মায়া

রবীন্দ্র পল্লী, কলকাতা

ভূশন্ডির মাঠ পেরিয়ে পশ্চিম দিকে খানিকটা এগোলে ঘন জঙ্গল। জঙ্গল মানে বাবলা, শ্যাওড়া, ছাতিম, কদম, বুনো কুল, বাঁশ, তেঁতুল সব জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলাতেও গাছের নিচে  জমাট বেঁধে থাকে ফিকে অন্ধকার। এর ভেতর দিয়েই পায়ে হাঁটা সরু পথ। দিনরাত টুপটাপ ঝরে পড়ে গাছ-গাছালির মরা পাতা। গাঁয়ের মানুষ এই পথ ধরেই জঙ্গল পেরিয়ে নদীর পাড়ে আসে। বোশেখ মাসে মরা স্রোত কালীদহ নদীর। নদীর পাড়ে মহা শ্মশান। শ্মশানের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা  লম্বা লম্বা ঝাঁকড়া  মাথার শ্যাওড়া গাছ।

বোশেখ মাস প্রায় শেষ হতে চলল, কাল বৈশাখীর দেখা নেই এবার । ক'দিন ধরে আকাশ পোড়া রোদ, বাতাসে যেন আগুনের হল্কা। দিনভর হাড়গুলোয় রোদের জ্বালা-পোড়া । বেজায় কষ্ট পেত্নীগুলোর। সন্ধ্যের মুখে মরো মরো আলোয় তিন পেত্নী নদীর পাড়ের লম্বা শ্যাওড়া গাছের মগডালে পা দুলিয়ে হাওয়া খায়। পাশাপাশি বসে গপ্পোসপ্পো করে নিজেদের মধ্যে। আর জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে।

কালীদহ শ্মশানের পেত্নীগুলো সবাই বড়ো পেত্নীকে সমীহ করে, ভালোবাসে মন থেকে। আদতে বড়ো পেত্নী খুব বুঝদার, বড়ো মনের পেত্নী। সকলের সুখে দুঃখে দুটো সুপরামর্শ দেয়। বিপদে আপদে সবাই ছুটে আসে তার কাছে। তাই সবাই সুযোগ পেলে তার সেবা যত্ন করে, কারণে অকারণে হাত-পা টিপে দেয়। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে তখন আওয়াজ ওঠে, খটখট খটখট। বেশ লাগে তার, আরামে চোখদুটো বুজে আসে।

বড়ো পেত্নী পাশে বসা ছোটো পেত্নীর ঘাড়ে হাত রেখে নাড়া দিল। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকির মৃদু আওয়াজ উঠল, খট খট। সস্নেহে বলল, "ছোটো! এত কম বয়সে তুই এখানে এলি কী করে? সারাটা জীবন তোর পড়ে ছিল! এমন দশা হলো কী করে?"

"সে কথা আর বলো না দিদি। সব কিছুর মূলে তো ওই মুখপোড়া মিনসেটা। কী কুক্ষণে যে ওটাকে ভালোবেসেছিলাম!" কপাল চাপড়ায় ছোটো পেত্নী। নাকের জল, চোখের জল মুছে ফের বলল, "আমি একটা বিউটি পার্লারে কাজ করতাম। কাজের শেষে বড়ো লোকের বউরা খুশি মনে বড় বড় নোটে টিপ্স দিত । রোজকারপাতি মন্দ ছিল না।"

"তারপর?"
"তারপর আর কী! আমার কপাল পুড়ল। মিনসেটা বাইক নিয়ে দিনরাত পার্লারের সামনে ঘুরঘুর করত। প্রেমে পড়ে গেলাম। বাইকের পেছনে বসিয়ে মুখপোড়াটা এদিক সেদিক রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে বিরিয়ানি খাওয়াত। মাঝেমধ্যে আদর ভালোবাসাও করত লুকিয়ে চুড়িয়ে। বয়স কম, ভালোই লাগত আমার।"

"ভালোই যখন লাগত, তা বিয়ে করলি না কেন মুখপুড়ি?" বড়ো পেত্নীর কড়া ধমক।

"বিয়ে তো করতে চেয়েছিলাম দিদি। কিন্তু বাড়ি থেকে রাজি হল না। আমরা কায়েত, ওরা নমঃশূদ্র। আমি তখন বদমাশটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ওকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেই পারি না। দুজনে ঠিক করলাম, এই জীবন রেখে লাভটাই বা কী? দুজনে মেট্রোর সামনে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবো এক সঙ্গে। স্বগগে আমাদের দেখা হবে, মিলন হবে সেখানে ।" 

"সে কিরে? একেবারে আত্মহত্যা!"

"আত্মহত্যার দিন ঠিক হল। সেদিন দুজনে পার্ক স্ট্রিটে গেলাম। শয়তানটা অনেক টাকা খরচ করে খুব খাওয়াল সেদিন। দুজনে হাত ধরাধরি করে পার্কস্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে এলাম। ঠিক হল, আমি দমদম যাওয়ার মেট্রোর সামনে ঝাঁপাবো। আর শয়তানটা কবি সুভাষ যাওয়ার মেট্রোর সামনে ঝাঁপাবে। দশ সেকেন্ড আগে দমদম মেট্রো এল। স্বর্গে যাচ্ছি বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।"

বড়ো পেত্নী বলল, "কিন্তু শয়তানটা মেট্রোর সামনে ঝাঁপাল না, তাই তো?"

"একদম ঠিক দিদি। পেত্নী হয়েও মুখপোড়াটার উপর ভালোবাসা আমার কাটলো না গো। ওকে দেখবার জন্য দিনরাত মনটা শুধু আকুলিবিকুলি করে। একদিন দেখি কী, অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে পার্কের গাছের আড়ালে ইন্টুমিন্টু করছে। মাঝে সাঝেই রেস্টুরেন্টে এটা সেটা সাটাচ্ছে দুজনে। শুনছি, সামনের মাসে নাকি বিয়ে করবে মাগিটাকে।"

"তা’ তুই জানলি কী করে?"

"তুমি যতই আমাকে গাল দাও দিদি, মুখপোড়াটা যতই নেমকহারামি করুক, আজও বদমাশটার উপর আমার মায়া যে কাটলো না দিদি। তাই রাতের বেলা ওর ঘরের জানলার পাশের কদম গাছে ঘাপটি মেরে বসে থাকি, শুধু এক পলক চোখের দেখা দেখবার জন্য। সেদিন শুনলাম, ভিডিও কলে মাগিটাকে বিয়ের কথা বলছে, বিয়ের ডেট ফাইনাল করছে দুজনে। শুনে আমি সারা রাত খালি ছটফট করি। এ ডাল থেকে আরেক ডালে লাফালাফি করি। মনে আমার শান্তি নেই গো দিদি।" ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ছোটো পেত্নী।

বড়ো পেত্নী ছোটোর মাথাটা বুকে টেনে নিল। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকিতে আওয়াজ উঠল, খটখট। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "এখন আর কেঁদে কী করবি? মরবার কী দরকার ছিল? মানুষ চিনতে পারিসনি। বোকা কোথাকার! এমন পুরুষ মানুষের জন্য মায়া মমতা হয় কী করে! নিজের জীবন নিজের কাছে অনেক দামি। অন্যের জন্য সে জীবন শেষ করতে নেই।"

এতক্ষণ পাশে বসে মেজো পেত্নী চুপচাপ শুনছিল সব। ছোটোর কাহিনী শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, "মায়া যে বড়ো সর্বনেশে গো দিদি। নিমেষে জীবনটাকে ছারখার করে দেয়।"

বড়ো পেত্নী মেজোর চোখে চোখ রেখে খরখর করে উঠল, "হারামজাদি! তুইও তা'হলে ছোটোর মতো মুখ পুড়িয়েছিস?"

"নইলে কী আর এমন দশা হয় গো দিদি?" আকাশের দিকে মুখ তুলে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে চুপচাপ বসে থাকল মেজো।পরে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, "লোকে বলে, মেয়েরা নাকি ছল চাতুরী জানে, মিষ্টি মিষ্টি কথার জালে পুরুষদের মাথা বিগড়ে দেয়। আমি বলি কী দিদি, পুরুষদের মন ভুলানো কথার জাদুতে কত শত মেয়েদের জীবন ছারখার হয়ে যায়।"

বড়ো পেত্নী ঝামরে উঠল, "মেজো, ছাড়তো এসব জ্ঞানের কথা। কী করে তোর এমন দশা হলো, তাই বল।"

"কোলকাতায় এম এ পড়তে এসে কপাল আমার পুড়লো গো দিদি। আমাদের নিজের বাড়ি থেকে এম এ পড়ার সুযোগ নেই। তাই উঠলাম সোনারপুরে মামার বাড়িতে। প্রথম ছয়মাস বেশ ভালোই কাটল। তারপর মামাতো দাদা সুমনের কুনজর পড়ল আমার উপর। আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো । এম এ পাশ করে বেকার। দু'চারটে টিউশন করে নিজের হাত খরচা চালায়।"

"তারপর?"
"তারপর যেমন হয় আর কী। পড়া দেখানোর ছুতোয় গায়ে হাত দিতে শুরু করল। শরীরের অলিগলিতে হাত বুলাতো। জোর করে একদিন জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বসল।"

"তুই কিছু বলিসনি? বাঁধা দিসনি ওকে?"

"বলিনি আবার! সুমন আমাকে সত্যি খুব ভালোবাসতো গো দিদি। বারবার বলত, একটা চাকরি পেলেই আমাকে বিয়ে করবে। এই বাড়ি থেকে অনেক দূরে আলাদা থাকবে। আমিও বিশ্বাস করতাম ওর কথা। খুব মায়া পড়ে গেল ওর উপর। আমিও  মন থেকে খুব ভালোবাসতাম ওকে। তখন দিন রাত আমার মন, আমার শরীর জুড়ে থাকত শুধু সুমন। বুঝতে পারলাম, ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।"

"তারপর কি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলি?"

"না গো দিদি। দু'দিনের জন্য মামা আর মামি আসানসোল গেলেন। মামির ভাইপোর বিয়ে। বাড়িতে শুধু আমি আর সুমন। সেদিন সন্ধ্যার পর সোনারপুরে তুমুল ঝড় আর বৃষ্টি। ঝড়ের তান্ডবে লাইট চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার সারা বাড়িতে। বিকট আওয়াজ করে বাড়ির সামনের মাঠের ধারের তালগাছে বাজ পড়ল হঠাৎ। আমি ভয়ে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলাম সুমনকে।"

"তারপর?"

"সুমন আদরে আদরে আমাকে পাগল করে তুলল। আমিও জ্ঞানহারা হয়ে ভুলে গেলাম সমাজ, সংস্কার, আত্মীয়-স্বজন, নিজের ভবিষ্যৎ, সব কিছু। সুমনের বুকে সপে দিলাম নিজেকে। সেই রাতে পরপর দু'বার একাত্ম হলাম আমরা।"

বড়ো পেত্নী বিস্ফারিত চোখে শিউরে উঠল, "শরীরের আটঘাট না বেঁধে সব কিছু দিয়ে দিলি হারামজাদি?"

"ওতেই তো আমার মুখ পুড়ল গো দিদি। ক'দিন যেতে না যেতে, সারা শরীরে জ্বালা পোড়া, মুখে খাবার রোচে না, বমি বমি ভাব। বুঝলাম, সর্বনাশ হয়েছে আমার। বাড়ির বাইরে সুমনকে খুলে বললাম সব।"

"হতচ্ছাড়াটা বুঝি অস্বীকার করল সব?"

"না দিদি। ওর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না। চাকরি নেই, হাতে টাকা পয়সা নেই। পাগলের মতো ছটফট করছিল খুব । শেষে আমিই বললাম, এবোরশন ছাড়া তো অন্য কোনো উপায় নেই। টাকা পয়সা জোগাড় করো, যত তাড়াতাড়ি পারো।"

"শেষে এবোরশন করতে হলো?"

"হলে তো ভালোই হতো দিদি। হলো কোথায়? মামির চোখে ধরা পড়লাম। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। গায়ে খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে চাপা গলায়  হিসহিস করে উঠল, “মুখপুড়ি! কে করল এমন সর্বনাশ? নামটা বল।"

"বলে দিলি নামটা?"

"মায়া, বড়ো মায়া হল দিদি ওর উপর। ওর সর্বনাশ করতে মন সায় দিল না। সেই রাতে বাড়ির পেছনের জামরুল গাছের ডালে ওরই দেওয়া সালোয়ারের ওড়না গলায় জড়িয়ে ঝুলে পড়লাম।" ডুকরে কেঁদে উঠল মেজো পেত্নী। চোখের জলে বুক ভিজে একাকার।

বড়ো পেত্নী মেজোকে বুকে টেনে সারা গায়ে স্নেহ আর ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকির মৃদু আওয়াজ, খটখট। চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে ভেজা গলায় বলল, "মানুষের জীবন একটাই। এমন করে কেউ সেটা শেষ করে? পাগলী কোথাকার! আজ যতই চোখের জল ফেল না কেন, সেই জীবন কি আর ফিরে পাবি?"

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেজো পেত্নী বলল, "আজও যে ওকে ভুলতে পারছি না দিদি। সব সময় ওকে দেখতে মনটা হাহাকার করে। এইতো দু'মাস আগে ওর গায়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে চাকদায় গিয়ে হাজির হলাম। সাত মাস আগে চাকরি পেয়ে চাকদায় থাকে আজকাল। ইস্কুলের টীচার হয়েছে। নিজে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়। বড়ো কষ্ট, চোখে দেখা যায় না।"

"বিয়ে শাদি করছে না কেন? পথের কাঁটা তুই তো সরেই গেছিস।"

"এইসব জানবার জন্য ওর ভাড়া বাড়ির জানলার ধারের ছাতিম গাছটায় দুই রাত ঠায় বসেছিলাম। মোবাইলে হররোজ কথা বলে পাশের ইস্কুলের এক আইবুড়ি দিদিমনির সঙ্গে। ফষ্টিনষ্টি করে। শুনলাম সামনের মাঘে ওদের বিয়ে।" একটু থেমে মেজো আবার ডুকরে কেঁদে উঠল, "আমার সুমন আমার আর থাকবে না গো দিদি। পর হয়ে যাবে। ওর জন্য আমার যে এত ভালোবাসা, তার কি হবে গো দিদি?"

বড়ো পেত্নী ধমক দিয়ে উঠল, "চুপ কর মেজো। পাগলামি করিস না। ওকে এবার ভুলে যা।"

এতক্ষণ চুপচাপ বসে সবকিছু শুনছিল ছোটো পেত্নী। হঠাৎ মেজোর দিকে তাকিয়ে খরখর করে উঠল, "কিছু মনে করো না  মেজদি। তোমার মরোদটা আমার শয়তানটার চেয়েও বেশি বদমাশ। কেন বাপু, তোমরা দুজন শিক্ষিত মানুষ। বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরে কোথাও গিয়ে সংসার পাততে পারতে। দুজনে দু'বেলা টিউশন করেও তো দুটো ডালভাত খেয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারতে। আসলে এগুলো একেকটা ম্যাদামুখো শয়তান। দেখলে গা জ্বলে যায়।"

দাবড়ে উঠল বড়ো পেত্নী, "আহঃ ছোটো! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে কেন দিচ্ছিস? সব যখন শেষই হয়ে গেছে, কী লাভ এখন এসব বলে? চুপ কর।"

শ্মশান জুড়ে নেমে এসেছে ঘন কালো রাত। মাঝে সাঝে নদীর দিক থেকে বয়ে আসে দমকা বাতাস। দক্ষিণ আকাশ থেকে একখানা কালো মেঘ উড়ে গেল উত্তর দিকে। অকারণে একটা শকুন ডেকে উঠল শ্যাওড়া গাছের মাথায়। বাঁশ ঝাড়ের নিচে গোটা চারেক শিয়ালের তুমুল দাপাদাপি। তেঁতুল গাছে একজোড়া পেঁচার চোখ  জ্বলজ্বল করে ওঠে।

এর মধ্যে পুরোপুরি ধাতস্থ হয়েছে মেজো পেত্নী। বড়ো পেত্নীর দিকে তাকিয়ে বলল, "আমাদের দু'জনের দুঃখের কাহিনী তো শুনলে বড়দি। তা' তোমার এমন দশা হলো কী করে?"

"তোরা হয়তো আজ বিশ্বাস করবি না আমার কথা, খুব সুখের সংসার ছিল আমার। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ, দেওর কেউ ছিল না সংসারে। শুধু আমি আর আমার মানুষটা। মানুষটাও ছিল নিপাট ভদ্রলোক। আমার কথায় ওঠবস করত । খুব ভালোবাসত আমাকে, আমি পাশে না শুলে ঘুম আসত না তার। দু'দিনের জন্য বাপের বাড়ি যেতে চাইলে মন ভার করে বসে থাকত, ছেলেমানুষের মতো কথা কইতো না।" চোখদুটো ভারী হয়ে এল বড়ো পেত্নীর। গলা ধরে এল। শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল হঠাৎ।

মেজো পেত্নী বলল, "এমন সুখের সংসার ফেলে এখানে এলে কী করে?"

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়ো পেত্নী বলল, "পোড়া কপাল আমার। সুখ সইলো না কপালে । একদিন রান্না করতে গিয়ে স্টোভ ফেটে আগুন ধরল আমার কাপড়ে। দাউদাউ করে জ্বলছি। বাড়িতে কেউ নেই। মানুষটা অপিসে। বাঁচানোর কেউ নেই-----"

কথা শেষ করবার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল বড়ো পেত্নী। কাঁদতে কাঁদতে বলল, "এতো দিনের সংসার, মানুষটাকে ভুলি কী করে! বড়ো মায়া । তাই প্রায় দিন রাতের বেলা মানুষটার কাছে যাই। দুটো কথা বলি। খুব কষ্টে আছে। রান্নাবান্না করেনি কোনোদিন। হোম ডেলিভারি খায়। পেটের অসুখে ভোগে। কাঠির মতো চেহারা হয়েছে মানুষটার । চোখে দেখা যায় না।"

ছোটো পেত্নী পাশ থেকে বলল,"পুরুষ মানুষদের দিয়ে কী আর রোজ রান্নাবান্না হয়? অফিস করবে, না ঘরের কাজ করবে? বড়দি, জামাইবাবুকে এবার একটা বিয়ে করতে বলো ।" 

"সে কি আর বলিনারে ছোটো! হররোজ তো সেই কথাই বলি। রাজি হয় না। বলে, আমাকে নাকি আজও ভুলতে পারেনি।" চোখের জল মুছে ফের বলল বড়ো পেত্নী, "কাল খুব করে বুঝালাম। বললাম, পৃথিবীতে সবার একটাই জীবন। সবাই মরবে একদিন না একদিন, কেউ আগে, কেউ পিছে। একা একা বেশি দিন বাঁচা যায় না। যতদিন বেঁচে আছো, ভালো করে বাঁচো ।"

"শুনে কী বলল?"

"অনেক বলাতে কাল খুব কাঁদল আমার সামনে। আমার জন্য মানুষটার মনে আজও বড়ো ভালোবাসা । যতই হোক, সব কী আর ভুলে যাওয়া যায় রে! অনেক জোড়জার করাতে কাল রাজী হয়েছে বিয়ে করতে। সামনের শীতে বিয়ে করবে।"

মেজো পেত্নী বড়ো পেত্নীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কাল খুব কষ্ট পেয়েছো না গো দিদি?"

"কষ্ট যে হয়নি, মিছে কথা বলবো নারে মেজো।কষ্ট হলেও আমি চাই, বিয়েথা করে মানুষটা ভালো থাকুক। বড়ো ভালোবাসি মানুষটাকে। ওর কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না।" ফের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বড়ো পেত্নী।

মেজো পেত্নী বড়ো পেত্নীর গায়ে মাথায় ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল । হাড়ে হাড়ে মৃদু ঠোকাঠুকি লেগে আওয়াজ উঠল, খটখট।
রাত গভীর এখন। নিশাচর পাখিরা এগাছ থেকে সেগাছে ওড়াউড়ি করে। দুটো শেয়াল শুকনো পাতার খচরমচর শব্দ করে হেঁটে যায়। গাছ-গাছালি থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে টুপটাপ। তিতকুটে কুল গাছে এক ঝাঁক বাদুড় দাপাদাপি করে মনের সুখে।

তিন অশরীরী আত্মা চুপচাপ গাছের ডালে বসে হওয়া খায়। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফেলে আসা পৃথিবীর দিকে। তিন জনের মনে অতৃপ্ত বাসনা, সেই জীবনটা যদি আরেকবার ফিরে পাওয়া যেত!

বৈশাখী ২০২৪