অব্যক্ত

বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

আজ সকাল থেকেই ভয়টা আবার মনের মধ্যে বেশ ঝেঁকে বসেছে। শুধু সকাল থেকেই বা বলছি কেন! বেশ কয়েকদিন থেকেই তিয়াসা আর নিজের মধ্যে নেই। সবসময় অন‍্যমনস্ক। কথায়, কাজে ভুল, রান্নায় নুন থাকছে না, এক জিনিস আনতে গিয়ে অন‍্যটা নিয়ে আসছে, ডাকলেও দু তিন বারে সাড়া দিচ্ছে। এসব তো হামেশাই ঘটছে। এমন কী খাবারেও মন নেই তার। এই যেমন আজ সকালেই খেতে বসে অনির্বাণের সঙ্গে একপ্রস্ত হয়ে গেল। এমনিতেই ওদের বেরোনোর তাড়া ছিল! তার উপর...

"ওকী! একদমই যে কম খেলে! আর একটু খাও।  রাস্তাতেও কিছু খাও না..."
"জোর করো না গো। বমি হয়ে যাবে..."
"হুম, জানি তো তোমার দৌড়। কেন যে তোমার মাথায় এসবের ভূত চাপল। ভালোই তো ছিলে, খাচ্ছিলে দাচ্ছিলে ঘুমোচ্ছিলে, ঘরের কাজকর্ম করছিলে। সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় আর কী! কী যে কান্ড করবে গিয়ে, কে জানে?" খাবার চিবতে চিবতে অনির্বাণ কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তিয়াসাকে।
তিয়াসা ভাতের থালা ফেলে উঠে গেল। বুকান বলল, "বাবা, কেন তুমি মায়ের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলো। একটু সাহস তো দিতে পারো। জানোই তো মা টেনশনে থাকলে এমন হয়।"
"যা পারে না, তা করতে যায় কেন? ঘরে থাকলেই তো পারে। তোর মা কী পারে, আর না পারে, আমার সব জানা হয়ে গেছে।"

তিয়াসা হাত ধুয়ে ঘরে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বলল,"এখনও সময় আছে। যাবে কি যাবে না বলে দাও?"
তিয়াসা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। সকাল থেকে গলার কাছে একটা পুঁটলির মতো হয়ে আছে। ঢোঁক গিলতেও যেন ভয় হচ্ছে! সকলের সামনে নিজেকে প্রমাণ করবার, নিজেকে মেলে ধরবার সাহস কোনদিনই কি তার হবে না? সেই ছোট্ট বেলা থেকে বাইরের লোকজন দেখলে নিজেকে কেন্নোর মতো গুটিয়ে রাখে সে। কথা বলতে যেন গায়ে জ্বর আসে। যখন স্কুলে পড়ত, ক্লাসে স‍্যার পড়া ধরলে নাকানি চোবানির শেষ থাকত না। স‍্যার ছাড়বেন না আর সে কিছুতেই বলতে পারবে না। এজন্য তাকে কম অপমান হতে হয়নি। অথচ লিখতে দিলে সবকিছু সে ভারী সুন্দরভাবে লিখে দিত। এমন কী, তার মতো ভালো লিখতে হয়তো অনেকেই পারত না। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই অক্ষমতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তাকে অতিক্রম করার শক্তিটুকু আজও সে অর্জন করতে পারল না। শুধু তাই! সে ভালো গাইতে পারে। কিন্তু কোনদিনই সে স্টেজ পারফর্ম করার সাহস পেল না। তার কি ইচ্ছে হয় না, সবার মতো  কিছু না কিছু করতে? সবার সঙ্গে হাসি, গল্প, আড্ডার মধ্যে দিয়ে সময় কাটাতে? হয়, সবার মতো তারও ইচ্ছে হয়। কিন্তু ঐ যে! তার চাওয়া আর না পারার ফারাক ক্রমশ বাড়তেই থাকে। না পারার ভয় ক্রমশ তাকে ঘিরে ধরতে থাকে। বন্ধু বান্ধবও সেরকম নেই। কখনও যে হয়নি তা নয়। তবে দীর্ঘস্থায়ী নয়। সে বরাবরই অন্তর্মুখী। ভালো করে কথা সে বলতে পারে না। কে আর তার সঙ্গে যেচে পড়ে সম্পর্ক রাখতে যাবে? 

            অনির্বাণের সঙ্গে বিয়েটা তার হঠাৎই হয়েছিল। যখন সে তার হাত ধরে নতুন সংসারে এল, এখানেও তাই। নতুন লোকজন, নতুন জায়গা ভয়ে সে সবসময় কুঁকড়ে থাকে। সবাই বলে এ কেমন বৌ আনলে তোমরা। একদমই মিশতে জানে না। সবার সঙ্গে মিলমিশ করে থাকবে কেমন করে? কেউ বা ভাবে অহংকারী। তিয়াসা সহজ হতে চায়। কিন্তু কী বলবে? বুঝে পায় না। কখনও কথা ঠোঁটের আগায় এসেও আটকে যায়। কী জানি তার কথা কে কিভাবে নেবে! যদি হিতে বিপরীত হয়! ক্রমে অনির্বাণের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হতে হতে একটা মিষ্টি সম্পর্কের সূচনা হয়। একটু প্রাণে যেন হাওয়া লাগে। তার মধ্যে একটা নতুন বন্ধু খুঁজে পায়।

        পড়াশোনা করতে তার বরাবর ভালোই লাগত। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ডিগ্রি তার সেই গ্র‍্যাজুয়েশানেই আটকে থাকে। শ্বশুরবাড়িতে আসার পর অনির্বাণের সহযোগীতায় আবার পড়াশোনা শুরু হয়। 
কিন্তু ওই যে এখানেও সমস্যা। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে তার মতামত সে জাহির করতে পারে না। 
অনির্বাণ তার মন বোঝে, সত্যিই তাকে ভালোবাসে। মাস্টার্স করার পর অনির্বাণ ওকে স্কুল সার্ভিস কমিশনে বসার পরামর্শ দেয়। বাড়ির অমতে হলেও অনির্বাণের ইচ্ছার জোরে সে পরীক্ষায় বসে। উৎরেও যায়। কিন্তু ওই যে ইন্টারভিউতে! ছোটবেলা থেকে যে ভীতি! না বলতে পারার ভয়! নিজেকে মেলে ধরার সাহস সঞ্চয় করবার জন্য, বাড়িতে সে অনবরত মহড়া দিয়ে যায়। অনির্বাণ তাকে প্রাণপণ সাহায্য করে, এই ভীতি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার। তিয়াসা ঠাকুরের কাছে মনে মনে কত প্রার্থনা করে, যেন সে সব ঠিকঠাক বলতে পারে, ঘাবড়ে না যায়! কিন্তু কিসের কী! ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের প্রশ্নের সামনে সে মুখই খুলতে পারে না। সবকিছুই জানে, অথচ কে যেন তার মুখটা সেলোটেপ দিয়ে আটকে দিয়েছে। মাথার মধ্যে একটা দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ হতে থাকে। আজ সব ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো যেন দিনের বেলাতেই একসঙ্গে ডাকতে শুরু করেছে। যেন সামনে বসা প্রতিটা মুখ তার দিকে ভয়ংকরভাবে তেড়ে আসছে। 
"এ তো দেখছি মুখই খোলে না! ক্লাস কন্ট্রোল করবে কীভাবে?"
"কোথা থেকে যে সব চলে আসে!"
"আরে, সবকিছুর জন্য তো একটা যোগ্যতা লাগে!"
"আপনি এবার আসতে পারেন। নেক্সট..."

         সব শুনে অনির্বাণ হতাশ হয়। বলে তোমার দ্বারা আর কিছু সম্ভব নয়। হাল ছেড়ে দেয় সে। এখন তো একটুতেই কথা শোনায় অনির্বাণ। তিয়াসা মানসিক দিক দিয়ে আবার একা হয়ে পড়ে। এজন্য অবশ্য অনির্বাণকে সে দোষ দেয় না। দায়ী সে নিজেই। ভাবে, যা করবার তাকে একাই করতে হবে। 
আজকাল তার মনের কথা সে ডাইরিতে লিখে রাখে। কালি আর কলম যেন তার বন্ধু হয়ে উঠেছে। তাদের মাধ্যমে সে তার মনের সব কিছু উজাড় করে দিতে চায়। জন্ম নেয় কত নতুন নতুন চরিত্র, কাহিনি। 

        এর মধ‍্যে বুকান একদিন ওকে ফেসবুক খুলে দিয়ে কয়েকটি সাহিত্যগ্রুপে জয়েন করিয়ে দিল। বলল,"মা তুমি তো লিখতে পড়তে ভালোবাসো। এখানে সবাই দেখো, কী সুন্দর লেখে। তুমি পড়তে পারবে, ইচ্ছে হলে লিখতেও পারো।"
সেই শুরু হল একটু একটু করে নিজেকে প্রকাশ করা। তিয়াসার এই বেশ ভালো লাগে, সামনাসামনি নিজেকে প্রেজেন্ট করবার কোন দায় নেই। এখানে কেউ তাকে চেনে না। শুধু লেখার মাধ্যমে চিনবে। যেটা সে ভালবাসে। ক্রমে সে আস্তে আস্তে সকলের মনে জায়গা করে নিল। অশ্রুতা ছদ্মনামে তার লেখা ফেসবুক থেকে পত্রিকা, গল্প সংকলন তারপর উপন্যাসের পাতায় উত্তরণ হয়।
 সবাই তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তাকে দেখতে চায়। ছুঁতে চায়, তার কথা শুনতে চায়। আজ একটি বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ওকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অনুরোধ করা হয়েছে উপস্থিত হবার। অনির্বাণের মনে সন্দেহ। ও কি পারবে? তিয়াসা আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পারতেই হবে তাকে। এই শেষ সুযোগ। খুব সহজ সাধারণভাবে এসেছে সে। এখানে কেউ তাকে চেনে না। শুধু বুকান আর অনির্বাণ ছাড়া। তিয়াসা খুব সহজভাবে বসে থাকার চেষ্টা করছে। যখন উপস্থাপিকা স্টেজে আসার জন্য তার নাম ঘোষণা করল, মনের ভেতর উথাল পাথাল হলেও সে খুব সহজভাবেই এগিয়ে গেল। 

        স্টেজে উঠতেই তাকে হাজার করতালির মধ্য দিয়ে অভ‍্যর্থনা জানানো হল। তিয়াসার হাতে তুলে দেওয়া হল তার বই ও স্মারক। অনেক গুণীজনের সঙ্গে তাকেও সম্মানিত করা হল। সবার মাঝে তিয়াসা এবার অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। উপস্থাপিকা অনুরোধ করলেন তাকে কিছু বলার জন্য। সে খানিকটা থমকে এগিয়ে গেল মাইক্রোফোন বক্সের দিকে। কিন্তু ওখানে গিয়ে হল ভর্তি দর্শকের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে তার কোন কথাই যে সরছে না! এত কিছু লিখতে পারে সে, অথচ কথা বলাতেই যত সমস্যা! তিয়াসা মনে মনে প্রার্থনা করল ভগবান আজ আমাকে একটু সাহস দাও! পুরো হল নিস্তব্ধ। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।

     তিয়াসা থেমে থেমে বলা শুরু করল,"নমস্কার। শুভ অপরাহ্ন। আমি অশ্রতা ওরফে তিয়াসা। এখানে উপস্থিত সমস্ত গুণীজন ও প্রবীণদের জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। নবীনদের জন্য রইলো আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।"
 আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। দর্শকদের মধ্যে থেকে ভেসে এল, "দিদি আপনার কথা আমরা শুনতে চাই। বলুন।" 
একটু থেমে তিয়াসা আবার শুরু করল, "আসলে এই ধরনের স্টেজ পারফর্মে একদমই অভ‍্যস্ত নই। একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছি। আমার মনে হয় লেখা আর বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য। একটা লেখা তৈরি হয় অনেক সময় নিয়ে, ভাবনাচিন্তা করে। ভুল ত্রুটি হলে সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আবার ঠিক না লাগলে পরে অন‍্যরকমভাবেও লেখা যায়। এইরকম হাজারো ব‍্যাপার শুধরে নেওয়া যায়। কিন্তু বলার ক্ষেত্রে তা  নয়। একবার যেটা মুখ দিয়ে বেরোয় সেটা আর ফেরত নেওয়া যায় না। তাছাড়া বলাতে আমি একদমই স্বচ্ছন্দ নই। এরজন্য সারাজীবন আমাকে অনেক সমস‍্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। আমার কথা আমি লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করি। হয়তো বলতে পারি না বলেই লেখার ব‍্যাপারটা এসেছে। আমার লেখা ভালো করে পড়লেই আপনারা আমাকে বেশি করে জানতে পারবেন।"

অডিয়েন্স থেকে আবার কথা ভেসে এল,"আপনি বলুন, আমরা শুনবো। আপনার কথা শুনতে আমাদের ভালো লাগছে। প্রথম স্টেজে উঠে সবারই নার্ভাস লাগে। সে নিয়ে চিন্তার কিচ্ছু নেই। আমরা তো আপনার আপনজন। ভয় কি? আপনি যেমন ভাবে পারবেন বলুন..."

          তিয়াসা যেন একটু সাহস পেল। আবার সে বলা শুরু করল,"আমি সামান্য একজন গৃহবধূ। রান্নাবান্না করতে করতে হলুদ হাতে কিংবা সংসারের আর পাঁচটা কাজ সারতে সারতে যখন যা মনে আসে লিখি। আমার লেখা খুব সহজ সরল। সকালের চা খেতে খেতে কিংবা ঘরের  কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে, অফিসে যেতে যেতেও পড়ে নিতে পারবেন। আপনারা যে ভালোবাসা আমায় দিয়েছেন তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ। যার জন্য বোধহয় আজ আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হবার সাহস পেয়েছি। আমার জীবনে একটা ভয় খুব অদ্ভুত ভাবে এসেছে। না বলতে পারার ভয়। আপনারা শুনলে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। খুব ছোট্ট বেলায় আমার বাবা মারা যায়। মা আমাকে একলা রেখে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াতেন। মাকে কাছে না পেয়ে আমি খুব কাঁদতাম। বাড়ির আর সকলে আমাকে চুপ করাতে না পেরে অনেক সময়ই খুব রূঢ়ভাবে ধমক দিতেন। বেঁধেও রাখতেন। সেই যে ভয় পেয়ে চুপ করে গেলাম। সারাজীবনে সে ভয় আর কাটল না। কথা বলতেই ইচ্ছে হত না। আজ আপনাদের ভালোবাসায় সে ভয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। একটা কথা না বলে পারছি না। যেটা আমার সঙ্গে হয়েছে আর কারও সঙ্গে যেন না হয়। বাচ্চাদের সঙ্গে সবসময় খুব নরম ব‍্যবহার করা উচিত। খুব সামান্য ঘটনাও হয়তো তাদের জীবনে বড় কোন প্রভাব ফেলতে পারে। এত কথা হয়তো, হয়তো কী এর আগে কখনই একসঙ্গে বলিনি..."
মুহুর্মুহু হাততালিতে পুরো হল ফেটে পড়ল। একঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে তিয়াসার মনের সব আগল খুলে দিল।      সবাই এসে ঘিরে ধরল তাকে। আর ছদ্মনাম নয়, নিজের আসল নামেই লিখবে সে।

বৈশাখী ২০২৪