তিন প্রহরী

মধ্যমগ্রাম, কলকাতা

                     ১
আজ দীনেশের ফাঁসি। সকাল হতে না হতেই এই খবরটা তাঁর কাছে বয়ে এনেছে ভারী বুটপরা কয়েকজন জেল কর্মচারী ও একজন ব্রিটিশ গোয়েন্দা আধিকারিক। এমনটা যে হবে তা দীনেশের অবশ্য অজানা ছিল না। প্রায় পাঁচমাস আগেই দীনেশকে কনডেমড্ সেলে রাখা হয়েছে। এই সেলে যখন দীনেশকে ঢোকানো হয়েছিল, তখনও কোর্টে তাঁর কেসই ওঠেনি। কনডেমড্ সেলে ঢোকার অর্থই হল নির্ঘাত ফাঁসি। মহাকরণ অভিযানের দুঃসাহস দেখাতে পারে যেসব তরুণ দল, তাদের মুক্তি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের নিকেশ করা যায় ততই মঙ্গল, আর তাই সেই মৃত্যুর প্রক্রিয়াও অতি দ্রুত এবং গোপনে সেরে ফেলতে চাইছেন কারাকর্তৃপক্ষ। জেলের বড় বড় উঁচু পাঁচিলের বাইরে যাতে সেই খবরের ঢেউ আছড়ে না পড়ে সেদিকেও তাঁদের কড়া নজর। বিপ্লবীদের এই মৃত্যু তবুও গণচেতনা গড়ে তোলে। এত সতর্কতা সত্ত্বেও তাঁদের খবর দাবানলের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেই কর্মকাণ্ড নতুনদের উদ্বুদ্ধ করে। এবং এটাই ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের মাথাব্যথার কারণ।
তিনটি অসমবয়সি তরুণপ্রাণ। বিনয়কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশচন্দ্র বসু। বয়সে সব থেকে বড় হল বিনয়, তারপর বাদল ও দীনেশ। সামান্য রিভলভার হাতে আঘাত হানতে ঢুকে পড়েছিল ওরা খোদ ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও প্রশাসনের সদর দপ্তর মহাকরণে। সেদিন হতচকিত হয়ে গিয়েছিল পুলিশকর্তারা।

দীনেশ সকালে স্নান সেরে ওর সেলের ভেতর বসে রোজকার মতো গীতার কয়েকটা অধ্যায় পাঠ করছিল। তার সামনে একটা সাদা দেওয়াল। অনেক উপরে ঘুলঘুলির মাথায় সূর্যের আলোর আনাগোনা সময়ের হিসেব দেয়। মাঝে মাঝে দু একটা চিঠি লেখা ছাড়া আর কিছুই কাজ নেই। ঘরে সঙ্গী বলতে একটা করে কলাইয়ের থালা-বাটি আর এক বালতি জল। মগ পাওয়া যায় না। বাটিটাই স্নান ও খাবার পরিবেশনে ব্যবহার করতে হয়। ফাঁসির কথা ঘোষণা করে চলে যাওয়ার সময় অফিসার তার দিকে তাকিয়ে মুখের অভিব্যক্তি পড়ার চেষ্টা করল। দীনেশের মুখ ভাবলেশহীন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার তাকে গুডমর্নিং বলতে দীনেশ মৃদু হেসে তাকে প্রত্যাভিবাদন জানাল। অফিসারটি বিস্ময়ে একেবারে হতবাক! তার মুখভঙ্গীতে তা আর অপ্রকাশ্য রইল না।
আজ গভীর রাতে ভারতীয় রীতিতে ৬ই জুলাই মধ্যরাত্রি, অথবা ইংরাজি মতে ৭ই জুলাই, ১৯৩১ সাল – দীনেশের ফাঁসি হতে চলেছে। সকালবেলায় এসে আসন্ন মৃত্যুর খবর শোনানোর অর্থই, মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। নাহ্! দীনেশ এই চক্রান্তে পা দেবে না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে গীতাপাঠ শেষ করল। জলখাবার খেতে খেতে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে সে। সে ঈশ্বর বিশ্বাসী। দীনেশের মনের গভীরে তাঁর নিত্য অধিষ্ঠান।
দীনেশ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সাদা দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসল। নিজের জন্য সে কিছু চাইতে পারল না! সব ছাপিয়ে তার মায়ের মুখটা সামনে এসে দাঁড়াল। দীনেশের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এই প্রথম তার চোখে জল এল। সে জানে তার মৃত্যুর এই খবর অনেকদিন পর্যন্ত মাকে দেওয়া হবে না। তিনি অনেকদিন পরে যখন জানবেন, যে তাঁর আদরের নসু আর নেই, তখন মায়ের সেই বুকফাটা আর্তনাদ যেন দীনেশ এখনই শুনতে পাচ্ছে। সে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলল, “ঠাকুর আমার মাকে তুমি কিন্তু দেখো। আমি দেশমাতার কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছি। জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি কোনো কর্তব্যই করতে পারিনি। মাকে তুমি শক্তি দিও। তাঁকে শান্তিতে রেখো।”
দিন কয়েক আগেই সে মায়ের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছিল একটা। এখনও তা পাঠানো হয়নি। চিঠির তারিখ ৩০শে জুন, ১৯৩১। মাকে দীনেশ লিখেছিল, “তুমি হয়তো ভাবছো, তিনি পাষাণ। কারো বুকভাঙা আর্তনাদ তাঁর কানে পৌঁছায় না। ভগবান কী? আমি তা জানি না। তাঁর স্বরূপ কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় কিন্তু তবুও এই কথাটা বুঝি, তাঁর দৃষ্টিতে কোনও অবিচার হতে পারে না। তাঁর বিচারঘরের দ্বার চিরকাল খোলা। নিত্যই সেখানে তাঁর বিচার চলছে। তাঁর বিচারের উপর অবিশ্বাস করো না। সন্তুষ্টচিত্তে তাঁর বিচার মাথা পেতে নিতে চেষ্টা করো। কী দিয়ে যে তিনি কী করতে চান, তা আমরা বুঝবো কেমন করে!”
দীনেশ ভাবতে থাকে, এই চিঠিটাও হয়তো মা তার মৃত্যুর অনেকদিন পরে পাবেন। বাড়ির সবার কথা মনে পড়ছে তার। কারো সঙ্গেই বহুকাল দেখা হয়নি। স্নেহময়ী বউদিদির মুখটাও মনে পড়ছে দীনেশের। কত হাসি-গল্প মজা সে বউদিদির সঙ্গে করত! ডাক্তারদাদাও এসে তাতে মাঝে মাঝে যোগ দিতেন। বাড়ির কেউ এখানে বেশি আসে না। এখানে তাকে বদ্ধকূপে বন্দি দেখতে তাদের যে ভালো লাগে না, তা দীনেশ বোঝে। তবে আর বন্দিত্ব নয়, এবারে মুক্তি ঘটবে তার অনন্তলোকে। 
ধীরে ধীরে দিন শেষ হয়ে রাত নেমে এল। কিছুতেই ঘুম এল না দীনেশের। সে বিছানার উপর বসে কিছুক্ষণ ধ্যান করার চেষ্টা করল, তবে তেমন মন বসল না। অনেক আগেই রাতের খাবার দিয়ে গেছে। এবার নীরবে রাতের খাবার খেয়ে দীনেশ চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল। এখন অপেক্ষা কেবল মৃত্যুর জন্য। 
একটু পরেই কয়েকটা ভারী বুটের শব্দ সে আবার শুনতে পাবে। তারা তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যেতে আসবে। প্রতীক্ষা করতে থাকে। সময় যেন আর কাটতেই চাইছে না। অন্যমনস্ক দীনেশ একটা সাদা কাগজে ইংরাজীতে কয়েকটা কথা লিখল।
“I am the son of God. He is my Supreme and Ultimate aim. He is the Truth and I want to be one with him in everlasting love.”
কয়েকদিন আগেই তার উনিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। মায়ের কথা ভেবে সে আবার কাগজের টুকরোটাতে আরও কয়েক ছত্র লিখল।
“To die for me, no terror holds
Yet one fear presses on my mind,
Much I fear that over my corpse
The scalding tears of my mother shall flow.”
দীনেশের ভয় তার শবের উপরে তার মায়ের তপ্ত অশ্রুর ফোঁটা পড়বে!
কিছুক্ষণ পরেই তাকে প্রথামতো স্নান করানো হল। ঋজু ও সুঠাম তার দেহ। পরনে জেলের পোশাক। হাতে লোহার বেড়ি। দৃঢ় পদক্ষেপে বধ্যভূমির দিকে হেঁটে চলেছে দীনেশ। রাজনৈতিক বন্দিরা কেউ কেউ হয়তো খবর পেয়েছে। দূর থেকে অস্পষ্টভাবে দীনেশ শুনতে পেল তাদের কন্ঠের বন্দেমাতরম্ ধ্বনি। হঠাৎ তার কানের কাছে কারা দুজন যেন দুপাশ থেকে বলে উঠল, “বন্দেমাতরম্!, ভারতমাতার জয়!” কে? কারা তার পাশে? তার পাশে তো পুলিশের উর্দিধারী কয়েকজন কনস্টেবল। কারা জয়ধ্বনি দিল তবে? তার ডানপাশ থেকে এক যুবাকন্ঠ বলে উঠল, “চিনতে পারলে না? আমি বিনয় বসু। তোমার বিনয়দা।” আর একপাশ থেকে অপর যুবকের কন্ঠ বলল, “আমি বাদল গুপ্ত, বাদলদা! চলো এবার আমরা তিনজন একসাথে থাকব। এখনও অনেক কাজ যে বাকি আছে।”
“কাজ?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ফেলল দীনেশ।
“নিশ্চয়! সব পরে বুঝিয়ে বলব তোমাকে। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো দুজনে। বলল ওরা, “আগে দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হও। কোনো ভয় নেই! আমরা তোমার পাশে আছি। ওই তো দেখো! ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, গোপীমোহন সাহা, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস সবাই এসেছেন এখানে আজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে। বাংলা থেকে কত বীর এই তরুণেরা ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদান দিয়ে ভারতমাতাকে গর্বিত করেছে।”
দীনেশ এবারে দেখতে পেল সবাইকে। আনন্দে আত্মহারা সে! সে-ও আজ চিরকালের মতো বাংলার বিপ্লবীদের দলের মধ্যে অমর হয়ে সৃষ্টি করতে চলেছে এক নতুন ইতিহাসের। দীনেশ বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল,“বন্দেমাতরম্!” বদ্ধভূমিতে তার কন্ঠ অনুরণিত হয়ে ফিরে এল “বন্দেমাতরম্!” বাতাস শুদ্ধ হল। জেলের মাটি পবিত্র হল। ফাঁসুরে তার মুখটা কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়ে গলায় ফাঁসির দড়ির ফাঁস পরিয়ে দিল। তারপর হাতলে চাপ দিতেই দীনেশের পায়ের নীচের পাটাতনটা সরে গেল। তার সুন্দর দেহটা মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে উঠে নেমে গেল নীচের অতল অন্ধকারে। সহর্ষে বহু বিপ্লবীরা জয়ধ্বনি দিল। কিন্তু সেই জয়ধ্বনি কেউ শুনতে পেল না, কারণ সেখানে উপস্থিত বিপ্লবীদের সকলেই বিদেহী।
 
                                                 ২
গভীর রাত।  ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের এক রাতের ঘটনা। একটা কালো হুন্ডাই গাড়ি থেকে নেমে এল শমিত, শুভো আর রনো। শমিতের হাতে একটা ল্যাপটপের ব্যাগ। শুভো আর রনোও হাতে ব্যাগ নিয়ে ধীর পদক্ষেপে একটা নৈশ ক্লাবের ভেতর ঢুকে পড়ল। শুভর ব্যাগে আছে আঁটিবাঁধা কয়েক গোছা পাতার বাণ্ডিল। এ এক বিশেষ ধরণের পাতা। দেখতে অতি সাধারণ কলাবতী ফুলের পাতার মত। তবে পাতাগুলো কিছুটা মোটা ধরণের। এর নির্যাস বিয়ার বা অ্যালকোহলের সঙ্গে মিশলে তার ফল হয় ভয়াবহ। যে খাবে, সে নিজের অজান্তেই জ্ঞান হারাবে, এবং তার জ্ঞান হারানোর আগেকার তাৎক্ষণিক কোনো পূর্বস্মৃতিও থাকবে না। নৈশ ক্লাবগুলোর অন্দরে কিছু অসাধু কর্মীর দল এই পাতা শমিতদের কাছ থেকে কিনে সংগ্রহ করে রাখে। নার্কোটিক হিসেবে চিন ও সিঙ্গাপুরের এই পাতার এখন এদেশে বিরাট রমরমা বাজার। বড়লোকের বখাটে ছেলেরা হল এর খদ্দের। মেয়েদের এই ড্রিঙ্ক একবার খাওয়াতে পারলেই সম্পূর্ণ প্রতিরোধহীন নারী সম্ভোগ। পরদিন মেয়েটির স্মৃতি না থাকায় কিছুই প্রমাণ হয় না। ফলে নির্বিচারে শুধু ভোগ আর ভোগ। কলকাতার কামুক পুরুষদের নতুন তুরুপের তাস হল এই পাতা। শমিতের দল চড়া দামে এই জিনিস সরবরাহ করে। তাদের কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত। সে কথায় যাবার আগে তাদের তিনজনের সম্পর্কে টুকটাক তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
ওরা তিনজনই কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজের মেধাবী ছাত্র। কলেজ হোস্টেলে এসেই তিনজনের বন্ধুত্ব শুরু, কয়েকটা বিষয়ে মিল থাকায় তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। যেমন ওরা তিনজনেই সাহিত্য ভালবাসে। গল্পের বইয়ের পোকা। বিদেশি সাহিত্যের পাশাপাশি হাল আমলের থ্রিলারধর্মী উপন্যাসও তারা পড়তে ভালবাসে। কলেজের পর তিনজন সেদিন কলেজস্ট্রিটের কফিহাউসে বসে তুমুল সাহিত্য আলোচনা চালাচ্ছিল, সেই সময় তাদের টেবিলে এসে একটা অল্পবয়সী ছেলে আলাপ করতে চাইল। ছেলেটির কথায় অবাঙালি টান স্পষ্ট। নাম যদিও চন্দন জানা, তবে ও নাকি প্রবাসী বাঙালি। আগে বিহারে থাকত। ছেলেটা ওদের সবাইকে চিকেন চাউমিন খাওয়াল। দু একদিন পরে তাদের আলাপ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে পৌঁছাল। তখনই চন্দন তাদের তিনজনকে একটা কাজের প্রস্তাব দিল। এয়ারপোর্ট থেকে এক জায়গাতে কিছু জিনিস এনে দিতে হবে। এনে দিলেই হাতে হাতে অনেক টাকা। তাছাড়াও কাজটা করলে ওদের সবাইকে ল্যাপটপ দেবে বলেও জানাল চন্দন। 
মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তারা। বাড়িতে সবারই টাকার টানাটানি। কাজের অফারটা তারা নিয়ে নিল। তিনজনেই বুঝতে পারছে কাজটা বেআইনি, তবুও লোভের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ তারা কেউই এড়াতে পারল না। এভাবেই তারা তিনজন, মাত্র উনিশ বছর বয়সে একটা আন্তর্জাতিক ড্রাগ পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। তারা যেখানেই যায়, তিনজন একসঙ্গেই যায়। দলে তাদের তিনজনকে তাদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী ডাকা হয়, শ্বশুর। যদিও শমিত এর নামের আদ্যাক্ষর শুধুই শ। তবুও দলে ওটাই তাদের কোডনেম হয়ে গেছে। 
তাদের দলের আরও নানা কর্মকাণ্ডের কথা তখনও শমিতরা জানত না, জানতে পারল আরও কিছুটা পরে। দলের কাজে সব সময় চরম গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। তাই দলের নানা ধরণের কাজের বিষয়ে তারা বেশিকিছু জানতে পারে না। অল্পদিনের মধ্যেই তাদের সবার হাতে চলে এল দামি স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ আর সেই সঙ্গে অনেক টাকা। এয়ারপোর্ট থেকে কোনো ব্যাগ নিয়ে আসা, কিংবা ভাড়া গাড়িতে চেপে জেলার কোনো শহরে কোনো প্যাকেট দ্রুত গিয়ে পৌঁছে দেওয়া এইসবই করতে হয়েছে তাদের প্রথমদিকে। এয়ারপোর্টে আগে থেকেই ব্যবস্থা করা, তাদের তিনজনকে কখনও কিছু বলা হয়নি। কখনও গুপ্তা ট্রাভেলস্, কখনও দাশগুপ্ত ট্রাভেলস লেখা বড় বড় দু তিনটে ভারী ব্যাগ এসে পৌঁছায় লাগেজ বেল্টে। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেই পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইভেট গাড়িতে সেই ব্যাগ তুলে দিলেই তাদের ছুটি। ব্যাঙ্কে নির্দিষ্ট টাকা তাদের নামে জমা পড়ে যায় সেদিনই।
কলেজে শমিতের একটা মেয়েকে বেশ ভাল লাগে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়েটি। তাদের কলেজেই অন্য বিভাগে পড়ে। বড় বড় দু’চোখে সরলতা মাখা। শমিত যেচেই আলাপ করে ফেলল। ওর নাম হল জয়িতা। বাবা বিরাট ব্যবসায়ী। শমিত হাল ছাড়ে না। এখন তো ওরও পকেট বেশ গরম! সুতরাং আলাপ ক্রমেই গাঢ় হতে শুরু করল ওদের। শমিত দুহাতে খরচ করতে লাগল। একদিন জয়িতাকে নিয়ে শমিত ভিক্টোরিয়ার আশপাশ ঘুরতে গেল। 
হোস্টেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে ফেরার পর থেকে শমিত কেবল জয়িতার কথাই ভাবছে। এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠল। দলের উপর মহলের ফোন। শমিত জানে এই লাইনের শর্ত হল কোনো বিশেষ নারীর প্রতি দুর্বলতা থাকা চলবে না। নারী সম্ভোগে দলের আপত্তি নেই, তবে কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখা চলবে না। শমিতকে বলা হল, জয়িতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করতে হবে অবিলম্বে। শমিত বুঝতে পারল, সে ক্রমশঃ একটা আঠালো পাকে জড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে অন্ধকারের অতলে ডুবে যাচ্ছে।
কয়েকদিন থেকেই শমিত জয়িতার সঙ্গে কলেজে কথা বলা বন্ধ করেছে। সে এমনকী তার ফোনও ধরে না। জয়িতাকে ফলো করা হচ্ছে, শমিত এটা জানে, আর যাইহোক সে চায় না, জয়িতা কোনো বড় বিপদে পড়ুক। শমিতের জয়িতার জন্য চিন্তা হতে থাকে। অবশেষে তার চিন্তাকে সত্যি প্রমাণ করল একটা সাম্প্রতিক ঘটনা। জয়িতা শমিতকে না পেয়ে শুভকে ফোন করল একদিন। শুভ ফোন এনে দিল শমিতকে। শমিতকে খুব দরকারী কয়েকটা কথা বলতে চায় জয়িতা। ফোনটা ধরল শমিত। 
ফোনের ওপারে কান্নায় ভেঙে পড়ল জয়িতা। সে যা বলল, তার সারমর্ম হল, জয়িতা গতরাতে তার বন্ধুদের সঙ্গে একসঙ্গে বান্ধবীর বাড়িতে পার্টিতে গিয়েছিল। সেখানে একটা ককটেল খেয়েই হঠাৎই তার খুব ঘুম পায়। তারপর কী হয়েছে আর তার কিছু মনে পড়ছে না। ঘুম ভাঙতে সে দেখেছে সে বাথরুমের ভেতর পড়ে আছে। পোশাক বলতে গায়ে প্রায় কিছুই নেই। সারা শরীরে ব্যথা। গায়ে বিভিন্ন জায়গায় আঁচড় ও আঘাতের চিহ্ন। সেদিন কোনোরকমে সে বাড়ি ফিরে আসে। পরদিন অজানা নম্বর থেকে তার মোবাইলে একটা নগ্ন মেয়ের ফটো পাঠানো হয়। মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠেছে জয়িতা। কারণ সেটা তারই ফটো। বর্তমানে ভয়ে ও লজ্জায় কুঁকড়ে তার দিন কাটছে। সেই রাতের কোনো স্মৃতি না থাকায় সে কিছুই করতে পারছে না। লজ্জায় ও ঘৃণায় সে বর্তমানে আতঙ্কের এক দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে।
শুনতে শুনতে শিউরে উঠল শমিত। সে বুঝতে পারল, সেই বিশেষ ধরণের নার্কোটিকই জয়িতার ককটেলে মেশানো হয়েছিল। সে সহসা সান্ত্বনার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। বুঝতে পারল তাদের দলের হাত অনেক লম্বা। সে যদি এই ধরণের কাজ না-ও করে তবুও তার মতো হাজারটা শমিতকে এরা ঠিক খুঁজে বের করবে। এদের থামিয়ে রাখা সহজ নয়। এদের ভয়ঙ্কর চক্রকে তাই মুছে ফেলা বোধহয় সম্ভব হবে না। শমিত বুঝতে পারে তাকে শুভো আর রনোর সঙ্গে এখনই কথা বলতে হবে। কিছু একটা করা দরকার এক্ষুণি।
শমিত, শুভো আর রনোর সঙ্গে কথা বলে বুঝল, ওরাও এদের হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়। ধরা পড়লে কী হবে? এই আতঙ্ক চেপে বসেছে ওদের সবার মনে। জয়িতাকে কি ইচ্ছে করেই বেছে নেওয়া হয়েছে? শমিতকে উচিত শিক্ষা দিতে?
ওরা তিনজন পরবর্তী মাল ডেলিভারি নিতে এয়ারপোর্টে গেল না। তার পরিবর্তে ওরা তিনজন দীঘার বাসে চেপে শহর ছাড়ল। যদিও ওরা জানে এভাবে ওদের হাত এড়ানো যাবে না। তিনজনের ফোনেই অজস্র কল্ আসতে লাগল। সন্ধ্যার দিকে শমিত ফোন ধরতেই তাকে বলা হল, এই মুহূর্তে এসে দেখা করতে হবে। নাহলে তাদের বাড়ির লোকেরা কেউ জীবিত থাকবে না। ওরা কেউই নিজেদের বাড়ির ঠিকানা কখনও দেয়নি। কিন্তু আশ্চর্যভাবে দল তাদের বাড়ির ঠিকানা এবং পরিজনদের নাম পর্যন্ত জানে! তাদের যাবতীয় তথ্য দলের হাতে। অবশেষে কলে পরা ইঁদুরের মত তিনজনেই একসঙ্গে ধরা দিল।
শমিতরা অনেক ভেবে অবশেষে সবাই ঠিক করেছে, তারা আপাতত দলের কাজ করবে। মিছিমিছি নিজেদের ও পরিবারের জীবন বিপন্ন করার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া তারা টাকা পয়সা ও যাবতীয় শখের জিনিসপত্রও তো পাচ্ছে। সুতরাং তুচ্ছ সততার ভূতের গলা টিপে ধরলেই নিশ্চিন্তে এইসব কাজ করা যাবে। অতএব ওরা এখন কেউ বিদ্রোহ করছে না আর।
তবুও ওদের সেই পালানোর ঘটনার পর থেকেই দল ওদের প্রতি খুব রুষ্ট। তাদের আর সুনজরে দেখছে না দলের উপর মহল। ওদের একটা চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে হঠাৎ। কাজটা করলে তাদের তিনজনকে ইউরোপ ট্যুর আর অনেক টাকার লোভ দেখানো হয়েছে। না করতে পারলে অবধারিত মৃত্যু। কাজটা দেশবিরোধী সন্ত্রাবাদীদের কাজ।
এতদিনে শমিতরা বুঝে গেছে তাদের দল বিদেশের অর্থ সাহায্যে এদেশে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালায়। মফস্বলের তিন বাঙালি ছাত্র হঠাৎই ওদের দলে যুক্ত হয়ে গেছে। বেশ কয়েক মাস ধরে তাদের দিয়ে সীমান্তবর্তী জেলা যেমন মুর্শিদাবাদ, উত্তর চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরক পাচার করানো হয়েছে।
পরবর্তী কাজ হল কলকাতার বুকে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করা। বিশেষত বিস্ফোরণগুলো ঘটানো হবে ১৪ই আগস্ট শেষ রাতে, যাতে কলকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৫ তারিখের বিশেষ দিনের সকালে শহর জুড়ে ব্যাপক এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। 
শমিত, শুভো আর রনিত অর্থাৎ শ্বশুরকে দিয়েই এই কাজটা করাতে চাইছে দল। কারণ বিক্ষুব্ধ কর্মীদের দল হয় মেরে ফেলে নাহলে তাদের এমন কাজ দেওয়া হয়, যাতে তারা নিজেরাই কাজটা করতে গিয়ে মারা যায়। তাছাড়া শমিতরা দলের নীচুতলার কর্মী। ধরা পড়লেও দলের বিশেষ ক্ষতি হবে না।
                                
                                                  ৩
১৪ ই আগস্ট। রাত বারোটা বাজে। তাদের কাজ শুরু হল। শমিত শুভ আর রনো এখন এসে উপস্থিত হয়েছে মহাকরণের সামনে। এখানে তাদের বিস্ফোরক রাখতে হবে। এ ছাড়া জনবহুল বহু জায়গায় রাখতে হবে বিস্ফোরকের ব্যাগ। ব্যাগ থেকে বিস্ফোরণ করানো হবে রিমোটের মাধ্যমে। কত শত মানুষ যে এর ফলে মারা যায়বে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। শমিতের সবথেকে খারাপ লাগছে মহাকরণে বিস্ফোরণ ঘটাতে। কত ঐতিহ্যবাহী এই বিল্ডিং! ঢোকার মুখেই গেটের সামনে বসানো আছে বিনয়, বাদল দীনেশের মূর্তি। কত ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা তিন অসীম সাহসী বীরের দল এখানে এসেছিলেন আত্মবলিদান দিতে, আর তারা! সেই বাঙালি হয়েও এখানে আজ এসেছে চোরের মত গোপনে বিস্ফোরকের ব্যাগ রাখতে! তারপর গোপনেই রিমোটে বিস্ফোরণ ঘটাবে। ছিঃ! 
যদিও আজকাল নিজেদের মন ওরা স্থির করে ফেলেছে অনেকদিন ধরেই। নিজেদের স্বার্থরক্ষাই তাদের কাছে এখন বড়। আজকাল দেশ ও মানুষের স্বার্থ ওরা আর নিজেদের থেকে বড় করে দেখে না। কিন্তু আজ কেন যেন শমিতের মনটা খুব খারাপ লাগছে। শুভো আর রনোরও একই অবস্থা। ওরা নিজেরা মনে মনে নিজেদের গালি দেয়! বলে “স্বার্থপর! বেজন্মা!” তবে কেউই মুখ ফুটে কিছু বলে না ওরা। পেছনেদিকে বাথরুমের জানলা দিয়ে ওরা বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকে পড়ল। তারপর ঘুরপথে সিঁড়ির সামনে চলে এল। হঠাৎ অদৃশ্য থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে তিনজন যুবক তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মাঝখানের ছেলেটির শরীর লম্বা ও মোটা, পাশের দুজন রোগা ছিপছিপে। ধারালো চোখমুখ। মাঝখানের ছেলেটি কড়া গলায় ওকে বলল, “কী চাই?” 
শমিত অবাক হয়েছিল হঠাৎ ওদের দেখে। সে ভালো করে তিনজনকে একবার দেখল। ওদের বয়স কম বেশি প্রায় সমান, ঠিক ওদের তিনজনের মত। চেহারা যাইহোক, এই যুবকদের পোশাকআশাক যেন কেমন পুরনো দিনের মত। যদিও ওরা সবাই সাহেবি কেতার কোট-প্যান্ট পরেছে, তবে মাথায় অমন বাঁকানো লম্বা হুডের টুপি আজকাল কেউ পরে না। সে উদ্ধত ভঙ্গীতে জবাব দিল,
“আপনারা কারা?”
মাঝখানের যুবকটি চড়া গলায় বলল,
“আমি বিনয় বসু, আর ওরা আমার সঙ্গী বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত।”
শমিত চমকে উঠলো। সিঁড়ির সামনে জ্বলতে থাকা মৃদু লাল আলোয় সে দেখতে পেল সত্যিই যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এই তিনজন। তার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। শমিত বিস্ময়ভরা গলায় বলে উঠল,
“বিনয়- বাদল – দীনেশ! কলকাতার বিখ্যাত রাস্তার নাম এখন বিবাদী বাগ।”
শুভ আর রনো দৌড়ে বাইরে পালাতে গেল। কিন্তু ওদের যাওয়া হল না। তিনজন ওদের ঘিরে দাঁড়ালো। দীনেশ বলল,
“আমাদের এখনও ছুটি হয়নি। তখন এই দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছিল ইংরেজরা আর এখন দেশেরই কিছু স্বার্থলোভী মানুষ! আর হ্যাঁ, তাদের মধ্যে আছো তোমরাও! আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে তোমরা বাঙালি। এত লোভ তোমাদের? কটা টাকার লোভে নিজের দেশ, নিজের শহরের সঙ্গে বেইমানি করো? এইজন্যই কি আমরা প্রাণ দিয়েছিলাম? কাল সকালে এমন একটা স্বাধীনতা দিবস দেখব বলে?”
বাদল গুপ্ত চুপ করে ছিল। এবার সে কথা বলল। বলল,
“কলকাতার নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন আমাদের কাঁধে। তোমাদের মত লোভী ছেলে ছোকরাদের হাতে এই শহরটা কবেই শেষ হয়ে যেত। আমরা থাকতে তা হতে দেব না। আমরা আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে ভালবাসি। আমৃত্যু ভালবেসেছি এবং মৃত্যুর পরেও ভালবাসি। যতদিন না কিছু উপযুক্ত তরুণদের আমাদের পাশে পাচ্ছি, ততদিন আমাদের মুক্তি নেই। সেই ১৯৩১ সাল থেকে আমরা শহর কলকাতাকে পাহারা দিচ্ছি। আজও আমরা এই শহরের প্রহরী। কখনও কোনো ক্ষতি হতে দিইনি, আজও দেব না।”
তিজন একসঙ্গে বলে উঠল,
“আজ আমাদের হাত থেকে তোমাদের মুক্তি নেই।”
বিনয় বলল, “আমি দলনেতা হিসেবে কম্যান্ড করছি ওদের শেষ করে দাও। দেশের শত্রু নিপাত যাক।”
শমিতরা সমস্বরে বলল,
“না স্যার, আমাদের একটিবার সুযোগ দিন। এ কাজে আমরা প্রথমে ইচ্ছুক ছিলাম না। আমরা ছেড়ে দেবার চেষ্টাও করেছিলাম। স্বীকার করছি, আমরা লোভী। এরপর আপনাদের যা মনে হয় করুন!”
হঠাৎ যেন একটা জোর ধাক্কা খেয়ে তিনজনেই লাফিয়ে উঠল। কালো হুন্ডাই গাড়িটা মহাকরণের পাশের গলিতে রেখে তিনজনেই অন্ধকারে গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছিল এতক্ষণ। তবে সব থেকে আশ্চর্য এই যে তিনজনেই ওরা একই স্বপ্ন দেখেছে।
শমিত ওদের গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। সবে ভোর হয়ে আসছে। বিস্ফোরকের সব ব্যাগগুলো ওরা মাঝগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। ভারী ভারমুক্ত মনে হচ্ছে এখন ওদের। তিন মৃত্যুবিজয়ী বীর বিনয়-বাদল-দীনেশ এসে ওদের মৃত্যুভয় দূর করে দিয়েছে। আজ ১৫ই আগস্ট। না হয় শহর আর দেশের সবার মঙ্গলের জন্য ওদের তিনটে তুচ্ছ প্রাণ যাবে! আর ভয় পায় না ওরা।

1 Response

  1. সুরশ্রী ঘোষ সাহা says:

    ভালো লাগলো

বৈশাখী ২০২৪