“কী হইসে? কতা কও না ক্যান?” “কিসুই কওনের নাই। যার যা ইচ্ছা করুক।” “তুমার লজ্জা করে না?” “নাহ্ করে না।” “তাই বলে হেয় মানুসগো লগে খ্যালবো?” “উফ্ বাঁইচ্যা থাকতে হ্যায় নীচু জাত, অয় মুসলা, অর মায়ের চরিত্তির ভালো না আর অহন অয় মানুস। ধুত্তোর নিকুচির জীবন!” বলেই জিভ দাঁতে কাটল লিকলিকে। একরাশ বিরক্তিতে বলল, “ধুর ধুর কিসের জীবন, হালার মরণ তায় আবার বাঁচন!” রাগে গজগজ করতে করতে শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে এই সাত সন্ধ্যায় ছেলের ঘেঁটি ধরে আনবে বলে ছুটল। ছেলেটাও হয়েছে তেমনি কেন রে বাবা ভূতের ছানাপোনা তো আশেপাশে কম নয়! তা বাবুর কাউকে মনে ধরে না। ঐ গলাকাটা মাঠের শেষে জোড়া তালগাছ তলাতেই যাওয়া চাই। আজ দেখবে কী এত খেলা ওদের। গনগনিয়ে হু হু করে ছুটল লিকলিকে। ভূত হবার পর ভূতেদের প্রেসিডেন্ট, ব্রহ্মদৈত্যকে হুকুম করে সবার নামকরণ করতে। ব্যাটা হতচ্ছাড়া বেম্মো একটা অখাদ্য নাম দিয়েছে, 'লিকলিকে,' থু থু ঘেন্নার জীবন। এইসব মন খারাপের কথা হলেই পুকুরের পাড়ে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। লিকলিকের ইচ্ছে করল না গলাকাটা মাঠের দিকে যেতে, বসে পড়ল পুকুড়পাড়ে। আকাশপাতাল ভাবছে, হঠাৎ চমকে উঠে দেখে জলের ভেতর খাবি খাচ্ছে কী ওটা। একী এযে বোসদের ছোটোগিন্নি! ঝুপ্ করে বৌটাকে পাড়ে তুলতেই সে বেটি জুড়ল চিল চিৎকার, “ওরে বাবারে ভূতে আমার ঘাড় মটকালো রে। আমি সবে গা ধুয়ে ঝুপঝুপ করে দুটো ডুব দিয়েছি অমনি ঠাণ্ডা হাত ঘাড় চেপে ধরল রে!” আরে ছ্যাছ্যা এই জন্য মানুষের কোনো উপকার করতে নেই। জলে খাবি খাচ্ছিল বাঁচাল সে আর কিনা মিথ্যে দোষারোপ করছে? ধুত্তোর জীবন। হু হু দুঃখে উড়ে যেতে গিয়ে বাতাসার গন্ধ পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আহ্ বেড়ে সুবাস। গুটিগুটি গিয়ে দাঁড়াল, হাতটা বাড়াতে যাবে অমনি পাশ থেকে আওয়াজ। “কী চাই! এই ভর সন্ধ্যেতেই আনাগোনা শুরু যে!” “আঁইজ্ঞে বাঁতাসা বঁড়ো ভাঁলো লাঁগে।” “হঠাৎ নাকি কথা বলছ কেন? এমনিই কথা বলো না বাপু!” “আইজ্ঞে নাকে কথা না বললি জাত থাহে না যে!” “সে ভূত হয়ে বাতাসা খেলেও জাত থাকে না। যাকগে বলছি একবস্তা বাতাসা দিতে পারি যদি একটা কাজ করে দাও!” “আইজ্ঞে কী কাজ?” ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরে মাধাই। সঙ্গে সাদা গেঞ্জি। নধর ভুঁড়ি নিয়ে গদাই লস্কর চালে জীবন কাটায়। বাপ ঠাকুরদাদা ছিল এলাকার নামকরা ওঝা। জন্মসূত্রে সে কিছুমিছু ক্ষমতা পেয়েছে বটে তবে আজকাল ভূত নিয়ে কারবার বিশেষ চলে না। ভূতগুলোও সব কেমন যেন নেতিয়ে গেছে। এই তো পুকুড়পাড় থেকে মাইলটাক গেলেই পুরোনো বিশাল শ্যাওড়া গাছ ওতেই থাকে একটা পরিবার। কতবার শুনেছে মাধাই একেবারে যাচ্ছেতাই রকমের ঝগড়াঝাঁটি, ছেলেপুলে নিয়ে অশান্তি। মানুষকে ভয় দেখানোর বদলে মানুষ সেজে আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। ঐ পুরোনো রায়বাড়ি, নন্দীবাড়ির গাবগাছ, সব জায়গার ভূতেদেরই আজকাল কোনো জাত নেই। তাই বাতাসার কারখানা বাড়িতে বানিয়ে তারই ব্যবসা ফেঁদেছে। আয় মন্দ নয়। বাড়িতে গরুও রয়েছে চারটে। বউ ছবিরানীও বেশ সামলে রেখেছে সব। বড়ছেলে গেঞ্জির কলে কাজ করে ভালো রোজগার করে। সমস্যা এই ছোটো ছেলেটাকে নিয়ে। বছর সতেরো বয়স। সারাদিন মোবাইলে গেমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। পড়াশোনা, কাজ কম্ম কিছুতেই তার নজর নেই। দেখা যাক বাতাসার লোভ দেখিয়ে আজকের ভূতটাকে দিয়ে যদি মোবাইলের ভূত ঘাড় থেকে নামানো যায় ছেলেটার। এই ভূতটাকে অনেকবার বাতাসা চুরি করতে দেখেছে। কিছু বলেনি কটা তো বাতাসা নিক গে। কিন্তু আজ মনে হল ব্যাটাকে লোভ দেখিয়ে কাজ হাসিল করা যেতে পারে। লিকলিকে হু হু করে ছুটছে গলাকাটা মাঠের দিকে। ঐ খানেই ওর ছেলেটাও মজে আছে। মাধাইয়ের কথা না শোনার কিছু নেই। নিজের স্বার্থ আছে যখন। তালগাছের নিচে গোল হয়ে দশ বারোটা ছেলে মোবাইলে হুমড়ি খেয়ে কিছু করছে। ওদিকেই লিকলিকের গতি। ছেলেগুলোর ভেতর যে ছেলেটা সবচেয়ে বেশি করিৎকর্মা সে হঠাৎ চটাস করে উঠে দাঁড়াল। হাতের মোবাইলটা পাশে বসে থাকা টাঙ্কুকে দিয়ে বলল, “আসছি, সাবধানে খেলবি, মরলে তোর কপালে আছে,” বলেই একটু দূরে একা তালগাছটার কাছে গেল। দূর থেকে লিকলিকে ব্যাপারটা দেখেছিল সে ভাবল, এ তো সোনায় সোহাগা একা মানে ব্যাটাকে সহজেই চমকানো যাবে। তালগাছের মাথা থেকে সরু লম্বা ঠ্যাংটা ঝুলিয়ে দিল। অমনি ছেলেটা গেয়ে উঠল। "ওরে লিকেলিকে সরু সরু ঠ্যাং/তোর ঘাড়ে লাফিয়ে উঠুক ডোবার কোলা ব্যাঙ" চিলচিৎকারে আর ব্যাঙের নামে লিকলিকের শরীর খারাপ করতে লাগল। সহ্য করতে না পেরে দমাস করে পড়ে গেল। ছেলেটা মুচকি হেসে বন্ধুদের কাছে যেতেই দেখল ওরা ভয়ার্ত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা স্হির হয়ে খানিক দাঁড়াল ঝাঁকুনি দিল শরীরে তারপর চোখ পিটপিট করে বলল, 'কী হয়েছিল রে?' টাঙ্কু বলল, 'তুই এমন বিকট গলায় চিৎকার করে হাবিজাবি কবিতা বললি কেন?' মাধাইয়ের ছেলে হাউহাউ করে বলে উঠল, 'ভাইরে আমার মনে হল একটা হাওয়া নাক দিয়ে ঢুকে ঘাড়ে চড়ে বসল আর আমার শরীর হালকা হয়ে গেল। কদিন ধরেই তোদের বলছি আমার যেন মনে হয় আমার পিছনে কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে। আমায় ফিসফিস করে বলে দেয় কোনদিকে কে লুকিয়ে আছে।' পঙ্কে বড়ো বড়ো চোখে বলল, 'তাই তুই রোজ বুইয়া পাচ্ছিস?' “সে পাচ্ছি কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে আমার পিছনে কেউ যেন আছে!” “হ্যাঁরে তোর বাবা তো ভূতেদের দেখতে পায় তাকে বলিসনি কেন?” “কী বলব বলত? বাড়িতে গেলেই তো ফ্রি ফায়ার খেলা নিয়ে অশান্তি তাছাড়া এই মাঠ পেরোলে আর কিছু বুঝতে পারি না।” “ওরে পিছনে তাকিয়ে দেখ অন্ধকারে ভাঁটার মতো তেড়ে আসছে ওগুলো কী?” একলা তালগাছের গোড়া থেকে লিকলিকে কোনমতে উঠে দাঁড়াল। দেখল ছেলেরা খেলা বন্ধ করে কীসব বলাবলি করছে। আর পাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে তার ছেলে চিক্কুর। বুঝতেই পেরেছিল ঐ ব্যাটা মাধাইয়ের ছেলের ঘাড়ে চেপে এইসব ছড়া কেটেছে। তবে রে, বলে লিকলিকে তেড়ে এসে ছেলের কান চেপে ধরতেই চিক্কুর কায়া রূপ ধরে এমন চিলচিৎকার জুড়ল যে সবকটা ছেলে ওরে বাবারে বলে চোঁচা দৌড়। এদিকে চিক্কুরকে কানমুলে লিকলিকে হাঁটা দিয়েছে শ্যাওড়াগাছের দিকে। “হারামজাদা পোলা মানসের শরীলে ঢুইক্যা আমারে কুলাব্যাঙের ভয় দেখাও, আইজ তুমার একদিন কী আমার।” সোজা বউয়ের কাছে নিয়ে হিঁচড়ে ফেলল ছেলেকে। গম্ভীর স্বরে বলল, “এই নাও হাড়কেলি তুমার গুণধর পোলা। আইজ আমারে মাইরাই ফেলছিল!” “তুমার লজ্জা নাই, মইর্যা ভূত হইয়াও ভয় যায় না? তাও কিনা কুলাব্যাঙেরে ভয় পাও। ছিঃ ছিঃ এতটুক পোলার কানডা টাইন্যা ছিঁইড়্যা নাও তুমার লজ্জা নাই!” “ধুত্তোর নিকুচির জীবন। আপদের জীবন কোথায়? মরণ। যাই করি না কেন ছিঃ ছিঃ শুনতেই হবে!” রাগে বনবন করতে করতে হাঁটা লাগাতেই লিকলিকে দেখে মাধাই আসছে। সঙ্গে ছোট একটা থলে। শরীরটা ছায়া থেকে একটু কায়ায় আনে লিকলিকে। “এই যে ভূত বাবাজি জানতাম এখানেই পাব!” “আঁইজ্ঞে আঁমার নাঁম লিঁকলিঁকে।” “আবার নাকে কথা। যাকগে এই নাও এক বস্তা বাতাসা। দারুণ ভয় দেখিয়েছ বাপু। ছেলে তো ভয়ে কাঁপছে আর তার সব বন্ধুরাও। কাজ সঠিক হয়েছে কিনা দুদিন পরে ভালো মতো টের পাব।” “এইডা এক বস্তা বাতাসা হইল কর্তা?” “শোনো, পাড়ার লোকে ঐ জোড়া তালগাছ তলায় ভস্মিভূতানন্দকে দিয়ে বড় যজ্ঞ করাবে ঠিক করেছে। এই গাছ থেকে আজই পাততাড়ি গুটিয়ে ঐ নদীর ওপারে শ্মশানের কাছে তোদের চলে যাওয়া ভালো বুঝলি। এবার তুই ঠিক কর বাতাসার পরিমাণ নিয়ে ঝগড়া করবি নাকি এই খবরটা দিলাম বলে আমায় গড় করবি?” মুখটা ব্যাজার করে লিকলিকে বাতাসা কটা নিয়ে মাধাইয়ের দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে রইল। মাধাই বলল, “দ্যাখ লিকলিকে মন খারাপ করিস না। তোকে বাতাসা দেব মাসে মাসে যদি নতুন করে ভয় দেখানোর কারবার ফাঁদিস। আমার দু পয়সা রোজগার বাড়বে আর তুইও বাতাসা পাবি। মানে আমার মাইনে করা ভূত হয়ে যা। মাসে এককেজি বাতাসা তোর মাইনে বল রাজি?' কথা শেষ হতে না হতে মুড়ো ঝাঁটা দমাদম পিটতে শুরু করল মাধাইকে। সাথে খোনা গলায় হুঙ্কার, “হতভাগা মিনসে ভূতরে বেগার খাটানোর ধান্দা করতাসো তুমি? ঘাড় ভাঙা ছাইড়্যা দিসি বাতের বেদনার জন্যি তাই বলি ঝ্যাঁটা চালাইতে ভুলি নাই হতভাগা। ফের যদি দ্যাখসি ওর পেছু পেছু ঘুরতে তাইলে এই মুড়ো ঝ্যাঁটা দিয়া বাইরাইয়া তুমার ঘাড় ভাঙুম!” মাধাই একছুট লাগাল বাড়ির দিকে। লিকলিকেকে দেখতে পায় না হাড়কেলি। ভালো করে তাকিয়ে দেখে গাবগাছের মগডালে ঘনীভূত হয়ে আছে। “ছিঃছিঃ অনামুখো কুথাকার - লজ্জা নাই তুমার। একডা মাইনসে তুমারে চাকর রাখে আর তুমি বাতাসার লোভে স্বীকার যাও। ছিঃছিঃ!” লিকলিকে নাক চোখ কুঁচকে গোঁজ হয়ে বসে ভাবতে লাগল। হে ভগবান, এই ছিঃ ছিঃ শোনা থেকে কি মুক্তি নেই? ভূত হবার চেয়ে আর কোনো বিড়ম্বনা নেই। বেঁচে থাকলে তাও মরা যায় কিন্তু ভূত হলে সব শেষ। আজকাল তো পালিয়েও লাভ নেই। ঐ ব্যাটা প্রেসিডেন্ট এমন সব কায়দা করে রেখেছে লোকেশান ফোকেশান ঠিক জেনে যায়। ধুত্তোর জীবন থুড়ি মরণ।