“ও দাদা শুনছেন?” হ্যাঁ, সারাদিন অফিসের হরেক ঝক্কি আর বাড়ির হাজার কাজের ফিরিস্তি সামলানোর পর যখন হাতের বইটা মাথার পাশে রেখে ঘুম নামক কমলশোভিত আমেজের তলায় কাদা কাদা হয়ে মিশে গেছি, তখন কেমন যেন এক অষ্পষ্ট ডাক কানে এল বটে। তায় আবার জানুয়ারির জানান দেওয়া শীতে, আপাদমস্তক শিমুলতুলোর লেপের তল হতে। “তা বলি, একবার কি একটু ওঠা যায়?” এবার সত্যি সত্যি একটু চমকে উঠলাম। আর তা হল যখন নিদ্রামহাশয় তন্দ্রার পোশাক পরলেন ওই ডাক আবার শুনে। এখন রাতদুপুর না রাতবিকেল তা ঠাহর করতে পারলাম না। আধখোলা কোঁচকানো চোখে, দুহাতে লেপ পোড়া কপালের থেকে দেড়ইঞ্চিখানেক নামিয়ে ঘোরের মধ্যে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কে ডাকে আমায়?“ উত্তর এল, “একটু দয়া করে উঠে বসে কথা বললে খানিক সুবিধে হত।” এতক্ষণে তন্দ্রাও, ডান্ডা খেয়ে ঝান্ডা উঁচিয়ে পগার পার। বাহাদুরির ব্যাঙ্কে চিরকালই আমার আবার সাহসের আসল কম আর ভয়ের ইন্টারেস্ট বেশি। তাও কোনো রকমে জমানো সাহসের সব পুঁজি আর স্থায়ী আমানতগুলো বুকের মধ্যে জড়ো করে, দু কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে আবক্ষ মূর্তির মতো আকন্ঠ ভয় নিয়ে পুরুষ সিংহের থুড়ি হুলোর মতো উঁকি দিয়ে যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া কী দইবড়া হল তা মা গঙ্গাই জানেন। বইয়ে পড়েছি, সিনেমা নাটকে দেখেছি মানুষ হঠাৎ ভীষণভাবে ভয় পেলে শিঁরদাড়া দিয়ে নাকি ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। না:, পুরোপুরি সত্যি নয় কথাটা। কারণ, আমি যা দেখলাম তাতে শুধু শিঁড়দাঁড়া নয়, আমার সর্বাঙ্গ দিয়েই যেন বয়ে গেল এক হিম শীতল সুনামি ঢেউ । জানলা দিয়ে আসা রাস্তার বাতিটার আলোয় ঘরে যে একটা আলোআঁধারির রেশ তৈরি হয়েছে, তাতেই যেন ছ্যাঁকা খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা মেরে দেখলাম বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে নর-কঙ্কাল। মুখ থুড়ি খুলি তার যায় নাকো দেখা, আঁধারে পড়েছে তা ঢাকা মানুষের পাঁজর আজ চাক্ষুষ করে, আমার পাঁজর বোধ করি ভগ্নস্তূপে পরিণত হওয়ার জোগাড়। আমার এই বিহ্বল অবস্থার ইতি টেনে সম্বিত ফিরে পেলাম বাইরে থেকে আসা চৌকিদারের হেঁড়ে গলার হাঁকে, “জাগতে রহো!” মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটি বেরোল না। শুধু মনে মনে ভাবলাম, “আ মোলো যা, জেগেই তো রয়েছি আর তাতেই তো যা বিপদ।” এবার এই সর্বশুভ্র নরকঙ্কাল বলে উঠল, “দাদা কি চিনতে পারলেন নাকি!” আমি আমতা আমতা করে, “ মানে, মানে …” করছি আর এমনি সময় তিনি আরও সহৃদয় হয়ে বলে উঠলেন, “দাঁড়ান দাঁড়ান মুখটা একটু আলোয় আনি!” উফফ, এ কী জ্বালাতন রে বাবা! আমার প্রায় যায় যায় অবস্থা! কিন্তু মুখ আলোতে আনার আগে তিনি বললেন, “এ হে হে, আমাদের আবার সবাইকে তো একইরকম পানা দেখতে লাগে। আপনি চিনবেনই বা কী করে, একদম ভুলে মেরে দিয়েছিলুম। আর তাছাড়া আপনি যদি আবার আমাকে হঠাৎ দেখে মূর্ছা যান, সে এক কেলেঙ্কারি কান্ড হবে বাবা। তার চেয়ে দাঁড়ান আমার ফেলে আসা বদনখানার বেশ ধারণ করি একবার।” এই বলে সে যখন মুখটি আলোয় আনল, তা দেখে আমার মুখটি প্রায় আমসির মতো শুকিয়ে যাওয়ার কান্ড। গোটা শরীরটা কঙ্কালের আর মাথাটা, হ্যাঁ সে যদিও আমার চেনা, বাজারের ব্রজ মাছওয়ালার। এই দৃশ্য দেখা যে এক কী বীভৎস অনুভূতি তা যে দেখে সেই জানে। “দাদা, চিনতে পেরেছেন তো। তাহলে আবার ফিরলাম খুলিতে আসলে ঢের জ্বালা বুঝেছেন। আপনারা যে ভাবেন ওই যখন তখন ইচ্ছে মতো নানা রকম বেশ ধারণ করে আমরা দেখাতে পারি, তা আসলে নয়। সে আমিও ওই সব মায়া কাটানোর পরইবু ঝেছি যদিও। বিস্তর খরচ বুঝলেন কিনা। আসলে এই রূপ ধারণের জন্যে আমাদের মান্থলি প্ল্যান নিতে হয়। অনেকটা মোবাইল রিচার্জের মতোই আর কী। বেশ ধরলে হবে, খরচা আছে হেব্বি! তাছাড়া আমি তো আবার এ তল্লাটে সবে এলাম। ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে আর কী!।আমার যদিও হল গিয়ে অকালমৃত্যু, বুঝলেন, কিন্তু ওই আপনাদের মহা মারামারি না কী যেন, তাতে যা রেটে লোকজন আসছে, সাপ্লাই ডিমান্ডের হেভি চাপ চলছে। তার ওপর কালোবাজারি আছে। মোটের ওপর মরেও নিস্তার নেই। “যাক একটু গোড়া থেকে বলি। আপনি তো এই গেলো রোববারই আমার থেকে মাছ নিলেন। আপনি নিলেন তারপর আর ঘন্টাদুয়েক মাছ বেচে বাড়ি ফিরব বলে, সব কিছু গুটিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হয়েছি। দত্তপাড়া থেকে ঝন্টুপুকুরের রাস্তা শর্টকাট মারব বলে রোজই ওই মাঝের সরু রাস্তাটা ধরি। সেদিন কি আর জানতাম ওই পথেই এমন হবে?” এই বলে ব্রজ মানে ওই কঙ্কাল যেন একটু চুপ মেরে গেল। চোয়ালটা যেন ইঞ্চিখানেক আরো ঝুলল। এই প্রথম জীবনে বুঝলাম তেনাদেরও আবেগ কত চরম, আর তার বহিঃপ্রকাশ আরো কত সাংঘাতিক। যদিও ভূতের ভূতপূর্ব ঘটনা শোনার একটু আগ্রহও হচ্ছিল, তাই নিজের অজান্তেই বলে বসলাম, “তারপর কী হল?” পাঁজরটা একবার আধহাত উঠে আবার নেমে যেতে দেখে আমি একহাত পিছিয়ে এলাম । ব্রজ বললো, “ওই সরু রাস্তা ধরে যাচ্ছি, পথের মাঝামাঝি আছে এক নারকোল গাছ। ঠিক গাছের তলায় যখন আমি, পড়বি তো পড় ঠিক আমার ব্রহ্মতালুতে পড়ল একটা আইসা বড়ো ডাব ডাব পড়ল, আর আমিও পড়লাম তবে আর উঠলাম না। চোখের সামনে দেখলাম বাজারের বিশু, চাচা, অন্তুরা চ্যাংদোলা করে আমার শরীরটা তুলে নিয়ে চলে গেল। সেই তখন থেকেই এই তল্লাটেই ঘোরাফেরা করছি। তা আজ যে কারণে আপনার কাছে আসা, যদি অভয় দেন একটু বলি।” ব্যাটা বলে কী? অভয় দেব আমি? আমার বলে ভয়ে হাত, পা, গলা শুকিয়ে যেমন কাঠের মতো হয়ে গেছে তাতে একখান চারপায়া টেবিল তৈরি হয়ে যাবে। তাও বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলো, বলো।” “দাদা, ওই খেঁদি পেত্নির দিব্বি খেয়ে বলছি, জীবিত কালে আপনাকে কখনো ঠকাইনি মাছ বেচার সময়। দু’চার পয়সা বেশি দামও নিইনি কখনো, তা আজ এই দুর্দিনে যদি একটু সাহায্য করেন।” “কিছু টাকা কড়ি লাগবে কি?” প্রশ্ন করি আমি । “না না টাকা পয়সা নয়, আপনাদের ওই টাকা দিয়ে তো আমাদের কাম চলে না। আমাদের সব ক্যাশলেস ঘোস্টলি ট্রানসাকশান করতে হয়। চাপাডাঙার শ্মশান ব্রাঞ্চএ খাতা খুলে সেসব করতে হয়, ও আপনি পরে বুঝবেন একদিন।” চোয়াল চেপে খুলি নাচিয়ে একবার যেন হেসে আবার শুরু করল, “বলছিলাম, এই জানুয়ারির শীতের রাত। আমার অবস্থাখানা তো দেখছেনই। আমাদের দেখে লোকের নাকি হাড় কাঁপে। কী অন্যায় কথা ভাবুন দেখি! আরে আমাদের গায়ে যে একটা সুতো, পলেস্তরা নেই কী অবস্থা!” বলেই যেন সে হঠাৎ কাঁপতে আরম্ভ করল আর হাড়ে হাড়ে কাঁপাকাঁপি যে কী জিনিস আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম। মুখ ফস্কে, “হরে কৃষ্ণ” যেই না বেরিয়েছে অমনি ব্রজ লাফিয়ে উঠে বলে, “ও কী করছেন, ও সব নামকীর্তন একদম করবেন না দাদা।” কেমন যেন একটু মায়া গোছের হল । বললাম, “ও আচ্ছা আচ্ছা । ঠিক আছে । তবে আমার যে সবেধন নীলমনি এই একটিই যে লেপ।” ব্রজ বললো, “তাই নাকি! ও ঠিক আছে তাতেই হবে দাদা। একরাতের তো ব্যাপার। তাছাড়া এ তোদেখছি পেল্লায় ডবল সাইজের লেপ। কাল আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেব। দু’তিনদিন ধরে বড়ো কষ্ট পাচ্ছি। আজ আপনার পাশটিতে একটু যদি শুতে দেন। ভোরের আগে ভাগেই কেটে পড়ব। কাল মেলা কাজ। এই শীতের রাতে যদি একটু শান্তিতে জিরোতে পারতাম।” কী অশান্তি রে বাবা! ভূতের সঙ্গে লেপ শেয়ার! কেউ কোনোদিন জম্মে শুনেছে! “অত ভাববেন না, দাদা, দোহাই আপনার, পায়ে পড়ি।” বলে দুহাত তুলে এগিয়ে আসতেই আমার মনে হল যেন আমার গলা টিপতে আসছে। গলদঘর্ম হয়ে ফস করে বলে ফেলি, “আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।” আমি হাল্কা করে বিছানার একধার ঘেঁষে সরতেই সুরুত করে সে লেপের তলায় ঢুকে পড়ল। মনে মনে রাম নাম করছি আর ভাবছি, কার মুখ দেখে রাতে শুতে গেছিলাম কে জানে। পাশাপাশি চিত হয়ে নর আর নরকঙ্কাল এক লেপের তলায়। মিনিটখানেক ঠকাঠক শব্দ করে এপাশ ওপাশ করে সে বলল, “নতুন জায়গা কিনা তাই একটু ইয়ে আর কী। তা শুয়ে পড়েন দাদা। আপনারও তো ঘুমের দফা রফা করলাম।” একবার ব্রজর হাড়ে ছোঁয়া লাগল। সারা শরীরে যেন খেলে গেল বিদ্যুৎ তরঙ্গ। চোখ বুজে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে থাকতে একসময় দুচোখ হয়ে এল ভারী। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি অক্ষতই রয়েছি আমি। তবে সেদিনও ছিল রবিবার। থলি হাতে হন হন করে ছুটলাম বাজারের দিকে। মাছের বাজারের দিকে ঢুকতেই আবার সেই ঠান্ডা স্রোত যেন বয়ে গেল সারা শরীরে। ঠিক আগের মতোই হাতে একটা জ্যান্ত কাতলা নিয়ে ব্রজ বলল, “নিয়ে যান দাদা।” আমি তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বললাম, “ডাব?” একগাল হেসে মাছটা আমার দিকে এগিয়ে ব্রজ বলল, “মাছের দোকানে ডাব খুঁজছেন? এই নিন দ্যাখেন একবার মাছটা।” আমি অর্জুনের লক্ষ্যভেদে মাছের চোখ ছেড়ে ব্রজর হাতে কাটলাম এক চিমটি। “উফ একি করছেন দাদা। আপনার কী হয়েছে বলুন তো, শরীর ঠিক আছে তো। আমি তো আপনাকে জম্মে কোনদিন ঠকাইনি তাহলে এই চিমটি!” প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে মনে মনে ভাবলাম সত্যি শরীরটাই বড় ক্লান্ত হয়েছে মনে হয়। তাই রাতে ওই সব গোলমেলে ব্যাপার হল আর বাকি গোলমাল শোয়ার আগে ওই “পাঁচ ভূতের কারবার” গল্প সংকলন গেলার জন্য।