সে আমার এক জবর ভূত দেখা । ঘোর শ্রাবণের সে এক সন্ধ্যা পেরোনো রাত। এই হবে রাত আটটা। ফিরছি লেক মার্কেট থেকে গানের ক্লাস সেরে। গড়িয়া থেকে তেঁতুলতলা চারটে স্টপেজ মাত্র। যখনকার কথা বলছি তখন হাতে গোনা কয়েকটা বাস চলত গড়িয়া থেকে ডায়মন্ড হারবার ক্যানিং জয় নগর রুটে। ছাদ বোঝাই লট বহর বোঝাই করে নিয়ে ছিল তাদের চলা। গড়িয়া থেকে চারটে স্টপেজ পেরিয়ে তেঁতুলতলা নামতেই সে এক লো ভোল্টেজ আলোর ছায়াময় অন্ধকার। তেঁতুল তলায় আলো তো ছিল । কিন্তু ঝাঁকড়া এক তেঁতুল গাছেই জায়গাটা থাকত আধো অন্ধকার হয়ে । সঙ্গী কোন বাস যাত্রী থাকলে তবু একটু সাহস করে পাড়ার ভেতরে পা বাড়ানো। নয়ত একা একা একটা অমন আধো অন্ধকার খোয়া ফেলা লম্বা রাস্তা পার করতে একটু হিম্মতের দরকার হতো । বাস থেকে নেমে রাস্তা পেরোতে দুপাশে দুটো ফাঁকা মাঠ । বেগুন ক্ষেত, ঝিঙ্গে খেত । ফাঁকা মাঠে গাছগাছালি । ইটের রাস্তার দু'পাশে ডোবা জলা। ওই রাস্তাটুকু পেরোলে তবে পাড়ার শুরু। বাঁ পাশে ভদ্র বাবুর বাড়ি । ডান পাশে উকিল বাড়ি। পাড়ায় ঢুকলে তবু একটু লোকের সাড়া পাওয়া যেত। কোন বাড়িতে পড়ার শব্দ, কোন বাড়িতে হয়তো ঝগড়াঝাঁটির শব্দ, কি হয়তো কোনদিন শান্তশিষ্ট নিরিবিলি পরিবেশ। কখনো চাঁদনী রাত। তখনো কলকাতায় টি ভি আসে নি । রেডিওর গানেই পাড়া মাত হয়ে থাকত। রেডিও শুনেই আমরা সময় বুঝে যেতাম। এই সবে রাত আটটা পার হয়েছে। মনে মনে ভাবলাম একটু আড্ডা দিয়ে যাই। আমার ফেরার পথে ঈষৎ আড্ডা দেবার একজন মানুষ ছিলেন স্বপন দা। নাটক পাগল মানুষ। কাশীপুর গান শেল ফ্যাক্টরি তে কাজ করতেন। হাসি খুসি একজন গল্প বাজ মানুষ আর কি। স্বপন দার কাছে ঢুঁ মারতাম একটু আড্ডা মারার মানসে। স্বপন দা ওনার নাটক লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন । আমাকে দেখেই বলে ওঠেন, ‘আরে শীতেশ যে? আসো আসো । কি কলেজ থেকে?’ বললাম, ‘না গানের ক্লাস থেকে । কি করছেন?’ ‘বুঝলে, এবার একটা নাটক লিখেছি। ভাবছি এ পাড়ার ছেলেমেয়ে গুলো, মনা, বিদ্যা, পুকাই, চঞ্চলা, উকিল বাড়ির অপু ওদের নিয়ে আর তোমার বিউটি দি’কে নিয়ে নাটক টা করব । নাটক মানে একটা নৃত্যনাট্য ।’ বিউটি দি ওনার স্ত্রী । বিউটি দি চা হাতে নিয়ে এসে বসে। আমাকে ও চা দেয়, ‘নে, চা খা ।’ চা নিলাম হাতে। স্বপনদা নাটকটা শোনাতে উদ্যোগী হলেন, ‘শোনো একটু শোনাই। এটা একটা জন্মান্তরের গল্পের মতো। মানে পর জন্মের কথা। ধরো ক্ষুধিত পাষাণ!’ বললাম, ‘ক্ষুধিত পাষাণ এর নৃত্যনাট্য?’ ‘না না তা নয়। শোনো মধ্যপ্রদেশে একটা ফোর্ট আছে, বুঝলে! নাম ভাঙ্গার ফোর্ট। খুব ভূতের উৎপাত। আচ্ছা, তুমি ভূত দেখেছো কোনদিন? হেসে বললাম, ‘না সে সুযোগ আমার হয় নি কোনদিন।’ ‘আমার হয়েছিল একবার জান তো। ‘- স্বপন দা বললেন, ‘না মানে আমি চাক্ষুস দেখিনি। কিন্তু তেনার পায়ের আওয়াজ শুনে ছিলাম একদম স্ব কর্ণে । ‘ বড় কৌতুহল হল । জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সে কি, দেখেন নি । শুধু আওয়াজ শুনলেন?’ ‘হ্যাঁ, শুধু আওয়াজ। তাতেই আমার ইয়ে কি বলে হাওয়া বেরিয়ে গেছলো ।‘- স্বপন দা বেশ একটা ভয় পেয়ে যাওয়া ভাবে বলতে থাকেন, ‘গারস্টিন প্লেস চেনো? সেই পুরানো রেডিও অফিস । সেখানে জানো তো সত্যি ই ভূত আছে । ‘ কথাটা শোনা। তাই মাথা নেড়ে সন্মতি জানালাম । বললাম, ‘হ্যাঁ, পুরানো রেডি ও অফিস । শুনেছি কথাটা ।’ স্বপন দা জানালেন, ‘সেই অফিসের একটা ঘরে বসে একবার একটা নাটক লেখালেখির কাজ করছিলাম বসন্ত ভট্টাচারজের সঙ্গে। সে তুমি চিনবে না। আকাশবানী তে নাটক প্রযোজনা করতেন। সে দিন একটা কাজ চলছে। রাত প্রায় ন’টা বাজে। আমরা একটা নাটক নিয়ে খুব কাজে ব্যস্ত। রেডিওর নুতন একটা প্রযোজনা নিয়ে প্রস্তুতি চলছে। সে ও অবশ্য ভূত নিয়েই গল্প। এর মধ্যে কেয়ার টেকার এসে বলে, ‘আপনারা কি এখনো কাজ করবেন? তাহলে এই চাবি দিয়ে গেলাম।’ বসন্ত দা বলেন, ‘না না দাঁড়াও । আমরা ও উঠছি ।’ কেয়ার টেকার দরজার সামনে আমাদের গাত্রোত্থানের অপেক্ষায়। ভাবটা এমন, আমাদের কাজ না হলে সে চাবি রেখে এক্ষুনি কেটে পড়বে। কি ঠ্যালা! বসন্ত দা আমাকে বললেন,’ স্বপন এবার চলো ওঠা যাক। তেনাদের বেরোনর সময় হয়ে যাবে।’ আমরা তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে যাব এমন সময়ে পাশের করিডোরে একটা অদ্ভুত টহল দিয়ে চলার শব্দ আমাদের হত চকিত করে দিল। কে চলে? কেউ তো নেই? আমরা হত চকিত । কেয়ার টেকার ভীত ভাবে আমাদের ইশারা করে বুঝিয়ে দিল ‘ঐ বেরিয়েছে ‘। মানে ভূত? আর কি ঘটল জানো? আমাদের ঘরের কি বোর্ডের চাবি গুলো ঝিন ঝিন শব্দে নড়ে উঠল । স্বপনদার বর্ণনা শুনতেই আমার ও মাথার চুলের গোড়ায় যেন কারেন্ট পাস করে গেলো। বেশ একটা শিরশিরানি অনুভব করলাম। স্বপন দা বলছেন, ‘শব্দ টা মিলিয়ে যেতেই আমরা তিনজনে পড়ি কি মরি করে দরজা বন্ধ করে ধাঁ। সেই আমার ভুতের অস্তিত্বের পরোক্ষে অনুভুতি বুঝলে ।’ আমি মাথা নেড়ে বলি, ‘খুব বাঁচান বেঁচে গেছেন তাহলে?’ বিউটি দি হেঁ হেঁ করে হেসে হেসে বল তে থাকে, ‘সে আর বলিস না। ক’টা দিন তো সন্ধ্যের পরে তোর স্বপন দা জানলা দরজা খুলতেই দিত না । সব বন্ধ করে বসে থাকতো ঘরের মধ্যে।’ স্বপন দা চোখ বড় বড় করে বলে ওঠেন, ‘সত্যিই তাই। সে যা ভয় পেয়েছিলাম না! - ও জানো তো, আজ তোমাদের পাড়ার পুলিন বাবু মারা গেছেন ।’ ‘হ্যাঁ, কলেজ যাবার সময় শুনে গেছি। অনেক বয়স হয়েছিল ।’ - আমি বলি। ‘হ্যাঁ, নব্বই পার। দেখো একটু সাবধানে যেও ।’- স্বপন দা র ঠাট্টা আর কি । উনি হাসলেন । আমি ও একটু হেসে নিলাম । বিউটি দি বলে ওঠে, ‘যাহ্, শুধু শুধু ওকে ভয় দেখাচ্ছ ।’ বড় প্রেস্টিজে লাগলো। বিউটি দি কে বল লাম, ‘হ্যাঁ অত যেন সস্তা? বললেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম।’ স্বপন দা নিজের দোষ স্খালন করলেন, ‘দ্যাখো না । বোঝে না।’ আমি বল লাম, ‘নাটকটা কি বলছিলেন, বলুন । স্বপন দা শুরু করে, ‘হ্যাঁ যা বলছিলাম। তো ধরো, ঐরকম একটা প্রাচীন রাজমহলে রাজকন্যা এক চাঁদনী রাতে প্রান পেয়ে জেগে উঠবে। গত জন্মের রাজকুমার এ জন্মে একজন নামকরা চিত্রকর, এই রাজমহলে এসেছে কিছু ছবি আঁকতে । রাজকন্যা তার কাছে দেখা দেবে চাঁদনী রাতে । কি বলো, খারাপ হবে? আমি বললাম, ' আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়। কিন্তু এটা কি ভয়ের নাটক?' 'আরে না না, ভয় নয়। প্রেমের নাটক। ভূতেদের নিয়ে।' স্বপন দা নাটক টা খানিকটা পড়ে শোনালেন। ' ও বাবা রাত সাড়ে ন'টা বাজে। আজ উঠি স্বপন দা।' - আমি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। স্বপন দা বলে ওঠেন, ‘যাবা? আচ্ছা যাও । দেখো বৃষ্টি পড়ছে না তো! ছাতা আছে? না থাকলে নিয়ে যাও।' আমি বলি, 'না লাগবেনা। চলি।' - বেরিয়ে পড়লাম। আজ পকেটে টর্চটাও নেই। টিমটিমে লাইট আছে রাস্তায়। মফস্বলের লাইট তো! বছর কয়েক হল এ দিকের অঞ্চলে লাইট এসেছে অনেক তদবির তদারকের পরে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সেটা লো ভোল্টেজ হয়ে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই বাতি গুলো ও থাকে নিস্প্রভ অনুজ্জ্বল হয়ে। আমি এগিয়ে চলেছি। আধো অন্ধকার। মনে মনে একটা গান গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে সেবক শিল্পী চক্রের আটচালা আর ক্লাব ঘরটা পার হয়ে সুকাদাদের বাড়ীর কাছে এসেছি কি, হঠাৎ খানিকটা দূরে ডান দিকে পুলিন বাবুর বাড়ির মুখটায় ও কে? ওটা কি পুলিন বাবুর ভূত? আজই তো মারা গেছেন পুলিনবাবু। আর কান্ড দেখো! মৃত পুলিনবাবুর বসত বাড়ির দিকে অতন্ত্য ব্যগ্র ভাবে তাকিয়ে আছে সেই শীর্ণকায় পুলিনবাবু সদৃশ বিরাট অবয়ব! যেন সেই বৃদ্ধ পুলিন বাবু স্বয়ং! আমি কি ভুল দেখছি? গা টা কেমন শির শির করে উঠল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা কারেন্ট পাস করে গেলো । রাস্তার লো ভোল্টেজ আলোয় সে এক বিকট মূর্তি। মাটি থেকে ওদের এক তলার ছাদের রেলিং অবধি ওনার অবয়ব। অদ্ভুত এই যে, রাস্তায় নেই কোন লোক, নেই কোন জন । এমন কি একটা কুকুর টুকুর ও নেই রাস্তায় । থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই যাঃ স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপটা ও হঠাৎ ছিঁড়ে গেল। ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নাঃ ব্যাপারটা ঠিক সুবিধা ঠেকছে না। তাই পায়ে পায়ে পিছতে পিছোতে এবার এক দৌড়ে প্রায় সোজা স্বপন দার বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। 'স্বপন দা।' স্বপন দা অবাক,' আরে! কি ব্যাপার শীতেশ?' 'পুলিন বাবুর ভু ভু ভূত!' 'কি বলছ কি? কোথায়!' 'পুলিন বাবুর বাড়ির সামনে ।' বিউটি দি বলে, ‘বলছিলাম, ওকে ভুতের ভয় দেখিয়ো না ।’ স্বপনদা সন্দেহ প্রকাশ করে,' পুলিন বাবুর বাড়ির সামনে পুলিন বাবুর ভূত? ‘ বিউটি দি বলে, ‘কেন, হতে পারে না? পুলিন বাবু তো আজই মারা গেছেন। ভূত তো হতেই পারে । ' স্বপন দা সন্দেহ প্রকাশ করে, ‘ঠিক দেখেছো তো?’ আমি কাঁপছি ।- ‘হ্যাঁ, পু পু পুলিন বাবু নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ' 'যাঃ কি যে বলো! চলো তো গিয়ে দেখি!' স্বপন দা আমাকে এগিয়ে দিতে হাতে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। এবার আমরা চলতে লাগলাম। স্বপনদা বলেন, ‘আজ একটা ভূত দেখার এক্সপেরিয়েন্স হবে তাহলে। কি বলো! কিন্তু এতক্ষন ধরে তিনি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন কি?’ একটা আশঙ্কা নিয়ে আমরা আবার নারান দের বাড়ি পার হলাম ।কর্মকারের বাড়ি পার হলাম । সুশীল মাস্টারের বাড়ি পার হলাম। সাধন দের বাড়ি পার হলাম। চিনি বাঁশের দোকান পার হলাম । ডান দিকে বাঁক নিলাম । সেবক শিল্পী চক্রের আটচালা । আর ক্লাব ঘরটা পার হয়ে সুকা দা দের বাড়ীর কাছে আসতেই আবার সেই একই দৃশ্য। ‘ওই যে ।’ - আমার গতি থমকে গেল। স্বপন দা অবাক । ‘তাই তো! কিন্তু এটা কি ভূত?’ আমি ও ভাবলাম, ‘তাই তো! এ কি ভূত? ‘- কিন্তু ভেবে পেলাম না কি হতে পারে? স্বপন দা বলেন, ‘চলো ত এগোই! মনে হচ্ছে একটা অদ্ভুত কিছু? ভূত কি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?’ এগোলাম আমরা। কাছাকাছি এসে স্বপন দা টর্চ ফোকাস করলেন । ওঃ বাবা, এ যে একটা পাতলা বুনন চটের ছালা। কাজে কর্মে ঘেরাও দিয়ে টানাতে লাগে। বাড়ীর সামনের এই ছোট খাটো কাঁঠাল গাছের ওপরে ছাদের দিক থেকে হয়ত ছালাটাকে ধুয়ে দিয়ে মেলে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে শুকোনোর জন্য। আর কি অদ্ভুত, গাছটাকে ঢেকে ছালাটা আলো আঁধারিতে এমন একটা ছায়া মূর্তির অবয়ব নিয়েছে যেন স্বয়ং অশীতিপর বৃদ্ধ পুলিনবাবু সশরীরে মৃত্যুর পরে ও মরলোক থেকে নেমে এসে ভীষণ এক উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছেন নিজের বাড়ীর দিকে। স্বপন দা হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন, ‘এই নাও তোমার পুলিন বাবুর ভূত। ’ আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এ হেন ঘটনায়। স্বপনদা বলে ওঠেন, ‘কথাটা বলতে ভুলে গেছিলাম । আমি সন্ধ্যার সময় কালি বাজার থেকে এই দিক দিয়ে ফেরার পথে দেখে গেছি বস্তাটা এরা মেলে দিচ্ছিল। কিন্তু এটা যে আবার ও পাশ থেকে লাইট পড়ে এমন অদ্ভুত দেখতে লাগছে, একদম পুলিন বাবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কে জানত বলো? নিজের অজ্ঞতায় নিজেই ভয় পেয়ে যাওয়াতে কেমন বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। আমি একটু স্মার্ট হতে ঈষৎ হাসবার চেষ্টা করলাম, ‘যা ঃ, কি যে ভুল ভাল দেখলাম ।’ স্বপন দা বলে ওঠেন, ‘না ভুল দেখো নাই। ঠিকই দেখেছো । এ হল পুলিন বাবুর নিজের বাড়ীর মায়া ।’ মনে মনে ভাবলাম হতে ও পারে। একটা আধারে এসে মূর্ত হয়ে উঠেছিল হয়ত ওনার আত্মা । অবিশ্বাস্য কি?