গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে কয়েক পা এগোতেই একটি যুবক এগিয়ে এসে বলল, “অসিত কুমার ঘোষ?” অসিত মাথা নেড়ে হাত বাড়ায় তৎক্ষণাৎ। ছেলেটি জোড় হাতে নমস্কার সেরে বলে, “আমি প্রিয়ম বসু। ক্ষমা করবেন এই কোভিড আবহে হাতটা... আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।” অসিত হাতটা পকেটে চালান করে বলে, “না, না ঠিক আছে। আপনাকে দেখেই আন্দাজ করেছি। বলুন এখানে ডাকলেন কেন?” প্রিয়ম বাড়ীটির দিকে ফিরে একবার চারিদিক দেখে নিয়ে বলল, “আসলে আপনার ব্লগের অনেক নাম শুনেছি। তাছাড়া, আমি নিজেও বেশ কয়েকটা লেখা পড়ে বেশ ইন্টারেস্ট পেয়েই আপনাকে শেষমেশ কলটা করেই ফেললাম। আচ্ছা আপনি কি এতগুলো জায়গায় সত্যিই ভূত দেখেছেন?” অসিত বলল, “ আসলে আমি ঘোস্ট হান্টার হলেও ব্লগ লেখা আর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আমার নেশা। সেই সূত্রেই বেশ কয়েকটা হন্টেড হাউসে রাত কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। ব্লগে উল্লেখিত কয়েকটা বাড়ীতে অবশ্য থাকতে পারিনি। সেই গল্প গুলি জনশ্রুতি।” কথা বলতে বলতে ওরা এগিয়ে গিয়েছে বাড়ীটির দিকে। গোলাকৃতি গাড়ী বারান্দায় এসে বিরাট গেটের সামনে দাঁড়াল ওরা। প্রিয়ম আবার চারপাশ দেখে নিয়ে বলল, “একটু সাবধানে পা ফেলবেন। আমরা কিন্তু এখানে ট্রেসপাসার।” অসিত ভ্রু কুঁচকে বলল, “ট্রেসপাসার কেন?” প্রিয়ম দরজায় হালকা একটা চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটি জ্বালাতে বলে ধীরে ধীরে পা রাখল একটি লম্বা করিডরে। প্রিয়ম এবার বলল, “ গুগল সার্চ করলে কলকাতার হন্টেড হাউসের লিস্টে ন্যাশনাল লাইব্রেরি, হেস্টিংস হাউস, পুতুলবাড়ির পাশাপাশি এই বাড়িটির উল্লেখও পাওয়া যায়। কিন্তু খুব কম মানুষই এখানে প্যারানরমাল একটিভিটি দেখেছেন। তাই খুব একটা পাত্তা পায়না। সরকার এটিকে হেরিটেজ বিল্ডিং বানিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর তৈরি হবে এখানে। অন্তত গুগল তো তাই বলে। তাও কাজ শুরু করতে গেলেই কোন না কোনভাবে আটকে যায়। যারা কাজ করতে আসে তারা বলেছে এই প্রাসাদটিকে ঘিরে থাকা গাছগুলিই আসলে বাধ সাধছে। যতই কাটা হোক না কেন কিছুতেই নির্মূল হয়না। ও যা বলছিলাম। ট্রেসপাসার কারণ বিনা অনুমতিতে রাত্রিবেলা ঢুকে পড়েছি।” অসিত ঢোঁক গিলে বলল, “এই সেরেছে। জানেন তো প্রবাদটা? পুলিশে ছুঁলে...” প্রিয়ম হাসে, “ভয় নেই রাতের বেলা ভূতের ভয়ে পুলিশও এদিক ঘেঁষবে না।” অসিত অল্প আলোয় দেখল, বাড়িটির বাইরেটা পুরনো ধাঁচের হলেও ভেতরটা ইউরোপীয় কায়দায় তৈরি। দরজা জানলা, মেঝে, সিঁড়ি, ঘরের ভেতরের কারুকার্য বেশ শৌখিন ও রুচিসম্পন্ন। প্রিয়ম বলতে থাকে, “আপনি হয়তো জানেন না, এখন যে বাড়ির ভেতর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন তা ভারতবর্ষের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। এই বাড়িটা আসলে রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিকের। তিনি দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন বলে বিলেতে নিজের পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে দেশে ফিরে আসেন ও কংগ্রেস দলের সাথে যুক্ত হন। তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঋষি অরবিন্দ। এছাড়াও, বিপ্লবীদের আস্তানা ছিল এই বাড়ী। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই বাড়ীতে লুকিয়ে ছিলেন অনেক বিপ্লবী। রাজা নিজে তাদের খাওয়া পরার ভার নিয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন সংগ্রামী নেতা। তাঁর এই অবদানের জন্য পরবর্তী কালে ওয়েলিংটন স্কয়ারের নাম পাল্টে করা হয়, রাজা সুবোধ মল্লিক সরণি।” — বাহ! আপনি তো বেশ পড়াশোনা করে এসেছেন দেখছি। আমি সত্যিই জানতাম না এতো কিছু। — আমি আসলে একজন ইউটিউবার। এই ধরনের কন্টেন্ট জোগাড় করাই আমার কাজ। এবারে আপনার সাহায্য ছাড়া পারবো না বলেই আপনাকে ডাকা। —আমাকে কি করতে হবে? এখানে ভূত আছে কি না তা খুঁজে বের করতে হবে তাই তো? — হ্যাঁ। আর আমি ভিডিও বানাবো। আপনার অনুমতি নিয়ে। ওরা কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে দোতলায়। বাড়িটার দেওয়াল ফাটিয়ে উঠে এসেছে একটা বটগাছ। তার ঝুড়ি গুলি দেওয়ালে চিড় ধরিয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। অসিত ও প্রিয়ম সাবধানে সেগুলি ডেঙ্গিয়ে ঢুকে পড়ল একটি ঘরে। অসিত জিজ্ঞেস করল, “হেরিটেজ বিল্ডিং অথচ কোন পাহারা নেই! অদ্ভূত। আচ্ছা কি যেন বলছিলেন গাছের কথা?” প্রিয়ম অসিতের পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানে থেকেই বলল, “বেশ ক'দিন আগে এখানে একটা ফিল্মের শুটিং হচ্ছিল। ভূতের সিনেমা। রাতের সিন। অভিনেতা দাঁড়িয়ে ছিল এই গাছের কোন এক ডালপালা ধরে। অ্যাকশন বলতেই তার ঝাঁপানোর কথা, অভিনেতাও কথা মতো ঝাঁপ দিল আর সঙ্গে সঙ্গে একটা লতানে ডাল তাকে প্রায় পেঁচিয়ে ধরলো। লোকটা যত ছটফট করে তত গাছ পেঁচিয়ে ধরে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ লড়াই করার পর লোকটি আতঙ্কে ও রক্তাল্পতায় মারা যায়। এটা একটা বড় ঘটনা কিন্তু মিডিয়া চেপে গেছে। এছাড়াও গাছ কাটতে এসে কিছু শ্রমিক আহত হয়। গাছ থেকে পড়ে যায়। এরকম কিছু টুকরো ঘটনারও উল্লেখ আছে। তবে যেহেতু তথাকথিত ভূত কেউ দেখেনি তাই ভূতুড়ে বাড়ী হিসেবে এর খ্যাতি বা কুখ্যাতি কম।” অসিত হাসে, “তা আপনার এই বাড়ীটাকে ভূতুড়ে বানিয়ে কি লাভ শুনি?” তারপর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে মেঝেতে বসে পড়ে বলে, “উদ্ভিদ জিনিসটা বেশ রহস্যময় জানেন তো। এমন অনেক গাছ আছে যারা কারনিভরাস। মাংস খায়। আবার পিরানহা মাছের মতো দাঁত আছে। হয়তো সেরকমই কোন গাছ এখানে আছে। আর মৃত অভিনেতা সেই গাছের পাল্লায় পড়েছিল।” অসিত প্রিয়মের দিকে তাকায়। অল্প আলোয় বোঝা না গেলেও অসিতের মনে হয় যুক্তিটা প্রিয়মের মনের মতো হয়নি। পকেট থেকে একটা যন্ত্র বের করে মেঝের ওপর রেখে বলল, “ভূত মানে কি বলুন তো?” প্রিয়ম বলল, “ভূত মানে সবাই তো জানে আত্মা। মৃত ব্যক্তির আত্মা।” — সেটা তো চলিত কথা। ভূত হচ্ছে অতীত। এই যে দু'মিনিট আগে আমি আর আপনি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এটাই ভূত। এখন যা বর্তমান তা পরক্ষণেই ভূত। এই যন্ত্রটি ইন্ডিকেট করবে এই ঘরে বা বাড়ীতে কোন বেশি শক্তিমান পার্টিকেলের অবস্থান আছে কি না। অসিত একটি ছোট চৌকো যন্ত্র মাটিতে রেখে একটি বোতাম টিপে দিল। একটা মৃদু শব্দ তুলে যন্ত্রটির লাল নীল আলো জ্বলতে শুরু করলো। পরক্ষণেই আলোগুলির জ্বলা নিভার গতি বেড়ে গিয়ে ঘন ঘন শব্দ তুলতে শুরু করলো। অসিত চঞ্চল হয়ে উঠে বলল, “আছে প্রিয়ম এখানে আমাদের থেকে শক্তিশালী পার্টিকেল আছে। দেখছ কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল ঘরটা? প্রিয়ম...প্রিয়ম?” অসিত চারিদিকে চেয়ে দেখল প্রিয়ম ধারে কাছে নেই। ঘরটা বেবাক ফাঁকা। যন্ত্রটা পকেটে পুড়ে অসিত মোবাইল হাতে দৌঁড় লাগালো। দোতলায় আরো বেশ কয়েকটি ঘর আছে। বেশিরভাগই তালা ঝোলানো। অসিত ছুটে গেল সিঁড়ি ধরে তিনতলায়। এটা সম্পূর্ণ ছাদ। বাড়ী লাগোয়া গাছের মাথা দিয়ে ঢেকে আছে চারিদিক। পূর্ণিমার চাঁদের ছটা আসছে পাতার ফাঁক চুঁইয়ে। সেই আলোয় অসিত দেখে প্রিয়মকে | আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে কিছু ডালপালা। প্রিয়ম আপ্রাণ সেগুলিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। যন্ত্রনায় ছটফট করছে ছেলেটা। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে বাইরে। অসিত ওর কোমর থেকে একটা ছোট ছুরি বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ল গাছের ওপর। একটা ডাল পাশ থেকে সজোরে তাকে দূরে ঠেলে দিল। ছিটকে পড়ল অসিত ছাদের কার্নিশের ওপর। একটা ধুপ শব্দে পিছন ফিরে দেখে প্রিয়ম নেই। দৌড়ে অপর প্রান্তের কার্নিশের ধারে গিয়ে অসিত ঝুঁকে পড়ে আর ততধিক অবাক হয়। কোথায় প্রিয়ম? ওর শরীরটা তো নীচেই থাকার কথা। এতো তাড়াতাড়ি কে সরাবে দেহটা? ভাবতে ভাবতে পিছন ফিরেই চমকে ওঠে অসিত। তার সামনে প্রিয়ম। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, ঠোঁটের কোণে জমাট বাঁধা রক্ত, ফ্যাকাসে শরীর। অসিতের গলা শুকিয়ে কাঠ। অতিকষ্টে বলে, “প্রিয়ম তুমি?” প্রিয়ম তার সাদা ধবধবে দাঁত বের করে। তারপর দাঁত চেপে বলে, “আমি এভাবেই মারা গেছিলাম অসিত বাবু। কিন্তু ব্যবসা মার যাওয়ার ভয়ে প্রোডাকশন হাউজ খবরটা বেমালুম চেপে গেছে। আপনি তো জানলেন। এবার আপনি সবাইকে জানাবেন। আর যদি তা না হয়... ” প্রিয়ম আবার তার দাঁত বের করে হাসে। হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে এক পা দু'পা পিছিয়ে যেতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। অসিত প্রথম থেকে সব কটা ঘটনা মেলাতে থাকে। প্রিয়ম বরাবর তার পিছন দিকে ছিল অর্থাৎ অন্ধকারের দিকে। সে প্রথমেই হাত মেলায়নি । তার ঠান্ডা স্পর্শেই অসিত সব বুঝে যাবে বলে। আর শেষ কথা প্রিয়মের ফোন নম্বরটা প্রথম থেকেই অসিতের একটু অন্য রকম লাগছিল। কারণ স্ক্রিনের ওপর বারবার ভেসে উঠছিলো মৃত অভিনেতা রূপক গোস্বামীর নাম। টেকনিক্যাল ফল্ট ভেবে এড়িয়ে গেছিল ব্যাপারটা। অসিত চেয়ে দেখে পুব দিক লালচে হয়ে এসেছে। প্রিয়ম শুধু তার মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যই অসিতকে ডেকে এনেছিল এখানে। ওর শেষ ইচ্ছে তাকে পূরণ করতেই হবে। অসিত সাবধানে নেমে এলো নীচে। গেট খুলে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। মোবাইল ফোনে ডায়াল করলো বন্ধু ও উদ্ভিদবিদ তন্ময় সেনকে। ওর সাহায্য ছাড়া এই রহস্য উদ্ঘাটন করা অসম্ভব। সত্যিই কি গাছগুলো কারনিভরাস নাকি অন্য কোন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এর পিছনে। কি চায় ওরা? কেনই বা বারবার বাধা দিচ্ছে ওরা বহিরাগতদের? অনেক প্রশ্নের ভিড় জমেছে অসিতের মস্তিষ্কে। সব জট একে একে খুলতে হবে খুব ঠান্ডা মাথায়। মাঘের ভোরেও অসিতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে হেঁটে চলেছে মহানগরের ব্যস্ত পথ ধরে। যে পথ জানে না রাত নামলে তার আনাচে কানাচে কতো রহস্যই না কুন্ডলি পাকিয়ে জন্ম নেয়।