স্লিপিং উইথ দ্যা এনিমি সিনেমাটা দেখার পর থেকেই বিয়ের ব্যাপারে সোহিনীর আরো একটু বেশি ভয় করতে শুরু হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে নায়িকার ওপর তার স্বামী অমানুষিক অত্যাচার করে। তার স্বামীও এমন অত্যাচারী হবে না তো ? আগে থেকেই বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে ভয় ছিল সোহিনীর। যদিও দেখাশোনা এখনো সেই অর্থে শুরু হয়নি। বয়স প্রায় সাতাশ হয়ে গেল। দেখতে শুনতে বেশ ভালো। চাকরির জন্য এতদিন চেষ্টা করেও খুব একটা সুবিধা হয়নি। অবশ্য তার কিছুটা কারণ সে নিজেই। যদিও একাডেমিক রেজাল্ট বেশ ভালো সোহিনীর। বইপত্র নিয়েই জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে। বলা উচিৎ এখনো কাটে। কিন্তু তার কোনো বন্ধু নেই। সে নিজে যেমন সহজে কারো সঙ্গে মিশতে পারে না তেমনই অন্য কেউও তার সঙ্গে খুব সহজ হতে পারে না। ছোটোবেলায় একটা দুর্ঘটনার পর থেকে সে নাকি এমন হয়েছে৷ একাকীত্ব সঙ্গী হয় তার। আর এই নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য বইকেই আঁকড়ে ধরে সে। বছর খানেক আগে নেটটাও পাশ করেছে। কিন্তু পি এইচ ডি করার ইচ্ছে ছিল না। অন্য চাকরির চেষ্টা করতে করতে বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তাই এবার বিয়ের কথা ভাবতেই হচ্ছে। মা অবশ্য খবরের কাগজে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখেন। দুই একটা জায়গায় ফোনও করেন। ছবি আদানপ্রদান হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এর বেশি কিছু এগোয় না। শেষ যেখানে কথা হয়েছিল সেই ছেলেটা ছিল বেশ পদস্থ সরকারি কর্মী। কিন্তু তার ছবি দেখেই সোহিনী এমনভাবে আঁতকে উঠেছিল যেন কোনো মোস্ট ওয়ান্টেড মার্ডারারের ছবি দেখছে। এই ছবির মানুষটা নাকি কিছুতেই ভালো হতে পারে না। সোহিনীর মা কিছুতেই বিষয়টা সহজ করে তুলতে পারলেন না মেয়ের কাছে। কোনো মানুষের মুখ একবার দেখে যদি তার ভয়ংকর মনে হয় তাহলে কিছুতেই সেই জায়গা থেকে টলানো যাবে না সোহিনীকে। এর পর থেকে সে ছবি দেখেই বলে দিতে লাগল এই লোকটা একজনকে খুন করেছে বা ওই লোকটার পিঠে একটা বড় কাটা দাগ আছে। ভয়টা দিন দিন বাড়ছে দেখে এই ভয় কাটানোর জন্য সোহিনী ইদানীং খুব হরর মুভি দেখছে। দেশ বিদেশের মুভি। ভূতে অবশ্য তার বিশ্বাস নেই। যদিও ভূতের ছবি দেখে বিয়ের পর ভবিষ্যতের ভয় কীভাবে কাটবে সেটা অনুমান করাও খুব শক্ত। তবুও রাতে শোবার পর ইউটিউবে হরর মুভি দেখার একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে গেছে। প্রতিদিনের মতো আজকেও একটা হরর মুভি সার্চ চলছিল। কিন্তু একটা অচেনা ইউটিউব চ্যানেল হঠাৎ এল চোখের সামনে। চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা হাইড করা আছে। লাইক কমেন্ট একটাও নেই। বোধহয় একদম নতুন কোনো চ্যানেল। সাধারণত এমন চ্যানেল চোখের সামনে এলে সবাই স্কিপ করে যায়। সোহিনীও তাই চেয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা করতে পারল না। ভিডিওর ওপরের ছবিটা ওকে চুম্বকের মতো টানল। একটা রক্তকরবী গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে একটা স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চা মেয়ে। গাছভর্তি ফুল। মেয়েটাত বয়স সাত আট হবে। জলরঙে আঁকা ছবি। ছবিটা সোহিনীর চেনা লাগল। ঠিক এমনি একটা ছবি তারও ছোটবেলায় তোলা আছে কিন্তু রক্তকরবী গাছের জায়গায় একটা ল্যাম্পপোস্ট ছিল। ছবিতে টকটকে লাল ফুলে তার ডাল ভর্তি। ছবির মেয়েটার মুখে পুরো সোহিনীর মুখটাই বসানো। সবচেয়ে বড় কথা ছবির মেয়েটার ডান পায়ের মোজাটা টাইট বাঁ পায়ের মোজাটা লুজ। গলার মালাটাও দেখা যাচ্ছে। মাথার দুপাশে বিনুনি করা চুল। তাতে লাল ফিতে বাঁধা। সোহিনীর ছবিটাতেও তাই ছিল। ওর খুব ইচ্ছে করছে অ্যালবাম থেকে ছবিটা এনে একবার মিলিয়ে দেখে। কিন্তু ছবিটা আছে মায়ের ঘরের আলমারিতে। আর মা দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন আনতে গেলে খুব সমস্যা হবে। ছবি আনতে যাবার ইচ্ছেটা দমন করল সোহিনী। সকালে দেখা যাবে। যদিও সে নিশ্চিত যে ছবিটা ওরই। কিন্তু এই ছবিটা আঁকল কে? সে পেলই বা কীভাবে আসল ছবিটা। এই চ্যানেলে একটাই মাত্র ভিডিও পোস্ট করা আছে। আর এটাও আজকেই কিছুক্ষণ আগে পোস্ট করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ভিউয়ার শূন্য। তার মানে চ্যানেলটাও একেবারে নতুন । সবে শুরু হয়েছে। বেশি কিছু জানতে গেলে এবার ক্লিক করে ভিডিওর ভেতরে ঢুকতে হবে। ক্লিক করল সোহিনী। ভিডিও চালু হল আর সঙ্গে সঙ্গে সে ভীষণ চমকে উঠল। একটা অ্যানিমেটেড ভিডিও। একটা বাচ্চা মেয়ে দোলনায় দোল খাচ্ছে। মেয়েটার গায়ে একটা লাল রঙের গাউন। এটা তো তারই গাউন বলে মনে হচ্ছে। এই ড্রেসটাই তো ছোটোবেলায় খুব প্রিয় ছিল সোহিনীর। মেয়েটাকে অবিকল সোহিনীরই ছোটোবেলার মতো দেখতে। এই দোলনাটাও যেন তার দীর্ঘদিনের চেনা। মেয়েটা দোল খাচ্ছে। দোলনাটা মেয়েটাকে নিয়ে সামনের দিকে অনেকটা উঠে যাচ্ছে৷ কেউ পেছন থেকে ধাক্কা না দিলে এতটা ওপরে ওঠা সম্ভব না। কেউ একজন অবশ্যই ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু পেছনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটার চোখেমুখে আতঙ্ক। সে ভয় পাচ্ছে। শক্ত করে ধরে রেখেছে দোলনার দড়ি। এক সময় দোল খাওয়া বন্ধ হল। সরল দোলগতির মতো ধীরে ধীরে স্থির হয়ে এল মেয়েটা। এরপর হঠাৎ দোলনা থেকে নেমে এসে একটা বিকৃত মুখভঙ্গি করে ভৌতিক কণ্ঠে বলল, “ডরনা জরুরি হ্যায়।” বলেই হাতটা এগিয়ে দিল ক্যামেরার দিকে। তারপরেই স্ক্রিন জুড়ে অন্ধকার। এখানেই ভিডিও শেষ। পঁচিশ সেকেণ্ডের ভিডিও। এতক্ষণ পর চ্যানেলটার নাম এবার দেখল সোহিনী। চ্যানেলের নামই ‘ডরনা জরুরি হ্যায়৷’ এই ভিডিও দেখে ভয় পাবার তেমন কিছু নেই। ভিডিওতে ভয়ংকর কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও নেই। কিন্তু কেন যেন সোহিনীর বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। তার ছোটোবেলার ঘটনা কে এইভাবে চুরি করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর তাকে পেতেই হবে। ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল সে। রাতে ভালো ঘুম হবে না ভেবেছিল সোহিনী। কিন্তু ভীষণ ভালো ঘুম হল। সকালে উঠে হাত মুখ ধোয়ার পরই মায়ের আলমারি থেকে অ্যালবামগুলো বের করল। একটা একটা করে পাতা উল্টে দেখতে লাগল। কিন্তু না! লাল গাউন পরা তার ছোটবেলার পার্কের একটা ছবিও তো নেই! এমনকি স্কুল ড্রেস পরা ছবিটাও উধাও। হতভম্ব সোহিনী দৌড়োল মায়ের কাছে। মা তখন রান্না শুরু করেছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে সোহিনী একের পর এক প্রশ্ন করল, “মা লাল গাউন পরা বেশ কিছু ছবি ছিল আমার। সেগুলো কই? পার্কে তোলা। একটা দোলনায় বসা ছবিও। অ্যালবামেই তো ছিল কিন্তু এখন পাচ্ছি না তো। কোথায় আছে সেগুলো জানো?” “তোর ছোটবেলার ছবি যা ছিল তা তো সব এই অ্যালবামগুলোতেই আছে। ভালো করে খুঁজে দেখ পেয়ে যাবি।” “খুব ভালো করেই খুঁজেছি মা। অ্যালবামের কোত্থাও নেই। অন্য কোথাও থাকলে সেটা বলো।” “আমার মনে পড়ছে না। কোন ছবিগুলো?” “লাল গাউন পরা ছবিগুলো। আমার বয়স তখন সাত আট বছর। পার্কের ছবি। অনেকগুলো ছবি থাকার কথা।” মা মুচকি হেসে তাকালেন এবার সোহিনীর দিকে। “তোর তো কোনো লাল রঙের গাউন ছিল না রে। লাল রং তো তুই খুব ভয় পেতিস। এমনকি লাল ফিতেও বাঁধতিস না চুলে। কেউ তোকে বলেছিল লাল জামা পরলে রাস্তায় ষাঁড়ে গুঁতো দেয়। তাই লাল ড্রেস কখনও পরতে চাইতি না তুই। লাল জামা দেখলেই তুই ভয়ে পালিয়ে যেতিস।” মা খুব গুরুত্ব দিলেন না। মাঝেমধ্যেই এমন উদ্ভট কথা বলে মেয়েটা৷ তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। কথাগুলো খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে। এছাড়া সে পুরো সুস্থ। দোষের মধ্যে মেয়েটা একটু ভিতু প্রকৃতির। কিন্তু আজ লাল গাউনের কথা শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়লেন। লাল রঙে মেয়েটার খুব ভয় ছিল। এই বাড়িতে আসার পর থেকে একটু একটু করে ভয় কেটে যায়৷ লাল রঙে ভয় ছিল কিনা সেটা সোহিনী মনে করতে পারল না। মা যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই ছিল। ছোটোবেলার অনেক কথা তার ঠিক মনে পড়ে না। মায়ের কাছে শুনেছে ওর নাকি কোনো একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল। তারপর থেকে অনেক স্মৃতি ঝাপসা৷ সোহিনী বুঝল মায়ের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। ছবির রহস্য এখানে উদ্ধার হবে না। নিজের ঘরে চলে এল। এমন সময় মনে পড়লো খুব ছোটোবেলায় সে ডায়েরিতে কিছু কিছু টুকরো স্মৃতি লিখে রাখত। সেখানে লাল গাউন সম্পর্কে কিছু লেখা আছে কিনা দেখতে হবে। সব ডায়েরি নেই। কিছু আছে। বাকিগুলো কোথায় গেছে সে জানে না। কয়েকটা ডায়েরি পুতুলের বাক্সে রাখা আছে। বহু বছর তাতে কোনোরকম হাত দেয়া হয়নি৷ বাক্সেও ধুলো জমেছে। খুঁজে খুঁজে কয়েকটা ডায়েরি খুঁজে বের করল। এগুলো ওর একেবারেই ব্যক্তিগত জিনিস। এক এক করে পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করল। একদম ছোটবেলায় লেখা। কাঁচা হাতে বেশ বড় বড় অক্ষরে। তেমন কিছু খুঁজে পেল না। বেশিরভাগই নিজের কথা। কী খেলাম কী পরলাম এইসব। এছাড়াও মাঝেমাঝেই আঁকা ছবি। বইয়ের পড়া দেখে দেখে হাতের লেখা করা আছে। বেশ কয়েকটা ডায়েরি দেখার পর সোহিনী দেখল আর একটা বাকি । হতাশ হয়েই শেষ ডায়েরিটা হাতে নিল। এটা আবার অর্ধেক পাতা পর্যন্ত লেখা। কিন্তু এখানেও নতুনত্ব কিছু নেই। শুধু শেষের কাছাকাছি একটা পাতায় এসে চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা, ‘পার্কে খুব আনন্দ হল। অনেকক্ষণ দোল খেলাম’। ডায়েরির পাতার তারিখ অনুসারে লেখা নয়। নিজের মতো লেখা কিন্তু কোনো লেখার নীচে তারিখ দেয়া নেই। আর এক জায়গায় দেখল, ‘সকালে বাবাকে দেখলাম অ্যালবামগুলো দেখতে। বাবাকে মা খুব ভয় পায়। আমিও মাঝে মাঝে ভয় পাই।’ এর কয়েকপাতা পর লেখা, ‘যুদ্ধ হচ্ছে। কারগিল যুদ্ধ।’ এরপর একটা ছবি আঁকা। ছবিটা যুদ্ধের। কোনো বই দেখে আঁকার চেষ্টা হয়েছিল। তারপর লেখা, ‘বাবাকে খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। মা বলছে বাবা তার শত্রুর সঙ্গে ঘুমিয়ে আছে।’ এরপর আবার হিজিবিজি ছবি। তারপর এক জায়গায় লেখা, ‘এই বাড়িটায় ভূত আছে। আমার খুব ভয় লাগে।’ এরপর আর কিছু লেখা নেই। পুরোনো ডায়েরি দেখে চোখে জল এল সোহিনীর। আবছা আবছা মনে পড়তে লাগলো সেদিন পার্কে বাবাই তাকে দোল দিচ্ছিল। ফেরার সময় বলেছিল, ‘পরে আবার কখনো এখানে আসব। আবার দোল খাওয়াব।’এরপরে আর সেখানে যাওয়া হয়নি। ইউটিউব ভিডিওটা আবার দেখতে হবে। ভালো করে দেখতে হবে বাচ্চাটাকে পেছন থেকে কে দোল দিচ্ছে। বাবার কোনো ছবি বাড়িতে নেই। বাবার মুখটা তার মনে পড়ে না। গত কুড়ি বছর বাবার বাড়ি থেকে তারা চলে এসেছে। শুধু ছবি কেন বাবার কোনো স্মৃতিই এই বাড়িতে নেই। তাহলে ভিডিওটাতে দোলনার পেছনের লোকটা কে? তার মুখ দেখা যাচ্ছে না কেন? এত জোরে জোরেই বা কেনোসে দোলা দিচ্ছিল? কিসের দুর্ঘটনা ঘটেছিলো তার? বাবা তো তাকে ভালোই বাসত। বাবার স্মৃতি মনে আসতেই মেরুদণ্ড দিয়ে একটা চেনা শীতল স্রোত বইতে লাগল। সোহিনী জানে তার বাবা সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন না। বাবা কোনো যুদ্ধে যায়নি। বাবা তো শত্রুর সঙ্গে শুয়ে ছিল। কে সেই শত্রু ? কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে৷ চ্যানেলের নামটা মনে আছে। ‘ডরনা মানা হ্যায়।’ সার্চ করল সোহিনী। ওই নামে বেশ কিছু চ্যানেল আর একটা সিনেমা বেরিয়ে এল কিন্তু গত রাতে দেখা ভিডিওটা অনেক সার্চ করেও সে আর খুঁজে পেল না। আশ্চর্য তো! হাল ছাড়ল না। সোহিনী! জেদ চেপেছে মাথায়। মনে হচ্ছে শরীর ভয়ঙ্করভাবে দুলছে। কেউ জোর ধাক্কা দিচ্ছে পিঠে। ভূমিকম্প হচ্ছে কি? চিৎকার করে উঠল সোহিনী ভয়ে। তখনই মনে হল তার দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে আছে মা। মায়ের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে সে বলল, “তোমার রান্না হয়ে গেছে?”