সন্ধ্যাবেলার যাত্রাপথে

নিউ জার্সি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র

কুসুমপুর যাবার বাসটা ধরার জন্য বাস স্টপে এসে দাঁড়ালাম। অনিমেষের চিকেন পক্স কমে গেলেও ওর শরীর দুর্বল। তাই আমার সাথে ফিরলে বাড়ির লোকের চিন্তা কম। আমিও নতুন একখানা জায়গায় ঘুরে আসার আনন্দে অফারটা ফেললাম না। 
 
শুক্রবার সন্ধ্যায়, কলেজের পর,  দুদিনের জন্য রওনা দিলাম কুসুমপুরের পথে। হাওড়া থেকে প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ। হাওড়ার বাইরে এই বাস স্টপটা একটু বেশিই ফাঁকা। রাস্তার সবেধন নীলমণি একখানা টিমটিমে আলো গা ছমছমে ভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা শরীরে। কখন যে বাসটা আসবে সেই কথাই ভাবছি। এমন সময় একটা চার্টার্ড বাস দাঁড়াল। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে হেল্পার দুবার হাঁকল "কুসুমপুর, কুসুমপুর।” চমক ভেঙ্গে এক লাফে উঠে পড়লাম বাসে। বাসটা ছেড়েও দিল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে। যদিও এই গরমে জানলার পাশে বসাটাই দরকার ছিল, কিন্তু গাড্ডা ভর্তি রাস্তায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলা বাসটা আমায় আর বেশিদূর যেতে দেয়নি। প্রাণ ভয়ে প্রথম সিটেই বসে পড়লাম, যদিও সেটা জানলার ধারে নয়। বসতেই আমার পাশে বসা ভদ্রলোককে দেখে আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। প্যাচপ্যাচে গরমে ঘেমে নেয়ে আমি অস্থির। এই ভদ্রলোক গায়ে একটা শাল আর মাথায় মাংকি ক্যাপ চাপিয়ে বসে আছেন। ওনাকে দেখে যেন আমার আরো গরম বোধ হচ্ছে। আমি বললাম, "ও দাদা শুনছেন?" 

ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরলেন। বাসের ভিতরটা অন্ধকার, হয়তো সবে সন্ধ্যে হচ্ছে বলে এখনও আলোগুলো জ্বালায়নি। তার মুখটাও ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। কোনো উত্তর না দিয়ে আবার তাকালেন তিনি জানলার দিকে। কিরকম একটা ফ্যাসফেসে গলায় ভদ্রলোক বললেন, "কি হয়েছে?"
আমি বললাম, "আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ঠান্ডা লাগছে, আমার আবার উল্টো। একেবারে ঘেমে নেয়ে গেছি গরমে। তাই যদি কিছু মনে না করেন, আমায় বরং জানলার ধারটা দিননা। আপনি এদিকটা বসুন।"
ওনার উত্তরটা শুনে ভারী অবাক হলাম, "জানালার ধারটা খুব একটা নিরাপদ নয়।" 
এই কথা বলে আবার জানালার দিকে ফিরলেন ভদ্রলোক। ভীষণ অবাক হলাম। নিরাপদ নয় তো উনি কেনই বা বসেছেন? কথাটা ঠিক বোধগম্য না হওয়ায় ভাবছি ওনাকে জিজ্ঞাসা করব ঠিক কি বলতে চাইলেন। তখনি কন্ডাক্টরের গলা, “ও দাদা টিকেটটা দেবেন।”
 
কন্ডাক্টরকে দেখে একটু অবাকই হলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে বাসে ওঠার সময় অন্যজনকে দেখেছিলাম। কন্ডাক্টারের দিকে তাকিয়ে হাতে ধরে থাকা একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলাম। তিনি খুচরো টাকাটা ফেরত দিতে দিতে বললেন, "ঘামছেন দেখছি, তাহলে জানালার ধার ফাঁকা থাকতেও এদিকে কেন বসেছেন?" 
 
আমি শিউরে উঠলাম, জানালার ধার ফাঁকা কী করে হল? জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি আমার পাশের সিটটা খালি। এটা যে কী  করে সম্ভব বুঝে উঠতে পারলাম না। আর তখনি পিঠের ওপর কে একটা হাত রাখল। আমি কেমন একটা কেঁপে উঠলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। তারপর পিছন ফিরে দেখলাম, সেই ভদ্রলোক কখন যেন পিছনের সিটে গিয়ে বসেছেন। সিটের লেগস্পেস ভীষণ কম, কাজেই উনি আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে থাকলে আমাকে স্পর্শ না করে বেরোনো অসম্ভব। সেক্ষেত্রে আমার বুঝতে পারা উচিত ছিল। টিকেট কাটায় আমি এতই মশগুল ছিলাম যে এতকিছু খেয়ালই করলাম না? উনি কি হঠাৎ করে টপকে পিছনে চলে গেলেন? ধীরে ধীরে জানলার ধারে সরে গেলাম, তবে বুকে একটা কাঁপন ধরেছে তা টের পেলাম। 

তখনো বুঝে উঠতে পারছিনা কুসুমপুর সেখান থেকে আর ঠিক কতদূরে। ছটফটানি হচ্ছিল, আসলে একটু আগের অবাক করা ঘটনাটা মনে একটা শিরশিরানি ভাব তৈরি করেছে, মূলত  বাসের ভিতরে আলো কম বলেই হয়তো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ম্যাপটা দেখার চেষ্টা করলাম। লোকেট করার চেষ্টা করলাম জায়গাটাকে। আর তাতে যেটা ঘটলো তা আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ম্যাপে কারেন্ট লোকেশন দেখতে গেলেই দেখাচ্ছে, “লোকেশন কুড নট বি ফাউন্ড।” তক্ষুনি কী মনে হল, ফোনটা তুলে ডায়াল করতে গেলাম অনিমেষকে। হঠাৎই আমার মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে গেল। মানুষের মনে যখন কোনো ভীতি আশ্রয় নেয়, তখন আনুষঙ্গিক যেকোনো কিছুতেই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে সে। আমারও এখন যেন সেই অবস্থা। একটা শহরতলীর ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বাসটা চলেছে। অতএব মোবাইলে নেটওয়ার্ক চলে যাওয়াটা আহামরি কিছু নতুন ঘটনা নয়। অথচ এই অতি তুচ্ছ ঘটনাই যেন আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নামাল একটা ঠান্ডা স্রোত, আমার মন বলে উঠল কেউ যেন আমার বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগটা এই মুহূর্তে পছন্দ করছেনা। 
 
গন্তব্যে পৌঁছনোর একটা অদম্য তাড়া অনুভব করলাম মনের ভিতরে। ঘড়িটা দেখে বুঝলাম প্রায় কুড়ি মিনিট হয়ে গেল আমি বাসে উঠেছি। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, বাসটা কিন্তু কোথাও থামেনি। কোনো যাত্রী নামছে না, কেউ উঠছে না। কন্ডাক্টর যেন খানিক নির্জীব। পাথরের মতন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাসের ভিতরটাতে কখন যে দু-একটা টিমটিমে আলো জ্বলে  উঠেছে, এতক্ষণ ঠাওর করে উঠতে পারিনি। আগে যে অন্ধকারটা ছিল, তার তুলনায় এই টিমটিমে আলোটা যেন একটু বেশী গা ছমছমে, একটা অজানা ভয়ের সৃষ্টি করছে। তার কারণ, আমি যেন কোন অবস্থাতেই আমার সে সহযাত্রীর মুখ দেখতে চাইনা। আমার মন বলছে তার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কোনো এক রহস্য, যার জট খুললে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে ভয়ঙ্কর কোনো অভিজ্ঞতা। পরিবেশটা যেন কেমন দম বন্ধ করা। হঠাৎ একটা গলার শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো একজন লোক জিজ্ঞাসা করছেন, "দাদা আপনার পাশের জায়গাটায় বসব?"
 
ভাবলাম বলি, ‘সে তো আপনার ব্যাপার’, যদিও আমি এটাও বুঝতে পারছিনা যে উনি হঠাৎ নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে আমার পাশে কেন বসতে চাইছেন। তাকিয়ে বললাম, "নিশ্চয়ই বসবেন।"

তখনি অবাক হয়ে দেখলাম এই ভদ্রলোকের গায়েও একটা সোয়েটার। এবার আমি সত্যি ভীষণ বিস্মিত হচ্ছি। একবার চতুর্দিকটা তাকালাম। কয়েকটা জিনিস আমার বেশ অদ্ভুত ঠেকছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমি যখন বাসে উঠেছিলাম, তখন প্যাসেঞ্জাররা যে যেখানে বসেছিল সে সেখানে নেই। কেমন যেন একটা ওলোট পালট হয়ে গেছে। বাসে উঠেছিলাম যখন, তখন এক পলকেও তো কাছাকাছি সিটের লোকগুলোকে দেখা যায়নি। তখনি খেয়াল হলো বাসে যখন উঠেছিলাম তখন হালকা হলেও আলো জ্বলছিল। কখন হুট্ করে আলোগুলো নিভে গেছিল সেটা আমি খেয়াল করলাম না কেন? আরো অদ্ভুত একটা কথা খেয়াল করলাম। বাসে ওঠার সময় কাছের সিটগুলো খালিই ছিল, পেছনদিকটা ছিল ভর্তি। আর এখন হঠাৎ লোকগুলো সামনের দিকে সরে এলই বা কেন? সব কিরকম বিস্ময়কর ঠেকছে। আমার কি কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে? অদ্ভুত! প্রত্যেক যাত্রীর গায়েই যে হালকা গরম জামা সেটা প্রথমে খেয়াল করিনি। এবার আমি যেন একটু ঘাবড়ে গিয়েই উঠে দাঁড়ালাম। তারপর পেছন ফিরলাম, পেছনের সিটের ভদ্রলোককে আরেকবার দেখব বলে। সমস্ত আতঙ্ককে তুচ্ছ করে অদম্য কৌতূহলে ছাড়াতে চাইলাম অজানা রহস্যের জট।। কিন্তু পেছনের সিটে কেন, গোটা বাসেই আমি তাকে আর দেখতে পেলামনা। আমার পাশে বসা ভদ্রলোক যেন একটু অবাক হয়েছেন। বললেন, "কী হয়েছে দাদা?" 

আমি বললাম, "আমার পাশে একটু আগে যিনি বসেছিলেন তাকে দেখেছেন?" 

ভদ্রলোক হাসলেন, সে হাসিটা যেন কেমন। সাধারণ মানুষের মতন নয়। তারপর বললেন, "এই সিটে যে বসেছিল সে তো আর বেঁচে নেই, তাইতো আমি এগিয়ে এলাম।" 

আমি শিউরে উঠলাম। কী বলছেন কী ভদ্রলোক? আমি যে স্পষ্ট দেখেছিলাম সেই সারা গায়ে শাল জড়ানো ভদ্রলোক। আমি সেকথায় আর গেলামনা। বরং জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি সোয়েটার পরে আছেন, আপনার কি ঠান্ডা লাগছে? আমার তো বেশ গরম লাগছে। তাছাড়া এপ্রিল মাসে তো আর ঠান্ডা থাকেনা!"

ভদ্রলোক আবারও হাসলেন। সেই হাসির দোসর হয়ে সাথে যোগ দিলো একটা বিকট শব্দ। শব্দটা এমন যে আমার মজ্জা অবধি জমে বরফ হয়ে গেল এ শব্দ মনুষ্য সৃষ্ট নয়, হতে পারে না। আমার কি আজ তাহলে সঙ্গী হয়েছে একাধিক অশরীরী? এবারে হঠাৎ করে যেটা আমার চোখে পড়ল, তা দেখে আমার পা দুটো যেন টলে উঠলো। এ দৃশ্য হজম করবার মতন মনের জোরের অধিকারী নই আমি।  বাসের বাইরে থেকে হয়তো কোনো পোস্টের আলো বাসের মধ্যে পড়ে ভদ্রলোকের মুখটা ঝলমলে করে দিল। সেই হঠাৎ আসা আলোয় আমি দেখলাম ভদ্রলোকের সারা মুখে রক্ত। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর যেটা তা হল, তার গলায় ঢুকে রয়েছে একটা টিনের মতন ধারালো কিছু। তার তলাটাও রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার মধ্যে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই, অথচ এই মাত্র তার সাথে আমি কথা বলেছি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমি যাকে দেখছি সে মানুষ নয়, হতে পারেনা। এ কোনো অশরীরী। ভদ্রলোক এখন নিথর।  তাকে ভদ্রলোক না বলে, একটা দেহ বলা যায়, একটা ক্ষতবিক্ষত শরীর। আমি দুহাতে চোখ ঢেকে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলাম। আমার পাশে যিনি খানিকক্ষন আগে বসে থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছিলেন তিনিও কি তাহলে …? তার মুখ যে আমি তেমন করে দেখতে পাইনি। আর কিছু ভাবার মতো শক্তি আমার ছিলোনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার  মতন ঠিক তখনি কেউ বাসের মধ্যে থেকে বলে উঠলো, "বলেছিলাম না, জানালার ধারটা নিরাপদ নয়? জানালার ভাঙা টিন গলায় বিঁধে গেল যে।"

এ গলা আমার চেনা। একটু আগের সেই ভদ্রলোক, যিনি কিনা সেই আপাদমস্তক চাদর ঢেকে আমারই পাশে বসেছিলেন। বাসের চতুর্দিকে চোখ ফেরালাম, তাকে কোথাও দেখতে পেলামনা। এক লাফে বেরিয়ে এলাম সিট ছেড়ে আর্তনাদ করে। আমি এবার উন্মাদের মতো বাসের সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। কিন্তু বাস থেকে নামার আমার উপায় নেই। বাসটা তীর বেগে ছুটে চলেছে। কানে তখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই বিকট হাসি। আমি দৌড়াতে গিয়েই হোঁচট খেলাম কিছুতে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাটিতে শুয়ে রয়েছে আপাদমস্তক শালে মোড়া একটা লোক, ইনি যে এ বাসের আমার প্রথম সহযাত্রী তা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই আর। সেই অবস্থার মধ্যেও মোবাইলের টর্চটা জ্বালালাম। মানুষটার মুখে আলো ফেলতেই শালের একটা খালি অংশ থেকে দেখতে পেলাম, সেই শালে মোড়া দেহটা কোনো মানুষের দেহ নয়, একটা নরকঙ্কাল। আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই আমার করার ছিল না। কন্ডাক্টারকে হাত বাড়িয়ে ডাকতে গেলাম। দেখলাম তার শরীরটা বাসের দরজার উপর এলিয়ে পড়েছে। একলাফে দৌড়ে গেলাম ড্রাইভারের কেবিনের দিকটা। কিন্তু এ আমি কী দেখছি? স্টিয়ারিংয়ে কারোর হাত নেই। যে লোকটা সিটে বসে রয়েছে, তার কোমরের কাছ থেকে শরীরের বাকি অংশটা স্টিয়ারিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। তার হাতদুটো ঝুলে রয়েছে শরীরের দুপাশে। শরীরে চাপ বাঁধা রক্তের দাগগুলো এই আধো আলোতেও বোঝা যাচ্ছে। বাসটা তখনো চলছে। আমি এতক্ষণে বুঝতে পারছি, আমিই সম্ভবত এই  বাসে একমাত্র জীবন্ত মানুষ। আতঙ্কে আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে পিছন ফিরলাম। বিকট হাসির আওয়াজে আমার কান প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। হঠাৎ সে আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে গেলো কয়েকটা বুকচেরা আর্তনাদে। কারা যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে, চিৎকার করছে। সমস্ত আরোহী এবারে উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা দল বেঁধে এগিয়ে আসছে আমারই দিকে। যারা আসছে তারা কেউ মানুষ নয়। আমার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে কয়েকজন নরকঙ্কাল। আসন্ন মৃত্যুভয়ে চোখ বুজলাম আমি। মাথাটা ঘুরছে। তবুও বাঁচার শেষ চেষ্টায় চোখ খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। চোখদুটো যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। চতুর্দিকে ঘন কুয়াশা। পাগলের মতন দুহাতে কান চেপে ধরে বাসের দরজার দিকে এগোলাম। বাসের ভিতর এখনও টিমটিমে আলো জ্বলছে। আর আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো নরকঙ্কাল, আমার কানে বাজছে শুধু তাদের কান্না। এক ঝলকে হঠাৎ যেন ফিরে এল মিশমিশে কালো অন্ধকারের আচ্ছাদন। আমি বোধহয় জ্ঞান হারাচ্ছি।

"ও দাদা টিকিটটা দেবেন?” -  কেউ হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে যেন জ্ঞান ফিরে পেলাম। চোখ মেলে কেঁপে উঠলাম। কন্ডাক্টরের সাথে কথা বলতে গলা কেঁপে গেল। ইনি সেই লোকটা নন। বললাম, "আ..আপনি…"
তিনি কিরকম অবাক চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, "হ্যাঁ, আমি ছাড়া তো আর টিকিট কাটার লোক নেই। এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন তাই ডাকিনি।  কিন্তু সামনে কুসুমপুর আসছে যে।  আপনি নামবেন তো নাকি?"
আমি কি তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলাম? কিন্তু বাসে ওঠার পর থেকে যে সেই ঘটনাগুলোই ঘটলো শুধু? এখন যেন মনে হচ্ছে আমি অন্য একটা বাসে।  বাসে যখন উঠেছিলাম তখনও কি এনাকে দরজায় দেখেছিলাম? মনে করতে পারছিনা ঠিক। হঠাৎ খেয়াল করলাম কন্ডাক্টরের ডানহাতটা হালকা হালকা কাঁপছে।  আর সেই হাতের অনেকখানি অংশ প্লাস্টার করা।  জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনার হাতে কি হয়েছে দাদা?"

"আর বলবেন না। সে কথা যত কম মনে পড়ে ততই ভালো। এই বাসটা বিরাট এক্সিডেন্টের খপ্পরে পড়েছিল গত জানুয়ারি মাসে। আমি সামনের দরজায় ধাক্কা খেয়ে একেবারে হাত ভেঙে, মাথা ফেটে যা তা অবস্থা। তবু তো বাঁচলাম বলে আবার সেই একই বাসে ডিউটি করছি, খেয়ে পরে রয়েছি। তবে সেদিন ছিলাম হেলপার, এখন কন্ডাক্টর। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর নিয়ে কত লোক যে মারা গেল। এই আপনার সিটেই তো বোধহয় একজনের গলায় রড ঢুকে…. সে যে কি বীভৎস দৃশ্য, ভাবা যায়না। ছাড়ুন সে কথা, ভাবলেই কিরকম হয়ে যাই। "
 
আমি কুসুমপুর নামলাম একটু বাদে। অনিমেষ দাঁড়িয়ে ছিল বাস স্ট্যান্ডে। ওর হাতটা ধরে অনেকক্ষণ বাদে হাসি ফুটলো আমার মুখে। এই সন্ধ্যেটার কথা আমিও যেন ভুলে যেতে চাই।

বৈশাখী ২০২৪