পুনম বলছি দিদি। - কেমন আছো পুনম? - দিদি একদম ভালো নেই। তোমায় ভিডিওতে চাই। সময় থাকলে এখনই। - একটু সময় দাও। একঘন্টা পর তুমি ভিডিও কলে এসো। আমি হাতের কয়েকটা কাজ সেরে নিই। - আচ্ছা। পুনমের গলায় অস্থিরতা। জয়ীতার মনটাও ভারী হলো। ঠিক একঘন্টা কাটতে না কাটতেই পুনমের ভিডিও কল। রিসিভ করতেই দেখা গেল পুনম ভয়ার্ত মুখে বসে আছে। কোলের কাছে একটা নয় দশ বছরের মেয়ে। এক মাথা কোঁকড়া চুল। ভাসা ভাসা চোখ। একটু দিশেহারা ভাব। - ওমা এটি তোমার মেয়ে বুঝি? - হ্যাঁ। আমার মেয়ে। - কি নাম তোমার? - ওর নাম রুদ্রাণী। - মাম্মা আমায় রাণী বলে ডাকে। ( মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল) - ওমা দুটো নামই তো খুব সুন্দর। - থ্যাঙ্ক ইউ। তুমি এবার হোমওয়ার্কটা করে নাও আমি আন্টির সাথে কথা বলে, তারপর তোমায় ডাকবো। বাধ্য মেয়ের মত রাণী ভেতরে চলে গেল। - কি হয়েছে পুনম? - দিদি সেই লোকটা মরেনি। লোকটা ফিরে এসেছে। - কোন লোকটা? - দিদি পাটনার সেই লোকটা। লোমশ কালো হাত। - প্রথম কথা তুমি বলেছিলে লোকটা ছাদ থেকে পরে মরে গেছে। দ্বিতীয়ত লোকটা আমেরিকা যাবে কি করে!!! তাও আবার এতকাল বাদে। - আমি কিচ্ছু জানিনা। লোকটা এখন রাণীকে কষ্ট দেয়। -আচ্ছা শান্ত হয়ে সব বলো। - রাণী আলাদা ঘুমোয়। একদিন অনেক রাতে নিজের ঘর থেকে ছুটে আমাদের ঘরে। ভয়ে মুখটা কালো। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর । বলছে কেউ ওর ঘরে আছে। ওর মুখের ওপর দুটো চোখ দেখেছে। আর ওকে ব্যাড টাচ করেছে। নিমেষে আমার নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পরলো। ওকে জড়িয়ে নিয়ে নিজের কাছে শোয়ালাম। সান্ত্বনা দিলাম। - তারপর - পরেরদিন সকালে সব নর্মাল। কয়েকদিন আমার কাছে শোয়ালাম। ভাবলাম ও হয়তো মায়ের কাছে শোওয়ার জন্য কাঁদছে। - হ্যাঁ সেটাই হতে পারে। - বিনোদ বলল ওর ভয়টাকে প্রশ্রয় না দিতে। - হমম - সেদিন রাণী নিজের ঘরে গেল শুতে। আমার মনটা আনচান করছিল। জেগেই ছিলাম। রাত দুটোর সময় রাণীর ঘর থেকে গোঙানির আওয়াজ। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম রাণী বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। কে যেন ওকে চেপে রেখেছে বিছানার সাথে। রাণীর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ভয়ে। আমি চিৎকার করতেই উঠে বসলো আর সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল। ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার বলল শক পেয়ে হয়েছে। - তুমি বললে কেন সেই লোকটাই, তোমার ছোটোবেলায় যে তোমায় কষ্ট দিয়েছিলো? - আমি দেখেছি রাণীকে ঠিক ওরকম করেই চেপে ধরে ছিলো যেমন আমায় করেছিলো। - রাণী ভয় পাচ্ছে কোনো কারণে । কিন্তু যে লোকটা তোমার ছোটোবেলায় মরে গেছে সে কি করে হবে পুনম। তুমি রাণীর ঘটনার সাথে নিজের ছোটোবেলার ঘটনা মিলিয়ে ফেলছো। রাণীকে ঠিক মত ডাক্তার দেখাও। ও ভালো হবে । তুমি ওর সামনে আতঙ্কিত হবে না। - আমার মন বলছে সেই লোক। - আজ শেষ করি কথা। আবার কথা বলবো। - বাই কিছুদিন কোনো ফোন আসেনি। জয়ীতা ভাবলো সব ঠিক আছে । চায়ের কাপ হাতে ঠিক করলো পুমমকে একটা মেসেজ করবে। চায়ে এক চুমুক দিয়েছে পুনমের ভিডিও কল। - বলো - দিদি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। লোকটা আমার মেয়েকে মেরে ফেলবে। রাণীকে ডাকি । তোমায় একটা জিনিস দেখাবো। - দেখাও রাণী এসে মায়ের গা ঘেঁসে দাঁড়ালো। পুনম আলতো করে সামনের বোতাম খুলে বুকের কাছটা উন্মুক্ত করলো। কচি কুুঁড়ি প্রস্ফুটিত। তার পাশে দগদগে আঁচড়ের দাগ। জয়ীতা ঘটনা হাল্কা করার জন্য বলল - অ্যান্টিসেপ্টিক মলম লাগাও। রাণী চলে গেল। - এইরকম দাগ ঐ লোকটা আমার বুকে করেছিলো। ঠিক এরকম! - আমি কাল রাণীর সাথে একা কথা বলবো। - ঠিক আছে কাল এই সময়ই লগ ইন করবো। পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে পুনম লগ ইন করলো। স্ক্রিনের সামনে রাণী বসে। - রাণী তুমি গল্প করবে? - হ্যাঁ। - কি গল্প.. - ভয়ের - তুমি ভয় পাও? - হ্যাঁ - তুমি মায়ের কাছে ঘুমতে চাও? - না। আমার বন্ধুরা একা ঘুৃমোয়। রাণী বলে যাচ্ছে । গুছিয়ে, থেমে থেমে। জয়ীতা ওর কথা কিছু শুনতে আর পাচ্ছেনা। শুধু ঠোঁট নাড়া দেখছে। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। জয়ীতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ল্যাপটপের পর্দার ওপারে রাণীর ঠিক পিছনে একটা লোক দাঁড়িয়ে। লোমশ, একটা হাত ব্যাঁকা, ঠোঁটের পাশ দিয়ে লোল গড়াচ্ছে। স্হির কুটিল দৃষ্টিতে সে জয়ীতার দিকে তাকিয়ে আছে। পুনম যেমন তার ছোটোবেলায় দেখা লোকটার বর্ণনা দিয়েছিলো। এপাশে জয়ীতা হঠাৎ অনুভব করলো তার ঘাড়ের ওপর কার স্পর্শ। দুটো শক্ত হাত ক্রমশ নীচে নামছে আর মাথার ওপর জলীয় কিছু টপ টপ করে পরছে। জয়ীতা অবশ হয়ে যাচ্ছে। জয়ীতা ল্যাপটপটা বন্ধ করে সটান ঘুরে তাকালো। হুবহু সেই লোকটা!যে ল্যাপটপের মধ্যে রানীর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। লোল গড়াচ্ছে । কালো লোমশ হাত জয়ীতার গলাটা চেপে ধরেছে। মোবাইলটা বাজছে। আর কিছু মনে নেই। পরের দিন হসপিটালের বেডে তার ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে দেখলো পুনমের মা। হঠাৎ ল্যাপটপ বন্ধ আর ফোন না তোলায় পুনম নিজের বাড়িতে ফোন করে। ওরা জয়ীতাকে ফ্ল্যাট থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছে। রানী আর ভয় পায়নি জয়ীতার সাথে কথা বলার পর। কথোপকথন চলাকালীন রুমের দরজার দিকে চোখ পরতেই দেখলো সেই লোকটার অবয়ব তার দিকে কালো লোমশ হাত দুটো বাড়িয়ে শয়তানের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।