দু’নম্বর

সিউড়ি, বীরভূম

“ভয় আমি এক্কেবারে পাই না বুঝেছো! কী হল? ঠোঁট বেঁকালে যে বড়? বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? ভাবছো অমন কথা সবাই বলে। বেশ, হয়ে যাক বাজি। কী বলছো? অমাবস্যার রাতে শ্মশানে যেতে হবে। ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নেই। চলে যাব। ভূতে আমার ভয় নেই, কিন্তু সাপের ভয় তো আছে রে বাপু ।তুমি গ্যারেন্টি দাও সেখানে সাপ-খোপ থাকবে না। আমি হাসতে হাসতে চলে যেতে পারি। তবে কিনা আমি  রাতে বেরোলে আমার বাড়ির লোক অ্যালাউ করবে না কিনা, নইলে এ আর এমন কী ব্যাপার? কী বলছ? পোড়ো বাড়িতে রাত কাটাবো? ধুর এ আবার কী এমন ব্যাপার। কিন্তু ওই যে তোমাকে কথা দিতে হবে, সেই বাড়িতে কোন দুষ্টু লোকজন আস্তানা বানিয়ে রাখেনি। আরে বাবা পড়েছি তো সব গল্পে ভূত মনে করে যতই লম্ফ-ঝম্প করো না কেন শেষকালে দেখা যাবে ওটা আসলে গুন্ডা দলের আখড়া ছিল। 
“তাই খামোখা মিছিমিছি ওই পোড়ো বাড়ির চ্যালেঞ্জটা আমি নিতে যাব কেন?
 আহা আহা চটছো কেন? আরে আমি কি বলেছি যে আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। করি তো, একশো বার করি। তবে তাদের ভয় করি না!”

আমার এবার বড় বিরক্ত লাগল। আরে আমার মানে সত্যিকারের আমার। মানে এতক্ষণ যে লোকটা আমি আমি করে বকবক করছিল সে তো আমি নই।
 গোলমাল পাকাচ্ছে বুঝি ?বেশ তবে খুলেই বলি কথাখানা।
 অধমের নাম অক্ষয়চন্দ্র তালুকদার। বয়স এই পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে ছেচল্লিশে পড়বে পড়বে করছে। বাড়ি বীরভুম জেলার আমড়াতলী গ্রামে। রাজ্য সরকারি করণিক পদে চাকরি করি। সদর শহর সিউড়িতে। গ্রাম থেকে সিউড়ি আসতে তা ধর প্রায় ঘন্টা তিনেক লাগে। বাড়ি থেকে সাইকেল, তারপর বাস আর সবশেষে ট্রেন।
 তা আজ হয়েছে কী, অফিস ফেরত ট্রেনটা ভয়ানক লেট করায় শেষ বাসটা মিস করেছি। ফলে এখন আমি বাসস্ট্যান্ডের সরকারি প্রতীক্ষালয়ে প্রতীক্ষা করছি। (প্রতীক্ষালয় নামে আহা মরি হলেও আসলে মাথায় ছাউনি দেওয়া একখানা সিমেন্টের বেঞ্চি) যদি কোন ট্রাক-টেম্পো পাওয়া যায়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে মেজাজটাও ভালো নেই।

এমন সময় এই লোকটা হঠাৎ ঘাড়ের কাছে এসে বসেছে। আর বসেই ওই সব আলতু ফালতু বকতে লেগেছে। আবার সরাসরি তুমি বলছে। যেন আমার সাত জন্মের আত্মীয়। অন্য কেউ শুনলে মনে করবে আমিই বুঝি ওকে ওইসব ভূত টুত নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি।
 আচ্ছা বলুন তো আমার কি মাথা খারাপ। চিনি না জানি না বেমক্কা একটা লোককে এই ভর সন্ধ্যেবেলা ভূত নিয়ে জিজ্ঞাসা করব? আমার বলে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা। ওই দেখো, কুকুর বলতে মনে পড়ল ভয় যদি আমি কাউকে করি সে ওই কুকুর। দেখলেই কেমন গাটা শিরশির করে। লোকের কাছে এই নিয়ে হেনস্থাও কম হই না। লোকজন সাপের ভয়, বাঘের ভয়, এমনকি মৌমাছির ভয়কেও মেনে নেবে। কিন্তু কুকুরকে ভয় পেলেই এমন ভাব করবে যেন আমার এই পৃথিবীতে থাকার অধিকারই নেই। আমি একটা ভয়ানক রকমের পাপী লোক। আবার কিছু লোক এই ভয়টাকে নিয়ে মজা করতে ওস্তাদ। গায়ের কাছে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে দাঁত বের করে হ্যা হ্যা করে হাসবে।
এ্যাইসা রাগ হয় না, ইচ্ছা করে গায়ে সাপ ছুঁড়ে দিয়ে দেখি একবার। 

“হ্যাঁ গো রাগ করলে? তা রাগ তুমি করতেই পারো। ভাবতেই পারো আমি মিছিমিছি বলছি। আসলে ভূতের ভয়েই আমি আধমরা হয়ে আছি।”

 ওই আবার শুরু হল। এতো আচ্ছা জ্বালালো দেখছি। এদিকে একটা ট্রাক বা টেম্পোর দেখা নেই। অন্ধকারটাও দ্রুত ঘন হচ্ছে। অবশ্য এই সময় একা বসে থাকার চেয়ে একটা লোক সঙ্গে থাকলে মন্দ হয় না। তবে চোর ছ্যাঁচোড় হলে সমস্যা।  
মনে মনে ভেবে নিলাম আমার হাতে ঘড়ি, পকেট এ মোবাইল, অবশ্য সেটা সাত পুরোনো সাদাকালো মোবাইল। দিলেও কেউ নেবে না। আর মানিব্যাগে তিপান্ন টাকা আছে। আঙুলে বিয়ের আংটিটা আছে অবশ্য। তা সেও ভাঙলে সোনা যতটা বেরোবে তাতে খাটনি পোষাবে না।
 অতএব নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে বসলাম। আর অমনি দুপাটি দাঁত অন্ধকারে ঝকঝক করে উঠল। খানিকটা চমকে উঠেছিলাম। লোকটা মিশমিশে কালো ,অন্ধকারে মিশে গেছে যেন। অথচ দেখো দাঁত যেন দামি পেস্টের বিজ্ঞাপন । একেবারে বত্রিশ পাটি ছড়িয়ে দিয়েছে।

খানিকটা সামলে নিয়ে বললাম, “মশাইয়ের নাম?” 
বিনয়ে যেন গলে গেল। একেবার আধ ময়লা চেক শার্টটাতে হাত মুছে, হাতটা বাড়িয়ে বলল, “আজ্ঞে শ্রী অক্ষয় চন্দ্র তালুকদার।”
কঁক করে আমার গলায় একটা আওয়াজ হল। বলে কী লোকটা! এ তো আমার নাম। খানিকটা থতমত খেয়ে আলতো হাত ছোঁয়ালাম লোকটার হাতে। বেশ ঠান্ডা তো হাতখানা। আমার হাতের মতো সদা উত্তপ্ত নয়। মা বলতেন হাত জ্বালা করা নাকি আমাদের বংশের ধারা ।
কী জানি কেন লোকটা আমার নাম জিজ্ঞাসা করল না। শুধু আপন মনে বিড়বিড় করল, “আজ ট্রেনটা যদি এত লেট না করতো শেষ বাসটা মিস হত না।” 
অ্যাঁ বলে কী! এও তো আমার কথা। খানিকটা ভয়ে ভয়েই গলাটা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “মশাইয়ের কী করা হয়?”
 “ওই সিউড়িতে রাজ্য সরকারি অফিসের কেরানি। বলেই আগ বাড়িয়ে বলে উঠল বাড়ি আমড়াতলি গাঁয়ে।”
এইবার আমার চড়াং করে রাগ উঠে গেল। ব্যাটা আমার নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিয়ে আমার সঙ্গে মশকরা জুড়েছে।
 রাগ রাগ মুখে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখি, “যাঃ মোবাইলে চার্জ নেই।” না, কথাটা আমি বলিনি, বলছে আমার পাশে বসা দু নম্বর অক্ষয়। ঠিক আমারই মতন একখানা পুরনো সাদাকালো মোবাইল হাতে নিয়ে। আরও অদ্ভুত ওই কথাটাই আমি বলতে গেছিলাম ।
 এবার গাটা শিরশির করে উঠল। লোকটার দিকে তাকাতেই আবার সেই ঝকঝক করা দাঁত আর খিঁকখিঁক হাসি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে ওই অক্ষয়ও উঠে দাঁড়াল। আরে লোকটা পুরো আমার মাথায় মাথায়। পরনে  ময়লা চেক ফুল শার্ট আর কালো প্যান্ট। আমাকেও অবশ্য আজ অফিসের পিয়ন মুখ ফসকে বলেছে, “শার্টটা কদিন কাচেননি অক্ষয়বাবু?”

 প্রতীক্ষালয় থেকে বাইরে নেমে এদিক ওদিক তাকাতে যাব, ঘাড়ে আবার সেই ঠান্ডা হাতের টোকা ।
“আরে করো কী, দেখছ না কেমন বাঘা বাঘা তিন-চারটে কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার বাপু কুকুরে বড়ো ভয় করে!” আমি ঝট করে পিছিয়ে আসি। তাই তো অন্ধকারে ঠাওর করিনি। কতকগুলো কুকুর গোল পাকিয়ে কী যেন একটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। গলা দিয়ে কেমন যেন একটা ঘরঘর শব্দ করছে। 
বাস রে!অক্ষয়বাবু না বললে এতক্ষণে ওদের মাঝে পড়ে প্রাণটা যেত এক্কেবারে। আচ্ছা ওনারও কুকুরের ভয়?তবে এ জগতে আমার মত মানুষ আছে তাহলে। যার কুকুরের ভয় আছে। কাল অফিসে গিয়ে বলব সদানন্দকে ।
ব্যাটা সর্বদা এমন ভাব দেখায় যেন আমি অতি নিকৃষ্ট জীব বলেই কুকুর পছন্দ করি না। 

এবার আর দু নম্বর অক্ষয় বাবুকে মন্দ লাগে না। ফিরে গিয়ে বেঞ্চে বসে ওনার পাশেই বসি। বলি, “কী করা যায় বলো তো হে?” আরে আমিও যে তুমি বলে ফেলেছি। অবশ্য আমার এই তুমি বলাতে দু নম্বর যেন একটু বেশি খুশি হয়ে ওঠে। আরও খানিকটা কাছে এগিয়ে এসে বসে তারপর দাঁত বের করে বলে, “সেই তো কী করা যায় বলো তো হে!

 এতটা কাছে এগিয়ে আসার জন্যই লোকটার মুখটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরে লোকটার কপালের ডান দিকে কালচে রঙের ঘন ওটা কীলেগে আছে? অন্ধকারে ভালো বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। ঠোঁটের কোণে আর কানের পাশে একটা সরু কালো রেখা। আমি হাত উঠিয়ে বলি, “ও --ওটা কী?” আশ্চর্য দু'নম্বর অক্ষয়ের আঙ্গুল আমার দিকে, চোখ বিস্ফারিত করে বলছে, “ও --ওটা কী?” 
আমার অজান্তেই হাত উঠে আসে কপালের ডান দিকে। শুকিয়ে চটচটে হয়ে আছে আঠালো কিছু। কানের পাশে আর ঠোঁটের কোণেও তরল একটা কিছু গড়িয়ে আসছে। রক্ত!
 আমার এমন আঘাত লাগলো কখন? আর লাগলেও ব্যথা নেই কেন? আমি অবাক হয়ে তাকালাম দ্বিতীয় অক্ষয়ের দিকে। দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে। আর আমাকে ইশারা করে যেতে বলছে ওই কুকুরগুলোর দিকে। ওখানে এখন কয়েকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দেখছি পাশে একটা লরি। সেখান থেকেই নেমেছে লোকগুলো। দু'নম্বর অক্ষয় আমার হাতটা চেপে ধরে। এবার আর অতটা ঠান্ডা লাগে না ,আমার হাতটাও ঠান্ডা হয়ে এসেছে বোধহয়।
 আশ্চর্য কুকুরগুলোকে আমার আর তেমন ভয় করছে না তো। দুজনে কুকুরগুলোর পাশ কাটিয়ে ভিড় সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি ,একটা পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিস বছরের লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পাশে রক্তের ধারা। গায়ে ময়লা চেক ফুলশার্ট আর কালো প্যান্ট।  একটা লোক নিচু হয়ে চিৎ করে দেয় লোকটাকে।
 মাথার ডান দিকটা থ্যাঁতলানো, কালো রক্ত জমে আছে। কান আর ঠোঁটের পাশ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। পকেট থেকে উঁকি মারছে পুরনো সাদাকালো মোবাইল। পাশে পড়ে আছে আই কার্ডটা। তাতে লেখা অক্ষয়চন্দ্র তালুকদার। গ্রাম আমড়াতলী। জেলা বীরভূম।

 মাথাটা বোঁ করে ঘুরে ওঠে আমার। কী বলছে লোকজন? কেউ এসে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে পালিয়েছে গো। আহা সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণটা বেরিয়ে গেছে। দিনের বেলা হলে তবুও হত। কতক্ষণ পড়ে আছে কে জানে!!
  
       বন বন করে ঘুরছে মাথাটা। আমাকে প্রায় জাপ্টে ধরে ভিড় থেকে সরিয়ে আনে দু নম্বর অক্ষয়। কানে কানে বলতে থাকে বলে ছিলাম না, “ভূতে বিশ্বাস করব না কেন? ভূতে বিশ্বাস করি তো। তবে কিনা ভয় পাই না। আরে বাবা নিজেরাই নিজেদের ভয় পেলে চলে? বলেই খিঁক খিঁক করে হেসে ওঠে। আর তা শুনে সাদা ঝকঝকে দুপাটি দাঁত বের করে আমিও খিঁকখিঁক করে হেসে উঠি। আর দু নম্বর মিশে যেতে থাকে আমার মধ্যে।

2 Responses

  1. Arkaprava Sinha says:

    Golpo du nombor holeo lekha ta ek nombor 😌

  2. দীপ দত্ত says:

    দারুণ ।গা ছমছমে রোমহর্ষক জমাটি গল্প।
    👍

বৈশাখী ২০২৪