আজ বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি, কলকাতা ভাসছে। অনুরূপার আজ আবার কাজের চাপ একটু বেশি, পরশুই দিল্লির হেড অফিস থেকে নির্দেশ এসেছে একটি বিশেষ কোম্পানির ইনভয়েসগুলো দু’দিনের মধ্যে সিস্টেমে এন্ট্রি করে দেওয়ার জন্য। এটা খুব কঠিন একটা কাজ, সংখ্যায় এক চুল এদিক ওদিক হলেই চাকরি নিয়ে টানাটানি। অবশ্য অফিসের আইটি ডিপার্টমেন্টের দৌলতে অনেকটাই স্বস্তিতে আছে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টগুলো। ব্রত বলে আইটির ছেলেটি খুব হাসিখুশি আর ডাকলেই "দিদি, বলো" বলে তার কেবিনে এসে হাজির হয়। "এই একটু দেখ না রে, একটা ইনভয়েস দুবার দিয়ে ফেলেছি, কোনটা ডিলিট করব ঠিক বুঝতে পারছি না!" "ওহ্, এই ব্যাপার, এ তো জলভাত। এই দেখো, আমি ডেট টাইম মিলিয়ে ডিলিট করলাম, আর দাঁড়াও ডেটাবেসে গিয়ে অন্যান্য ফাইলে কিছু ইমপ্যাক্ট হয়েছে কিনা তা ও দেখে নিচ্ছি। তুমি চিন্তা কোরোনা।" "থ্যাংকস রে, তুই না থাকলে কী যে হতো!" সারাক্ষণ মাথাটা জট পাকিয়ে থাকে অনুরূপার। মাথার আর দোষ কী, বাড়িতে যে অসহায় দুটো চোখ তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। ছ মাস আগে বিকাশের সঙ্গে তার প্রায় চার বছরের সম্পর্কে ইতি টানতে হয়েছে, বিকাশ আর অপেক্ষা করতে নারাজ। সেদিন অনুরূপা বড্ড একা হয়ে গেল, এই একাকীত্বের চেয়ে ভয়াল আর কিছু আছে নাকি? বাড়িতে এক প্রাণী আছেন বটে, কিন্তু তাঁকে কি সঙ্গী বলা চলে? তাঁর সঙ্গে কি ভাব বিনিময় বা বাক্যালাপ সম্ভব? তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখে অনুরূপা, ইশ, সেই সাতটা বেজে গেল ... আবার চার্টাড বাসটা মিস করে গেল। মাসে মাসে বেশ অনেকগুলো টাকা যায় বাসের ভাড়া হিসেবে, তারপরেও যেদিন অফিসের চাপে বাস মিস করে ট্যাক্সি ধরে ,আরো গুচ্ছের টাকা গচ্চা দিতে হয়। সেদিন মেজাজটা খিঁচড়ে থাকে বৈকি! আজ আবার ডালহৌসি পাড়ায় জল জমবে, ট্যাক্সি পাওয়াও মুশকিল হবে। কম্পিউটারটা শাট ডাউন করে একবার বাথরুম সেরে নেবার জন্য এগিয়ে যায় অনুরূপা। মেয়েদের বাথরুমটা করিডোরের একদম অন্য প্রান্তে, হয়তো মহিলাদের আব্রু রক্ষার কথা চিন্তা করেই কর্তৃপক্ষ একটু দূরে রেখেছেন বাথরুমটি। সারা অফিসে এখন দুটি মাত্র লোক, গেটে সিকিউরিটি, আর্মি থেকে অবসরপ্রাপ্ত মধ্যবয়সী অসীমবাবু আর অন্য প্রান্তে পারচেজ ডিপার্টমেন্টের বিশাল হলের মাঝে মাথা গুঁজে একমনে কাজ করে চলেছেন প্রৌঢ় কাঞ্চনবাবু। করিডোরটা খোলা, গ্রিল দিয়ে মোড়া, বাথরুম যেতে গিয়ে পা ভিজে গেল আর সেই সঙ্গে বাইরের জলের ঝাপটা চোখে মুখে এসে লাগল, একটা শীতল হাওয়া সারা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুললো অনুরূপার। বাথরুমের আলোগুলো কে যেন নিভিয়ে দিয়েছে, সে অভ্যস্ত হাতে দরজার ডান দিকের সুইচে হাত ঠেকাতেই প্রবল ধাক্কায় ছিটকে বাইরে পড়ল। কে ধাক্কা মারল! কেউ কি তাহলে ভেতরে লুকিয়ে আছে? এবার অন্য এক ভয় গ্রাস করলো অনুরূপাকে। ব্রিটিশ আমলের অফিস বিল্ডিং, এত বড় বড় ঘরগুলো যে এখান থেকে চ্যাঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। কানাঘুষো চলতেই থাকে যে অমুক দিন অমুকে ভূত দেখেছে, সন্ধে হতেই সবাই পাততাড়ি গুটিয়ে হাওয়া। ওদিকে অসীমবাবু আবার এমনিতেই একটু কানে কম শোনেন। ভিজে করিডোরে আছাড় খেয়ে অনুরূপার কোমরটা একটু বেহাল, কোনমতে ছেঁচড়ে গিয়ে করিডোরের গ্রিলটা হাতড়ে ধরে উঠে দাঁড়ায় অনুরূপা। ওর এমনিতে ভূতের ভয় টয় কিছু নেই কিন্তু এই বিকাশের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এক অন্য আতঙ্ক ঘিরে রাখে তাকে। রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় বিকাশ গাড়ি নিয়ে ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি অপেক্ষা করত, অনুরূপা একটা বাস নিয়ে সেখানে উপস্থিত হত। কিছুটা সময় দুজনে ময়দানে হাঁটত, টুকটাক কিছু খেয়ে আবার বিকাশের গাড়িতে উঠে পড়ত। বিকাশ তাকে বাড়ির কাছাকাছি গলির মোড়ে নামিয়ে দিয়ে যেত। বিগত কয়েক মাস বিকাশ ওকে বিয়েতে রাজী করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, একই কথা, "তোমার যাবতীয় দায়িত্ব তো আমি নেব বলেছি, তবু তুমি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছ কেন? আর কত দিন অপেক্ষা করব আমি বলতো? একটুও কি তোমার দয়া হয় না আমার জন্য?" অনুরূপার ভীষণ ইচ্ছে করত বিকাশের বলা প্রতিটি শব্দকে বিশ্বাস করতে, কিন্তু পারত না, ভয় করত তার, বড্ড ভয়। অপরূপা সুন্দরী না হলেও তার টানাটানা চোখ, পিঠ ছাপানো ঘন কালো চুল আর হাসলেই একটা গজদাঁতের ঝিলিক অনেক পুরুষের মন কেড়ে নিতে সক্ষম। তবু অনুরূপা জানে বিকাশ আজ যা বলছে সেটা নেহাৎই কথার কথা। তার নিজের ভাইই পালিয়ে গেল তো এ কোন মহাপুরুষ! রেলের চাকরি ভাইয়ের, চার বছর আগে বান্ধবীকে বিয়ে করে বেগতিক বুঝে চুপচাপ দুজনে সরে পড়ল আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। সেই থেকে সবটাই একা অনুরূপা সামলাচ্ছে, জানে না কতদিন, কিন্তু সে লড়বে, হাল ছেড়ে দেবে না। আর ঠিক এই কারণেই সে বিকাশকে রেহাই দিল, যেহেতু সে নিজেই জানে না আরো কত বছর চলবে এ লড়াই। কিন্তু বিকাশ চলে যাওয়ার পর থেকে ওর এই চোরা আতঙ্ক, অন্য কোনো পুরুষ যেন ওকে একলা পেয়ে ওর সর্বস্ব গ্রাস করে নিতে চাইবে, অথবা অনেকেই যারা ওর আর বিকাশের সম্পর্কটা সম্বন্ধে অবগত ছিল তারা যেন ভাবছে যে বিকাশ তাকে চেটেপুটে ভোগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে, এবার তাকে যে খুশি কুপ্রস্তাব দেবে - এই সব উদ্ভট চিন্তা কেন যে তার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে তা সে নিজেও জানে না, হয়তো এতগুলো বছরের নিদ্রাহীন নিশিযাপনই এর মূলে, নাকি জিন বাহিত কোনো রোগ চুপিসাড়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে? বুকটা সব সময় ধুকপুক করে, গলা শুকিয়ে যায়, চোখের কোণে কালি। অথচ এগুলো যাঁর সর্বাগ্রে চোখে পড়ার কথা সেই মানুষটাই তো আজ .… অনুরূপা উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ হাতড়ে সেল ফোনটা বার করে টর্চ অন করল, দু একবার "কে ওখানে?" বলে চিৎকারও করল, কোনো উত্তর এল না। এদিকে তলপেটে চাপ ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে, সাহসে ভর করে ঢুকে পড়ল সে সেলফোন হাতে করে। ভেতরটা ঘুটঘুট করছে অন্ধকার, আলোটা চারদিকে ঘুরিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হলো সে। কেউ লুকিয়ে থাকলে এতক্ষণ কি আর তার জন্য অপেক্ষা করত? এই বার সুইচের দিকে এগিয়ে যেতেই সবটা পরিষ্কার হলো তার কাছে, সুইচের বাক্স নড়বড় করছে, অনুরূপার জলে ভেজা হাত ঝুলে থাকা তার অনবধানে ছুঁয়ে ফেলায় এই বিপত্তি। ইশ, কালই ইলেকট্রিশিয়ানকে বলে দিতে হবে ঠিক করার জন্য। বাথরুম সেরে চোখে মুখে জল দিয়ে যেন নতুন জীবন ফিরে পেল অনুরূপা। এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়েই চলেছে, আটটার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে না পারলে কনক মাসী একেবারে কুরুক্ষেত্র বাধাবে। উবার করে বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে কলিং বেলটা যখন বাজালো ঘড়ির কাঁটায় তখন আটটা পাঁচ। মনে মনে ইষ্টমন্ত্র জপতে লাগলো অনুরূপা, "হে ঠাকুর আজ আর কিছু ঘটিও না!" দড়াম করে দরজা খুলল কনক মাসী, মুখ যেন ফেটে পড়ছে। "আমি আর এ চাকরি করতে পারবুনি এই বলে দিলুম।" "ও মাসী আজ পাঁচ মিনিটই তো দেরি হয়েছে, অমন করছ কেন?" "না সেজন্যি নয়, আমার বাপু ভয় করতিচে। আজ দুকুর থেকে ওই কালো মেঘ, তার মদ্যি একবার বাতি চলে গেল, আর মাসিমা ওমনি জানলার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতি লাগলো। যেন কদ্দিনের চেনা কাউরে দেকচে! আমার ভয়ে হাত পা সেঁধোয়ে গেছল। বলি, 'ও মাসীমা, হাসতেচ কেন?' উত্তর নাই। আর সে কত রকম মুখের ভাব। তুমি বলো দিদি, একলা ঘরে এই ঘোর বিষ্টির মদ্যি এসব দেখে ভয় পাবুনি?" অনুরূপা দোষ দেবে কী, সে নিজেও মাঝেমাঝে চমকে ওঠে। মায়ের পঁচাত্তর বছর বয়সে অ্যালঝাইমার ধরা পড়ে। এখন মায়ের আশি। আগেকার দিন হলে লোকে বলত বাহাত্তুরে ধরেছে অথবা ভীমরতি। এখন এ রোগ নির্ণয় সম্ভব কিন্তু নিরাময় সম্ভব নয়। দিনে দিনে সে রোগ মায়ের মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষগুলোতে থাবা বসিয়েই চলেছে। চার বছর আগেও মা তাকে চিনতে পারত, দু একটা কথাও বলত। এখন শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হাঁটা চলা দেখলে মনে হবে সম্পূর্ণ সুস্থ, কিন্তু এক মুহূর্ত একা থাকলেই যেভাবেই থাকুক দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে যাবে। ভাইয়ের বউ কেকা প্রথম এসে দু তিনবার এই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল এবং তারপর থেকেই ভাইকে ক্রমাগত বুঝিয়ে অন্য ফ্ল্যাটে চলে যায়। ভাই বলেছিল, "দিদি তুই তো মাকে সব থেকে ভালো বুঝিস, তুইই পারবি। কেকা এখানে ভয়ে ভয়ে থাকতে পারবে না। আমি ওষুধ আর ডাক্তারের খরচের জন্য যা লাগে দেব।" অনুরূপা ভাবল তাদের মধ্যে অন্তত একজন তো সুখী হোক, বলল, "না রে , লাগলে তোকে জানাব।" এরপরেই সেন্টার থেকে কনক মাসির আগমন। মায়ের সব কিছু খুব যত্ন নিয়ে করত, অনুরূপাও নিশ্চিন্তে অফিসে বেরিয়ে যেত। ডাক্তারের নির্দেশ ছিল মায়ের ঘরের আসবাব ইত্যাদির যেন কোনো পরিবর্তন না করা হয় আর চেনা মানুষজন যেন ওনাকে ঘিরে থাকেন। ভাই চলে যাওয়ার পর মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজত। কনক মাসি শিশুকে যে ভাবে গল্প পড়ে শোনায় সে ভাবে একটু একটু করে কথা বলে বশে আনে মাকে, অসীম ধৈর্য্য মানুষটার। সব কিছু খারাপ হলেও এই একটি মানুষের ভরসায় অনুরূপা কোনমতে চাকরিটা বাঁচিয়ে রেখেছিল, এরপর কী হবে কে জানে। কনক মাসির উত্তেজনা থামলে ও বলল, "ঠিক আছে, এসো তুমি, আর তোমাকে আটকাব না।" মাসী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বাড়ি চলে গেল ব্যাগ নিয়ে। অনুরূপা মায়ের ঘরে ঢুকল, রাতের খাওয়া সারা, ঘুমের ওষুধটাও পড়ে গেছে, মা বালিশে পিঠ দিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে, টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোয় দেয়ালে মায়ের মুখের ছায়া পড়েছে, বৃহৎ সে ছায়ামুখ ঘটঘট করে নড়ছে এ পাশে ও পাশে, হঠাৎ দেখলে বুক ছাঁত করে উঠবে, যেন কোনো প্রেতাত্মা! অনুরূপা খুব ক্লান্ত, জামাকাপড় কিছু না ছেড়েই মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল, অমনি অদ্ভুত ব্যাপার, মাও আস্তে করে নেমে বালিশে মাথা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন ডোর বেল বাজতে অনুরূপা দেখে আটটা বাজে, কী কান্ড! মাও তো রাতে ছটফট করেনি! উঠে দরজা খুলতেই দেখে কনক মাসি। ঢুকেই বকবক করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাতে থাকে। আনন্দে চোখে জল এসে যায় অনুরূপার, যাক চাকরি চলে যাওয়ার ভয় আর রইল না, আজ একটু দেরি করেই যাবে। নটা নাগাদ আবার ডোরবেল, কে এলো এখন? দরজা খুলতেই বুকের মধ্যে ওঠাপড়া, বিকাশ! বিকাশও ওকে দেখে অপ্রস্তুত, "তুমি এখনও বাড়িতে? মাসিমা ঠিক আছেন তো?" বলতে বলতে কনক মাসি এসে পড়ে, "ও দাদাবাবু, আপনি ! দিদি বেলা করে যাবে আজ। আপনি ধরা পড়ে গেলেন তো!" কী হচ্ছে এসব! বিকাশ বলে, "তোমার সঙ্গে সম্পর্ক নেই কিন্তু মাসিমা কী দোষ করেছেন? আমি আমার সুবিধা মতো ওনাকে দেখে যাই। এতেও আপত্তি?" এবার ভীষণ ভয় করছে অনুরূপার, যেন একটা কাঁচের গোলকের মধ্যে সে, আর বাইরে একটা কাঠঠোকরা উদগ্রীব হয়ে আছে, চুরমার করে দেবে সব সুখ। বিকাশ বলে, "আজ অফিস যেতেই হবে অনু?"
2 Responses
আনন্দে চোখে জল এসে গেল! এ নিকি ভয়ের গল্প!
অনেক ভালোবাসা