প্রিয়াঞ্জলির বয়স সবে তেইশ। এম এ পাশ করে বেরোনোর পরই বাবা বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। প্রিয়াঞ্জলির ইচ্ছা ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়ে নিজের বুটিক খোলার। কিন্তু বাবার এক কথা, “যা করবে বিয়ের পর। আমার কাজ আমাকে শেষ করতে হবে।”অগত্যা নিফটিতে ফর্ম ফিল আপ করে, অনলাইন ম্যারেজ সাইটেও নাম রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে প্রিয়াঞ্জলি। বাবার দেখে দেওয়া পাত্র বিয়ে করা ওর পোষাবে না। নিজের পছন্দ মত কয়েকটা খুঁজে নিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে দেবে ঠিক করেছে। পাত্রপক্ষের দেখতে আসা টাসা একদম বাতিল। একটা কমন জায়গায় বসে কথাবার্তা বলে নিলেই হবে এখন। ওর বেশিরভাগ বন্ধুরই তো বয়ফ্রেন্ড ঠিক করা। কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকেই পছন্দ করে নিয়েছে। প্রিয়াঞ্জলির আবার ক্লাসমেট বিয়ে করা দু চক্ষের বিষ! ঐ প্যাংলাগুলোকে কে বিয়ে করবে? ওর পছন্দ বেশ লম্বা চওড়া স্টাউট চেহারার হ্যান্ডসাম ছেলে। বাঙ্গালির মধ্যে তেমন পাওয়াই ভার! প্রিয়াঞ্জলি দেখতে মিষ্টিই বলা যায়। গায়ের রং অবশ্য বিরাট ফরসা নয়, গমের মত। তা দীপিকা পাড়ুকোনই বা কী এমন ফর্সা শুনি? তাই নিয়েই বিশ্ব কাঁপাচ্ছে! ম্যারেজ সাইটে রোজ রাত্রে ব্রাউস করা এখন প্রিয়াঞ্জলির নিয়মিত কাজ। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অনেক চোখে পড়ছে, তবে চেহারা সেই প্যাংলা মার্কা আর গড়পড়তা বাঙালি ছেলের উচ্চতা তো সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি ওঠেই না। প্রিয়াঞ্জলি যেমনটা চাইছে, তেমন চেহারা পাঞ্জাবি ছেলে ছাড়া চোখেই পড়ছে না। বাবা রোজ খোঁজ নেন। শেষে রেগে গিয়ে বললেন “ছেলেদের আবার চেহারা! রোজগার কত সেটা লিখেছে তো তোমার সাইটে? নইলে বিয়ের পর হরি মটর খেতে হবে!” প্রিয়াঞ্জলি গম্ভীরভাবে বলল, “মেয়েরা আজকাল নিজেরা রোজগার করে বাবা। ছেলেদের রোজগারের ওপর নির্ভর করে না।” “তা বলে তুমি একটা বেরোজগেরে পালোয়ানকে বিয়ে করবে! মাই ফুট!” বাবা হুঙ্কার দিয়ে চলে গেলেন। অবশেষে ক্যাপ্টেন প্রীতম কুন্ডুকে খুঁজে পেয়েছে প্রিয়াঞ্জলি! ইস্টার্ণ কম্যান্ডে গ্রুপ ক্যাপটেন। হাইট ছ ফুট দুই, মানানসই একখানা গোঁফ এবং আর্মি ছাঁট চুল, বড় বড় চোখ। বাড়ি চুঁচুড়া। বালিগঞ্জের বাসিন্দা বাবার যদিও মফস্বল পছন্দ না, তবু প্রিয়াঞ্জলি নিশ্চিত ঐটুকু মানিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু বাবার সামনে ছবি এবং অন্যান্য সব ডিটেল নিয়ে ফেলতে, বাবা প্রায় আঁতকে উঠলেন “এ কী! চাটুজ্জের সঙ্গে কুন্ডু! তোমার কি কোন কান্ডজ্ঞান নেই? বেসিক প্যারামিটার ভুল!” কিন্তু ততক্ষণে প্রিয়াঞ্জলি প্রীতমের ফেসবুক বন্ধু হয়ে গেছে। দুজনের ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ হয়ে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে কথাবার্তা হয়েছে, অতএব এ জলতরঙ্গ রোধিবে কে? আমসি মুখে বাবাকে মেনে নিতে হল প্রিয়াঞ্জলির পছন্দ! কিন্তু মনে মনে এ কথা স্বীকার করতেই হল যে বেশ জব্বর জামাই হয়েছে! রীতিমত পাকিস্তান সীমানায় যুদ্ধ করে এসেছে! গত ছাব্বিশে জানুয়ারি সাহসিকতার জন্য কী একটা মেডেলও নাকি পেয়েছে! আত্মীয়স্বজন মহলে সবাই গুজগুজ ফুসফুস করলেও প্রীতমের দিকে বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকাচ্ছে এটা প্রিয়াঞ্জলি লক্ষ্য করেছে। শুধু বিয়ের দিন মা একবার মিনমিন করেছিল, “আমার বেশ ভয় করছে! আর্মিদের জীবনের কোন ঠিক আছে? এর চেয়ে বাপু ব্যাঙ্কের ক্লার্ক ঢের ভাল ছিল!” প্রিয়াঞ্জলি জ্বলন্ত চোখে তাকাতে মা চুপ। চুঁচুড়ায় শ্বশুরবাড়িটি বেশ বড়সড়। প্রীতমের ঠাকুরদার বানানো। বাড়ির বয়স বছর পঞ্চাশ হয়েছে। মফস্বলের বাড়ি যেমন হয়, চারিদিকে বিশাল বাগান ঘেরা। পিছনে পুকুর আছে। প্রীতমের বাবা কাজের সূত্রে বাইরে থাকতেন। রিটায়ার করে এই বাড়িতে এসেছেন। প্রীতম তো যখন যেখানে পোস্টিং সেখানে। আপাততঃ মাসখানেকের ছুটিতে বাড়িতে। কালরাত্রির দিন সবাই শুয়ে পড়ার পর চারিদিক বেশ নির্জন হয়ে গিয়েছিল! বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক! জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রিয়াঞ্জলি দেখে বাইরে ঝুপসি গাছগুলোর পিছনে কালো অন্ধকার যেন দলা পাকিয়ে আছে! আকাশে এক টুকরো ঘোলাটে চাঁদের আলোয় আরো ভয় ভয় পরিবেশ! এ বাড়িতে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম যেতে হয়! কিন্তু প্রীতমের বিয়ের আগে তার বাবা ওদের ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুম করে দিয়েছেন ভাগ্যিস! নইলে রাতবিরেতে বেরুতে হলে ওর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেত! বালিগঞ্জের শহুরে পরিবেশে অভ্যস্ত প্রিয়াঞ্জলির বেশ গা ছমছম করছিল! পরদিন ফুলশয্যা। সারা সন্ধে অজস্র অতিথি সামলে বেশ রাত করে খাওয়া দাওয়া আর ফুলশয্যার আচার অনুষ্ঠান শেষ করে প্রবল ক্লান্ত প্রিয়াঞ্জলি ধড়াচূড়া ছেড়ে খাটে গা এলিয়ে প্রীতমের অপেক্ষায় ছিল। এখনো বাড়ি ভর্তি লোকজন। প্রীতম হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেই বলল “প্রিয়া আই অ্যাম কামিং আফটার এ কুইক বাথ!” ঘরের লাগোয়া বাথরুম। প্রীতম সেখানে ঢুকেই হঠাত একটা চিৎকার করে উঠল “ওহ! নো!” প্রিয়াঞ্জলি চমকে উঠে বলল “কী হল প্রীতম! চিৎকার করলে কেন? পড়ে গেলে নাকি!” বাথরুমের ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আরো ঘাবড়ে গিয়ে প্রিয়াঞ্জলি ভাবল বাইরে গিয়ে কাউকে ডাকবে। নাঃ থাক! কে আবার কী ভাবে! প্রায় দমবন্ধ করে বসে রইল! বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক শুরু হয়েছে! ঘরের বাইরেই সেই অন্ধকার বাগান থেকে কী একটা অজানা ফুলের মাতাল করা গন্ধ আসছে! জানলাগুলো সব বন্ধ আছে কি না আর একবার চেক করে নিল! কী করছে বাথরুমে প্রীতম? হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল প্রিয়াঞ্জলির! অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে গেল না তো! আস্তে আস্তে বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে ডাকল “প্রীতম! কী করছ?” কোন সাড়া নেই! সবচেয়ে আশ্চর্য বাথরুমের ভিতরটা অন্ধকার! প্রিয়াঞ্জলির হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল! আচ্ছা, প্রীতমের ফিটের ব্যামো নেই তো! উঁহু তা তো হতে পারে না! আর্মি সবকিছু চেক করে ছাড়া কাউকে নেয় না! আর প্রীতম তো গত তিন বছর সার্ভিসে! আরো মিনিট পনেরো কেটে গেল। প্রীতমের কোন সাড়া নেই। পনেরোটা মিনিট প্রিয়াঞ্জলির পনেরো বছরের মত লাগছে! হে ভগবান! কী হতে পারে? শেষে আর ঝুঁকি না নিয়ে প্রিয়াঞ্জলি যখন ঘরের দরজা খুলে কাউকে ডাকতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই বাথরুমের দরজাটা একটু ফাঁক হল! প্রীতম বেরিয়ে এল! মুখটা কাগজের মত সাদা! কোনক্রমে বেরিয়েই বাথরুমের দরজাটা ঠেসে বন্ধ করে দিল! তারপর হঠাত নিজের আলমারি খুলে খুব ব্যস্ত হয়ে কী খুঁজতে লাগল! প্রিয়াঞ্জলি কৌতূহলে বাথরুমের দিকে এগোতে যাচ্ছিল – প্রীতম ছুটে এসে বেশ জোরে ওর হাত চেপে ধরল, “প্লিজ ডোন্ট গো দেয়ার!” প্রায় আদেশের মত সুরে কথা কটা বলেই আবার আলমারিতে ভীষণ ভাবে কী খুঁজতে লাগল! প্রিয়াঞ্জলি ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল “ও-ও-ওখানে কী আছে!” উত্তেজিত ভাবে প্রীতম বলল “এনিমি!” ফুলশয্যার রাতে কোন মেয়ের এমন দমবন্ধ পরিস্থিতি ভাল লাগে! আর্মির জীবন প্রীতমের। আজকাল বর্ডারে টেররিস্ট অ্যাটাক যেখানে সেখানে! কে জানে কেউ ওকে টার্গেট করেছে কী না! হয়তো কোন টেররিস্টকে খতম করেছিল, তার সাঙ্গোপাঙ্গো ওকে শেষ করে দিতে চাইছে! বাথরুমের জানালার বাইরে কেউ ওর জন্য অপেক্ষা করছিল না তো? জানে হয়তো এই সময় ও ছুটিতে বাড়িতে এসেছে! ওকে যদি ফলো করে থাকে বাড়িতে ঢুকে আসা অসম্ভব কিছু নয়! হয়তো কাউকে দেখেই প্রীতম সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের আলো নিভিয়ে দিয়েছে যাতে ওরা অ্যাটাক করতে না পারে! তারপর এতক্ষণ ঘাপটি মেরে থেকে কোনক্রমে বেরিয়ে এসেছে! এমনটাই হবে! বাড়িভর্তি লোকজনকে ভয় পাওয়ানোর কোন মানে হয় না বলে বাইরেও বেরোচ্ছে না! কিন্তু প্রীতম কিছু বলছে না কেন? হঠাত প্রীতম ঘুরে দাঁড়ালো! হাতে নিজের সার্ভিস রিভলবার! শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নামছে! প্রিয়াঞ্জলির মনে হল এবার ও অজ্ঞানই হয়ে যাবে! কোনদিন সামনে কাউকে সরাসরি রিভলবার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি! প্রীতম বাথরুমের দরজাটা একটু ফাঁক করেই বাঁ হাত গলিয়ে আলোটা জ্বালল! প্রিয়াঞ্জলি অবাক! আলো জ্বালল কেন? এবার একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে সরাসরি উল্টোদিকে জানালা লক্ষ্য করে পরপর তিনটে গুলি! ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙ্গে পড়ল! তার মানে জানলাটা বন্ধই ছিল! তাহলে? আবার চীৎকার “ওহ নো!” প্রায় একটা লাফ দিয়ে বিছানায় চলে এল প্রীতম, হাতে বন্দুক আর পিছন পিছন ফড়ফড় করে উড়ে বেরোল একটা বড়সড় আরশোলা আর ঠিক প্রীতমের মাথার ওপর উড়তে লাগল! প্রীতম প্রিয়াঞ্জলির কোলে প্রাণপণ মুখ গুঁজে বলতে লাগল “ওকে মার! ওকে মার! আই ক্যান নট স্ট্যান্ড! ক্যান নট কম্ব্যাট দিস এনিমি!” এবার প্রবল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল প্রিয়াঞ্জলি! আরশোলাটা ততক্ষণে ঘরের মেঝেতে সড়সড় করে হেঁটে বেড়াচ্ছে! প্রিয়াঞ্জলি নিখুঁত টিপে হাওয়াই চপ্পলটি নিয়ে ফেলল তার মাথায়! মুহূর্তে চেপটে ভবলীলা সাঙ্গ হল আরশোলাটার! প্রীতমের দিকে তাকিয়ে দেখে বেশ অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে প্রীতম! বলল “প্রিয়া বিশ্বাস কর আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ডিফিকাল্ট টেরেনে লড়েছি! একসঙ্গে তিন চারদিক থেকে গুলি আসছে, একা তার মোকাবিলা করেছি! পঞ্চাশ জন সৈন্যের টিম লিড করেছি, এনিমিকে এগোতে দিইনি! কিন্তু এই কক্রোচ যদি অ্যাপ্রোচ করে!” হাসতে হাসতে প্রিয়াঞ্জলি বলে “ও সব আমি বিশ্বাস করছি না! যে ক্যাপটেন আরশোলাকে ভয় পায়, সে নাকি টেররিস্টদের মারবে! সব বুজরুকি! আমি তোমার টিম লিডারকে বলে দেবই দেব!” “প্লিস প্রিয়া! আ-আ-আমার প্রেসটিজ পাংচার করে দিও না! আই প্রমিস! তোমাকে খুব সুন্দর জায়গায় হনিমুনে নিয়ে যাব!” বলে প্রিয়াঞ্জলিকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দেয় প্রীতম। আর ঠিক তখনি দরজার বাইরে থেকে কতগুলো মেয়ের গলা “ছোড়দা ভাই! বন্দুকের আওয়াজ শুনলুম! কী ব্যাপার রে! খোল না! খোল না!” প্রীতম ধমকে বলল “তোরা এখনো আড়ি পাতছিস! যা বলছি! নইলে বন্দুক এবার তোদের দিকে তাক করে ছুঁড়বো বলছি!”