চা-তাল

কাঁচরাপাড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা

অনেকক্ষণ ধরে প্রাণটা চায়ের জন্যে আইঢাই করছে, এই সন্ধ্যে নামলেই তেষ্টাটা ভীষন জ্বালিয়ে মারে। ভূবনবাবু লম্বা পায়ে গলিটা পেরিয়ে মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ালেন। জটের চায়ের দোকানের ঝাঁপ আলগা রয়েছে দেখে এগোতে গিয়ে মনে পড়ল গিন্নির কথা,
-জটের দোকানের ঐ ঘোড়ার মুত মানুষে খায়? এত নোলা কিসের শুনি? বাড়িতে কী চা জোটে না? বেআক্কেলে বুড়ো! 

বললেই হলো ঘোড়ার ইয়ে? বেশ করে চিনি গুলে... বলতে নেই ঐ দুচামচ চিনির লোভেই গিয়ে ডাইবেটিক ভূবন জুটতেন জটার দোকানে না হলে সত্যি চায়ে একটা চামড়া পোড়া  গন্ধ পাওয়া যেত। এখন আর ওসব গন্ধ টন্ধ নিয়ে শৌখিনতা নেই। যা হোক দুঢোক হলেই হোল। জটের দোকানে ঢুকবো ঢুকবো করতে না করতেই দেখলেন অসীম চক্রবর্তী দুলে দুলে বাড়ি ফিরছে। রোজ এসময় এপাড়া সেপাড়া টহল দিয়ে বাড়ি ফেরে আর ফিরেই... অসীমগিন্নির চায়ের হাতখানিও যাকে বলে চমৎকার! আগে আগে অসীম আর তিনি এসময় বিকেলে হেঁটে ফিরতেন যখন, অসীম জোর করে কতদিন টেনে নিয়ে গেছে তার বাড়ি। আজ তাহলে অসীমের বাড়ি - ই যাওয়া যাক।! যেমন বলা তেমন কাজ ভূবনবাবু অসীমের গা ঘেঁসে হাঁটতে লাগলেন, তেকোনা পার্ক পেরিয়ে নাইন সি - তে অসীমের একতলা বাড়ি সুন্দর একফালি বাগান ও আছে। ঐ যাকে কিচেন গার্ডেন বলে ঠিক তাই! লাল লাল লঙ্কা, কটা তাজা ক্যাপসিকাম, পুরুষ্টু ঢ্যাঁড়স... সব ঐ অসীম গিন্নীর যত্নের ফল ভূবনবাবু মনে মনে দাঁত খিঁচোলেন আর তার নিজের বাড়ির বাগান? বাগান নয় পোড়ো জমি! সুশান্তটা মানুষ হলো না আর ওর বৌটাও সাক্ষাৎ শশ্মানকালী! কালী নামটা উচ্চারণ করেই শূন্যে জিভ কাটলেন... মাগো অপরাধ নিও না মা! অসীম ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে ভূবনবাবু সুড়ুৎ করে পিছু নিলেন। ঘরখানা কেমন বিষন্ন ঠেকছে... কেমন একটা কান্না কান্না গন্ধ। ব্যাপার কী? 

অসীম চুপ করে সোফায় বসে আছে গিন্নী ও। ভূবনবাবু চুপটি করে বসে পড়লেন বেতের মোড়াটায়। আগে এলে এটাতেই বসতেন, বেশ আরাম এটায় বিশেষত উপরে ঐ যে মোটা গদি করা আছে বাতিল জামাকাপড় ভরে সেলাই করে  ও জিনিস ছোটোবেলায় অনেক দেখেছেন ভূবনবাবু। মা-ও এমন করতেন। তখন সোফাটোফা কোথায়? সব-ই ঐ মোড়া বা কাঠের চেয়ার। অসীম চক্রবর্তী বৌকে কী যেন বলছে খেয়াল হলো ভূবনবাবুর... 

-বাবু কোথায়? বিকেলে আজ বেরিয়েছিল? 
-কৈ আর? সেই নিজের ঘরে ঢুকে বসে আছে
-চা - টা দিয়েছ?
-না! 
-যাও যাও চা করো। 
-আর চা? ঐ চাকরী চাকরী করেই ছেলেটা আমার পাগল হয়ে যাবে! 
-কী করা যাবে বলো? এক মহামারী-ই...
-মহামারী তো কেটে গেছে দুবছর হতে চললো টিকা ফিকাও দেওয়া শেষ! কিন্তু মানুষের চাকরী বাকরী কবে স্বাভাবিক হবে বলতে পারো? 
-বিশ্বজুড়ে মন্দা গিন্নী! সব জায়গায় রিসেস...বড় বড় কোম্পানিগুলো বুঝে গেছে বেশি লোক নিয়ে লাভ নেই! তাই লোক ছাঁটাই আর যন্ত্র নির্ভরতা। 

-কী বলছ কী তুমি? এতগুলো টাকা খরচ করে ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ালাম কত ভালো রেজাল্ট! সে কী বাড়ি বসে থাকার জন্যে? 
-দিনদুনিয়া বদলে গেছে বুঝলে...বেকারত্ব বাড়ছে। ছেলে তোমার আদৌ কোনো চাকরী পাবে কিনা কে জানে!
-ভর সন্ধ্যেবেলায় অলুক্ষণে কথা বলো না তো! বাবু ঠিক চাকরী পাবে দেখো।

ভূবনবাবু কেমন থতমত খেয়ে গেছেন বাঁহাতের নখ গুলো চিবোতে গিয়ে মনে পড়ল নখফখ তো অনেকদিন নেই! চুল দাড়িও না! ইশ! এতকিছু ঘটে গেছে কিছুই জানেন না! অসীমের ছেলেটা তো বেশ ভালো চাকরী করত সেই হায়দ্রাবাদে, এর মধ্যে চাকরী বাকরী নেই! কত কী হয়ে যাচ্ছে কিছুই টের পাচ্ছেন না। ভূবনবাবুর খুব খারাপ লাগতে লাগল। ঠিক এইসময় দু কাপ চা নিয়ে অসীমগিন্নী সামনের টেবিলে রাখলেন। ভূবনবাবু নাক টেনে শোঁকার চেষ্টা করে বুঝতে পারলেন গন্ধটা আগের মতো না কেমন যেন সস্তা চা-পাতার গন্ধ। বুঝলেন অসীম ভালো নেই। পেনশনের টাকায় সংসার চলছে বোধহয়। অসীম গিন্নী ছেলেকে চা খেতে ডাকতে যেতেই ভূবনবাবু একটা কাপে চুমুক দিলেন। 

অসীমগিন্নীর পিছু পিছু ছেলেটা ঘরে ঢুকল। ছেলেটাকে দেখেই ভূবনবাবুর চোখে জল এলো আহা রে! ঝকঝকে ছেলেটা কেমন ফ্যাকাশে মেরে গেছে। বড় ভালো রেজাল্ট করেছিল উচ্চমাধ্যমিকে, পাড়ার গর্ব ছিলো আর আজ? ভূবনবাবু নিজের ছেলে সুশান্ত - র কথা ভাবলেন ব্যাটা উচ্চমাধ্যমিকে একবার ধেড়িয়েছিলো! কিন্তু ঐ চিটফান্ডের ব্যবসা করে কেমন গাড়ি হাঁকাচ্ছে দেখো। নিজের এঁটো কাপটায় বাবু পাছে মুখ দেয় এই ভয়ে ভূবনবাবু কাপটা একঝটকায় ফেলে দিলেন... 

-ইশ! ছেলেটার মুখের চা'টা...অসীমগিন্নী কঁকিয়ে উঠলেন। 
-যাও না আর এককাপ করে আনো। 
-দাঁড়াও ভাঙা কাপটাপ গুলো পরিস্কার করি! 

খানিকপরে আরেককাপ চা নিয়ে তিনজনে সোফায় বসতেই ভূবনবাবু ভালো করে শুনতে লাগলেন... 
-বাবা ভাবছি ব্যবসা শুরু করব। 
-ব্যবসা করবি? কীসের? 
-কেন চায়ের
-চায়ের ব্যবসা? মানে চায়ের দোকান দিবি? 
-অমন চমকে উঠলে কেন মা? 
-তুই এত লেখাপড়া শিখে চা বেচবি? 
-বাবু! চিন্তায় চিন্তায় তুই পাগল হয়ে গেছিস বাবা! - এসব কী বুদ্ধি? এখনো আমার পেনশনটুকু আছে ঠিক চলে যাবে! 
-আরে শোনোই না! 
-কী শুনবো? চা বেচবি তুই...সে গল্প শুনবো? 
-চা বেচা মানে কী জটাদার দোকান? আমি একটা থিম চায়ের আউটলেট খুলবো। 
-সে আবার কী? 
-লোকে নানান ধরনের চা পাবে সেখানে। সামথিং ইউনিক...ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখলাম একটা ছেলে সামান্য পুঁজি নিয়ে কী দারুণ একটা চায়ের ঠেক বসিয়েছে! কী দারুণ বিক্রি! আমি আরো নান্দনিক করব বিষয়টা একটা ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে শুরু করব... নানান স্বাদের চা আর তেমন সুন্দর পাত্রে সার্ভ করা হবে। একটা আড্ডা কর্নার থাকবে... নানা বয়সের মানুষ গল্প করতে করতে চা খাবে। 

-হবে এমনটা? ছেলের জ্বলজ্বলে মুখের দিকে তাকিয়ে অসীমগিন্নীর অনেকদিন পর ভালো লাগলো। 
-কেন হবে না মা? 
-কিন্তু অতবড় জায়গা... 
-ঠিক বলেছ বাবা! একটা জায়গা পেলে খুব ভালো হতো...
-কেমন জায়গা রে? 
-আরে আমাদের গলির মুখে ভূবনজেঠুর বাড়িটা! একটু সারিয়ে টারিয়ে নিলে ... প্রশান্তদা তো থাকেও না! 
- না থাকলেও ও ছেলে শুনছি বাড়িটা প্রোমোটিং-এ দেবে।ঐ ভূতের ভয়েই যা আটকে আছে! 
-ভূতের ভয়? সে আবার কী? 
-তুই তো আজকাল তেমন বেরোস টেরোস না তাই শুনিসনি, সেই যে গতবছর ভূবনদার দেহটা তিনদিন বাড়ির ভেতর পড়েছিল না... ছেলে তো কবেই বৌ বাচ্চা নিয়ে কলকাতার ফ্লাটে তা ও থেকেই লোকের মুখে মুখে ও বাড়ি ভূতুরে। 
-আহা! ভূবনবাবু বড় ভালো লোক ছিলেন... আমার হাতের চা বড় ভালোবাসতেন! 
ভুবনবাবু মোড়ায় খানিক নড়ে চড়ে বসলেন মনে পড়ে গেল গতবছর খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সে কী শ্বাসের কষ্ট! কিছুতেই শুতে পারেন না  ছেলেকে ফোন ও করেছিলেন মনে আছে... কেউ আসেনি! কাজের মেয়েটাও ঐ শ্বাস উঠতেই আর বাড়ির ধার মাড়ায়নি। ঐ ইজিচেয়ারে বসে বসেই... এই এমনই বিকেল বেলা হবে খুব চা তেষ্টা পেয়েছিল মনে আছে... 

আচ্ছা! প্রশান্ত - র তবে এই মতলব! বাপ মরতেই বাড়ি প্রোমোটার কে দেওয়া? দেখাচ্ছি ! ভূবনবাবু ফুঁসে উঠলেন। 

-বাবা, তুমি একবার প্রশান্তদার সাথে কথা বলবে? 
-বলে কী কোনো লাভ হবে রে! ও বাড়ির ভাবনা ছাড়! অন্য কোথাও...বাড়ি দেখতে হবে বুঝলি! 

ভূবনবাবু মোড়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন! চিৎকার করে বললেন, 
-বাবু তোর কোনো চিন্তা নেই ও বাড়িতে-ই তুই তোর চা আড্ডা খুলবি! আমিও ভূবন বিশ্বাস ফাদার  অফ প্রশান্ত বিশ্বাস আজ রাতেই এমন ভয় দেখাবো বাছাধনকে  বাপ! বাপ বলে তোকে বাড়ি দেবে! 

গটগট করে অসীমবাবুর বাড়ির দরজা ভেদ করে হাঁটা দিলেন ভূবন! সামনে অনেক কাজ! প্রথমেই পাঁচ বছর আগে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া গিন্নীকে প্রেতলোক থেকে খুঁজে বার করতে হবে তারপর দুজন মিলে লাগাতার প্রশান্তকে ভয় দেখাতে হবে! ব্যাটা করোনা ভূবনবাবুকে বহুকষ্টে দিয়ে মেরেছিল সে শয়তান পালালো কিন্তু অমন সোনার টুকরো ছেলেটার চাকরী গেলো ভালোভাবে বাঁচাটুকু পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো এ তো বরদাস্ত করা যায়না! একদম না! 

2 Responses

  1. Mousumi Mukhopadhyay says:

    বাঃ! ভালো ভূতের গল্প।

  2. Mousumi Mukhopadhyay says:

    ভীষণ ভালো লাগল। ভালো ভূতের গল্প।

বৈশাখী ২০২৪