১) ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না’ স্বয়ং বিশ্ববিজয়ী কবি যখন এ কথা বলেছেন, তখন মানতেই হবে যে ভয় একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং প্রতিনিয়ত ভয় পাওয়া আমাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। না, ঠাট্টা নয়। এই আমার কথাই ধরুন, আদতে আমি লোকটা ভিতু গোছের, সারাক্ষণ ভয় পাওয়াই যেন আমার ভবিতব্য। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ খুললে, আমার দৈনিক ভয় পাওয়া শুরু হয়। সাদা পৃষ্ঠার কালো অক্ষরগুলো, লাল চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখাতে শুরু করে। ধর্ষণের ভয়, গার্হস্থ্য হিংসার ভয়, রাজনৈতিক হানাহানির ভয়, গণহত্যার ভয়, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ভয়, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটা গোটা সিস্টেমের ভয়, সেই সিস্টেমের শিকার অসহায় শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের ভয়ার্ত মুখের মিছিল চোখের সামনে ভেসে ওঠার ভয়, পেট্রো পণ্যর সঙ্গে সঙ্গে আগুন হয়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্যর বাজারের ভয়। এ হেন নানাবিধ ভয় পেতে পেতে অফিস যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলি। শিয়ালদহ মেন লাইনের একটি অতি ব্যস্ত রেল স্টেশন থেকে রোজ সকালে অফিসের উদ্দেশে ট্রেন ধরার সময়, আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে এক অন্য ভয়, ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠতে পারব তো, অফিসে লাল কালির দাগ এড়ানো যাবে তো? ট্রেন থেকে নেমে আর এক ভয়, অজগর সদৃশ অটোর লাইন। সর্পিল লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে শামুক মন্দ গতিতে এগোতে এগোতে যদি বা একসময় অটোর নাগাল পাওয়া যায়, তবে তখনই উঠতে পারা না পারার অনিশ্চয়তার ভয়। ব্যাপারটা বোঝা গেল না তো, তবে বুঝিয়েই বলা যাক। একটা অটোতে শিয়ালদহ থেকে চারজন সওয়ারি নেবে, মাঝ রাস্তা থেকে আরও দু’জন। কপাল ফেরে আপনি যদি লাইনের চার নম্বরে থাকেন, তবে আপনার অটো চালকের বাম পার্শ্বের আসনটি আলোকিত করার কথা, কিন্তু সেটা পুরোপুরি আপনার ওপর নির্ভর করে না, আমার ক্ষেত্রে তো করেই না। প্রায়শই শুনতে হয়, “দাদা এই বপু নিয়ে আপনি সামনে বসলে আর দু’টো প্যাসেঞ্জার রাস্তা থেকে তুলতে পারব না, আপনি পরের অটোতে আসুন।” ব্যস, হয়ে গেল। আমি ও আমার বপু আরও অনির্দিষ্টকালের জন্য পরের অটোর জন্য হাপিত্যেশ করে থাকি। আর যদি অটো চালক সদয় হয়ে পাশে বসতে দেন, তবে মাঝ রাস্তা থেকে ওঠা সহযাত্রী আর অটোর সারথির মধ্যে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হতে হতে দ্বিজাতীয় ঘাম ও গন্ধের চ্যাপ্টারের ভয়। ঘাম চ্যাটচ্যাটে সেই দ্বিবিধ চাপে দুরমুশ হয়ে অফিসে পৌঁছোবার পর অপেক্ষায় থাকে, রপ্তানিকারক সংস্থায় কাজের সুবাদে বিদেশি মুদ্রার সুবিধাজনক দর পাওয়া না পাওয়ার ভয়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ভয়াবহতার খবর যেমন সংবাদমাধ্যমে দেখে স্বাভাবিকভাবেই শিউরে উঠছি, তেমনই তার সরাসরি আঁচ এসে পড়ছে কর্মক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বেশ কিছু কাঁচা মালের দাম এক ধাক্কায় দেড় গুণ বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত ব্যয়ভারে ন্যুব্জ হয়ে বিদেশি ক্রেতাদের দাম বাড়াতে বললে, তাদের রোষ কষায়িত লোচনে দেখানো এক্সপোর্ট অর্ডার বাতিল করে দেওয়ার ভয়। যাত্রাপথের একই জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হওয়া অফিস ফেরতা আমার জন্য তারপর অপেক্ষা করে থাকে বাজারি ভয় মানে বাজারে ঢোকার ভয়। সকালের সংবাদপত্রে সে ভয়ের ইঙ্গিত থাকলেও, আসল ছ্যাঁকা লাগে বাজার করতে গেলে। এই তো সেদিন দু’কিলো আলু কিনে দোকানিকে একশো টাকার নোট ঠেকিয়েছি, তা তিনি যা ফেরত দিলেন, তাতে করে ভেবেছি কোথাও একটা ভুল হচ্ছে; সে ভুল ভাঙানোর বাসনায় বলে বসেছি, “ও ভাই, আমি তিন কিলো নয় আমি দু’কিলো আলু কিনেছি।” দোকানী করুণামিশ্রিত গলায় বললেন, “আমি দু’কিলোরই দাম কেটেছি, যেটুকু আজ ফেরত পেলেন, মনে হয় না পরের দিন তা আর দিতে পারব বলে।” তবে এর কিছু সুবিধাও আছে তা অস্বীকার করতে পারি না। ইদানীং ভার খুব কম বহন করতে হচ্ছে। দু’কিলো আলু থেকে এক কিলো আলুতে নেমে এসেছি, পাঁচশো কাটাপোনা থেকে আড়াইশো চারাপোনায়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণের পথে ব্যয় সঙ্কোচন করার প্রয়াস চালাতে চালাতে যদি নিজের ভারী শরীরের ভার কিছু লাঘব করতে পারি, তবে অটোচালকদের দৈনন্দিন বপু নিয়ে খোঁটা দেওয়ার ভয় থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বাপু, মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ২) ২০-২১ বছর বয়সী আমি, একদিন সন্ধ্যায় অন্যরকম ভয়ের পরিচয় পেয়েছিলাম, আমার বন্ধু গোরার চিৎকারে, “শিগগিরি আয়। টাবলুকে, পৃথ্বীরাজ সিং জিপে করে তুলে নিয়ে গেছে।” সেদিনের ভয়, প্রেমিকাকে দেখে বুক ঢিপঢিপ করার ভয় নয়, বরং প্রচণ্ড আতঙ্কে পেট গুড়গুড় করা ভয়ের অনুভূতিই তাতে বেশি ছিল। ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়ার কথা বইতে পড়েছি, কিন্তু সেদিন ওসব বস্তু শরীরে আছে বলেই মালুম হচ্ছিল না। আমরা থাকতাম উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার একটি সরকারি আবাসনে। আমাদের আবাসনের অনতিদূরে ওই একই সরকারি সংস্থার অপর একটি আবাসনে ডেরা ছিল, অঞ্চলের বেতাজ বাদশা, কুখ্যাত ডন, ‘পৃথ্বীরাজ সিং’-এর। পৃথ্বীরাজ সেবার একটি রাজনৈতিক দলের টিকিটে পুরসভার নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিল, ও দাঁড়ালে জিতবেই সেটা নিপাতনে সিদ্ধ। কে বিপক্ষে ভোট দিতে যাবে? এ হল ব্যক্তিকে, সমষ্টির পাওয়া ভয়। যদিও পৃথ্বীরাজকে একা বলা যায় না। তার গুন্ডা বাহিনী ছিল, ছিল রাজনৈতিক ছত্রছায়া। তবে ভয় দিয়ে সবাইকে জয় করা যায় না। আমার বন্ধু টাবলুকেও করা যায়নি। বোধহয় সেই বিশ্বজিৎ কবিই ওকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে—-“। এলাকায় প্রবল জনপ্রিয় টাবলু, পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে একজন যোগ্য শিক্ষিত সৎ নির্দল প্রার্থীর হয়ে প্রচার শুরু করার পরই ওর সঙ্গে অনেক অল্পবয়সী ছেলে সেই প্রচারে যোগ দেওয়ায়, পৃথ্বীরাজের ভোটে জেতার অঙ্কে একটু ভয় ঢুকে যায়। অসতের, নির্ভীক সততাকে ভয়। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের আবাসনের দুর্গাপুজোর বেদিতে টাবলু আর গোরা দু’জনে বসে গল্প করছিল, সেইসময় পৃথ্বীরাজ জিপ নিয়ে সেখানে এসে টাবলুকে বলে, “জিপে উঠে আয়।” পৃথ্বীরাজ জিপে একা ছিল, অন্য কেউ হলে পালানোর চেষ্টা করত। টাবলু পালাতে জানত না, কুছপরোয়া নেহি মনোভাব থেকে ও সোজা জিপে গিয়ে বসে পড়ে। পৃথ্বীরাজ, গোরাকে ধর্তব্যের মধ্যে রাখেনি। পৃথ্বীরাজ সিং কাউকে জিপে তোলার পর সে জীবন্ত ফিরে এসেছে তেমন পূর্ব নিদর্শন না থাকলেও টাবলু ফিরেছিল সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায়। সে অন্য গল্প, অন্য কোনওদিন বলা যাবে। ভয় পেয়েছিল গোরাও। ওর মহাবলী মামা থাকত হাজারিবাগে, সে মামা নাকি বুনো দাঁতাল শুয়োরের দাঁত ধরে মাটিতে শুইয়ে দিতেন, সামান্য লাঠি হাতে চিতাবাঘের মোকাবিলা করা তাঁর কাছে জলভাত। একদিন গোরা বলল, ওর হাজারিবাগের সেই মহাবলী মামা হাজারিবাগের জঙ্গল থেকে কুড়ি ফুটের একটা বুনো আলু একাই কাঁধে করে তুলে এনেছেন। তারপর সেই আলু ট্রেন এবং ট্যাক্সি করে বয়ে গোরাদের কোয়ার্টারে নিয়ে এসেছেন। আমাদের সেই সরকারি আবাসনের দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরের, ছ’ফুট বাই সাত ফুট খাটের তলায় কুড়ি ফুটি বুনো আলুকে মামা কোন জাদুবলে রাখলেন, সে প্রশ্নে গোরা আমল দিল না। তাই অনেক অনুরোধ করেছিলাম, মামা না দেখা অন্তত বুনো আলুটা দেখা বলে। গোরা তাতে আমার ওপর ভীষণ চটে গিয়ে বলেছিল, “এখন ক’দিন খবর্দার আমাদের কোয়ার্টারের ধারে পাশে ঘেঁষবি না।” গুল্পবাজ গোরার গুল্প ধরা পড়ার ভয়। আমার আর এক বন্ধু নীলাদ্রি থাকত দমদম গোরা বাজার অঞ্চলে। একদিন সকালে রেশনের লাইনে নীলাদ্রির সঙ্গে একটা ছেলের কোনও কারণে ঝগড়া হয়। ছেলেটা নীলাদ্রিকে শাসিয়ে যায়, ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে এসে নীলাদ্রিকে শিগগিরই বানাবে। এ বানানো মানে, গুছিয়ে পেটানো। নীলাদ্রি একেবারেই গোবেচারা টাইপের ছেলে, ঝগড়াটা হঠাৎ রাগের মাথায় করে ফেলেছে। ছেলেটা যদি তখনই দু’-এক ঘা নীলাদ্রিকে বসিয়ে দিত, তো হ্যাপা মিটে যেত। কিন্তু, সে সেটা অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ কালের জন্য মুলতুবি রাখায়, নীলাদ্রি গভীর উদ্বেগের মধ্যে সারাদিন কাটিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যে এইভাবে হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ককে সঙ্গী করে ও বাঁচতে পারবে না। তার থেকে একটা এসপার ওসপার হয়ে যাক। ওই ছেলেটার ক্লাব নীলাদ্রির চেনা ছিল, ও বিকেলবেলায় সোজা গিয়ে ওই ক্লাবে হাজির হয়ে যায়। তখন নীলাদ্রিকে বানাবার সংকল্প করা ছেলেটি তার বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারম খেলছিল। নীলাদ্রি ওদের ডেকে বলে, “তোমাদের আর কষ্ট করে খুঁজে-পেতে আমাকে মারতে হবে না, আমি নিজেই চলে এলাম, তোমরা বরং এখানেই আমাকে মেরে নাও, নয়তো তোমরা কখন মারবে সেই ভয়ে আমি বাড়ির বাইরেই বেরোতে পারব না। আমার কলেজ যাওয়ার দফারফা হয়ে যাবে।” সেই ছেলেগুলো মারকুটে গোছের হলেও, এ হেন প্রশ্নপত্রের মুখোমুখি হওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ওদের ক্লাবে যেচে মার খেতে আসা নীলাদ্রিকে ওরা কিছুতেই মারতে রাজি হয়নি, বরং কিছুটা লজ্জিত হয়েই নীলাদ্রিকে চা খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। নীলাদ্রির ভয়টা ছিল অনিশ্চয়তা ভরা হেনস্থার আর ওই ছেলেগুলো ভয় পেয়েছিল নীলাদ্রির সারল্যকে। সমগ্র মানবজাতিকে মৃত্যু ভয় দেখিয়ে দিল এক মারণ ভাইরাস। তিন বছর ধরে লক্ষ লক্ষ প্রাণ চলে গেল। এখন সে কিছুটা স্তিমিত বটে, তবে অন্তর্হিত নয়। যেকোনও সময় তার পুনরার্ভিবের ভয় এখনও কুরে কুরে খেয়ে চলেছে। মারণ ভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির দফারফা, বহু মানুষের জীবিকা নষ্ট হয়ে গেল, বহু মানুষের কর্মসংস্হান নষ্ট হওয়ার ভয় এখনও মাথার ওপর ঝুলছে। ভয় পাওয়ার এক অদ্ভুত দক্ষতা আমার মজ্জাগত। এখন তো ভয় লাগছে, রম্যরচনার জায়গায় সম্পাদকমণ্ডলীর জন্য খানিকটা বিড়ম্বনারই সৃষ্টি করলাম বোধহয়। এ লেখা পাঠকের পাতে তুলে দিতে তারা ভয় পাবেন না, সে কথা হলপ করে বলতে পারি না। সেই ভয়ের খাঁড়া মাথায় নিয়েই আজ শেষ করলাম।