ঘরটা যেন আজও কুয়াশা ঘেরা। চিতার ধোঁয়ার মতো শুধু পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্ধকার। আবার সেই সময় উপস্থিত। ধূ ধূ মাঠের মতো নীরবতা, ঝিঁঝিঁদের ডাক যেন কতদূর থেকে চরম কাছে এসে ছুঁয়ে দেবে ওকে। কিন্তু না! এবারও না ছুঁয়েই ফিরে গেল। চারপাশে এত আলো তবু দামি ভারী পর্দায় দাগ কাটছে না শহুরে আলো। দম হাঁপিয়ে উঠে সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে উঠছে। অপর পাশের দেওয়ালে সেই সেই ছায়াটা! আবার সে কেমন পরাবাস্তব দুনিয়ার জীব হয়ে যাচ্ছে! সামনে তাকালেই নিজের ছবির পাশে ভেসে উঠছে কালো তামাটে কতকগুলো অবয়ব। বড্ড চেনা কিন্তু মনে করতে পারছে না। হ্যাঁ, আজও ওদের অগোছালো একরাশ অবিন্যস্ত চুলের ভিড়ে আবার হারিয়ে ফেলছে পুপে নিজের অস্তিত্ব। মুখ ঢেকেছে দুহাতে। চিৎকার করার ক্ষমতা রহিত সে এখন। রাগ, ক্ষোভ কান্না হয়ে ঝরে পড়তে চায়। কারণ এসব তার নিজের ই ক্ষয়ক্ষতির কারণ। সেদিন তা র আঙুল কেটেছে, তার আগে হাত! কেন যে মাঝে মধ্যে এমন হয়...ভয় মেশানো বিরক্তিতে গলা বেয়ে উঠে আসে কিছু আগে খাওয়া জেমসের মিষ্টি থুতুর দলাটা। তেষ্টা পেয়েছে বডড। অথচ উঠে যাওয়ার অবস্থা নেই। পায়ে শুরু হয়েছে কম্পন। যেতে গেলেই তো ওরা রাস্তা আটকে...দাঁতের চারপাশে লেগে থাকা চকলেটগুলো ধীরে চেটে খেতে হচ্ছে একটু জলের আশায়। তবু অদম্য চেষ্টা তাকে করতেই হবে। মিনতি মাসি বলেছে যা দেখে ভয় সৃষ্টি হয় শরীর, মনে, তা থেকেই নাকি মুক্তি মেলে। তাছাড়া সেও তো পড়েছে চৈনিক এক রাজা আয়নায় প্রত্যেকের প্রতিকৃতি দেখে নাকি তাদের মানসিক চিন্তা ভাবনা যাচাই করতেন। তাই সব শক্তি এক করে পুপে চোখ রাখে সামনে ছোট আঙুলের করগুলো ফাঁক করে। বুকের ধুকপুকুনি নিজেই টের পাচ্ছে। শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়েছে। ততক্ষণে রিয়া এসে দাঁড়িয়েছে। "পুপে!" নাম ধরে ডাকতেই কেমন যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আবার সব স্বাভাবিক। দুপুরের আলো এবার জানলা, ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকছে । পুপেদের খাট, ফুলকাটা গোলাপি চাদর সব তো একই আছে। আয়না তো কোথাও নেই। তবে সেই বিচ্ছিরি জিনিসগুলো...পুপের এখন বয়ঃসন্ধি কাল। ×××××××× মিঃ, মিসেস রাইয়ের অত্যন্ত আদরের বহু আকাঙ্খিত সন্তান পুপে। ছোট্ট থেকে আরামের জীবনে যে কষ্টের ব্যতিক্রমও শিখতে হয় তা পুপেকে শেখানো হয়নি। বিধবা মিনতি ওর তিন বছরে সেই যে কোলে তুলে নিয়েছিল ব্যাস তারপর থেকে চলেছে এভাবেই। ব্যস্ততম ব্যবসায়ীদের দিনপঞ্জি যেমন হয় আর কী! সবদিক সামাল দিত মিনতি। ভরসার মাত্রা এখন সম্পত্তি অবধি পৌঁছেছে। মিনতিকে দম্পতি আশ্বস্ত করেছেন পুপেকে যথার্থভাবে সব দায়িত্ব নিয়ে গড়ে তুলতে পারলে জীবনের অন্তিমে তারাই লিখে দেবেন সম্পত্তির কিছু অংশ তাকে। কখন মেয়ে শৈশব থেকে কৈশোর হয়ে যৌবনে পা রেখেছে লেট নাইট পার্টি সেরে ফিরে খোঁজ নেওয়ার সময় থাকত না মায়ের, সময় ছিল না মেয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটানোর। অগাধ বিশ্বাসী মিনতি ছিল ওনাদের হাতের নুড়ি। কিন্ডারগার্ডেন থেকে পুপের বন্ধুত্ব রিয়ার সঙ্গে । ওরা একই পাড়ায় থাকে। যদিও ওর মা-বাবাও চাকরি করে, রাত করে বাড়ি ফেরে কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের স্পেসটুকুর মাঝে স্নেহময়ীর ছোঁয়া আছে। পুপের ভালো লাগে। তাই জোর করে মিনতি মাসির কাছে বায়না করে রিয়ার সঙ্গে খেলতে আসে ওদের বাড়ি। পুপে দিন কতক বড্ড বেখেয়ালি আছে ক্লাসে, মনমরাও প্রায়। ঘনঘন সেটা রিয়া লক্ষ্য করেছে। অথচ চোখের তারায় খেলা করে উদ্বেগ। বহুবার জিজ্ঞেস করেও কোন ফল মেলেনি। পুপের ও ইচ্ছে করে বাঁধ ভেঙে কত কী বলতে রিয়াকে। তবু এই দমবন্ধ করা মুহূর্তগুলো শুধু দেখে যেতে হয় তাকে। বলতে ইচ্ছে হয় এমন অগোছালো তার ড্রেস, হেয়ার স্টেপ কেন! আয়না তার ছোট্ট জীবনের সমস্ত শান্তি কেড়ে নিয়েছে। পুপে অনেকবার এগিয়েও গেছে কিন্তু মুহূর্তে মনে পড়েছে বিফল প্রতিবাদের পুরস্কার, মা'য়ের তার প্রতি বেড়ে ওঠা অবিশ্বাস। মিনতি মাসির জন্য অগাধ বিশ্বাস। "দুটো জিনিসে কোন মিল নেই কেন!" পুপে জানে না। মোহনকাকু রিয়ার বাবার ফার্মের কেয়ারটেকার। ফাঁকফোকর খুঁজে পুপের জন্য চকোলেট, জেমস্ নিয়ে ছোটবেলা থেকেই এ বাড়ি আসে। ছোট্ট পুপেও মহানন্দে কার্টুন দেখত আর খেতে ব্যস্ত থাকত। বহুক্ষণ কেটে যায় স্রোতের মতো। ছোট্ট পুপের এবার জল চাই একটু। " মিনতি মাসি কোথায় গেলে?" একদিন সাড়া না পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটা দরজা ঠেলে স্তম্ভিত পুপে ! চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখেছিল। সেই দুটো মানুষকে। শরীরে একেবারে কিছুই নেই। আয়নার সামনে ওরা নিজেদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। হাসছে। জড়িয়ে ধরে ঠিক আয়নার সামনের বিছানাটাতে শুয়ে কী করছে যেন! পুপে এবার চিৎকার করে ফুঁপিয়ে ওঠে। দৌড়ে যায় মাম্মি-পাপাকে ফোন করতে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ নোংরা মতন লোকটা ছুটে গিয়ে ধরে ফেলে তাকে। আয়নার সামনে গলা ধরে শূন্যে দোলাচ্ছে। মিনতি মাসিও উইচের মতো ছাড়া চুলগুলো মুখের ওপর এলিয়ে দিয়েছে। পুপে প্রাণভয়ে ছটফট করছে। মাসি মাথাটা আয়নায় ঠেসে ধরেছে। ভেতর থেকে বোধহয় অন্য কোন উইচকে ডাকছে। পুপের চোখে ভেসে উঠছে এক অচেনা মুখ আয়নায়। দ্বিগুণ চিৎকার করছে পুপে। তখন ওর গলা ছেড়ে ঐ লোকটা জোর করে বিছানায় বসিয়ে চেপে ধরে ওকে। কী বিশ্রি করে হেসে মিনতি মাসি বলছে , " কিছু যদি বল কোথাও, আয়নার ওপাশের ওরা তোমাকে শেষ করে দেবে জান তো!” ছোট্ট শরীরটা ধীরে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এলিয়ে পড়ছে বিছানায়। " মিনতি মাসি কোথায় গেলে?" একদিন সাড়া না পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটা দরজা ঠেলে স্তম্ভিত পুপে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখেছিল। সেই দুটো মানুষকে। শরীরে একেবারে কিছুই নেই। আয়নার সামনে ওরা নিজেদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। হাসছে। জড়িয়ে ধরে ঠিক আয়নার সামনের বিছানাটাতে শুয়ে কি করছে যেনো! পুপে এবার চিৎকার করে ফুঁপিয়ে ওঠে। দৌড়ে যায় মাম্মি-পাপাকে ফোন করতে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ নোংরা মতন লোকটা ছুটে গিয়ে ধরে ফেলে তাকে। আয়নার সামনে গলা ধরে শূন্যে দোলাচ্ছে। মিনতি মাসিও উইচেসের মতো ছাড়া চুলগুলো মুখের ওপর এলিয়ে দিয়েছে। পুপে প্রাণভয়ে ছটফট করছে। মাসি মাথাটা আয়নায় ঠেসে ধরেছে। ভেতর থেকে বোধহয় অন্য কোন উইচেসকে ডাকছে। পুপের চোখে ভেসে উঠছে এক অচেনা মুখ আয়নায়। দ্বিগুণ চিৎকার করছে পুপে। তখন ওর গলা ছেড়ে ঐ লোকটা জোর করে বিছানায় বসিয়ে চেপে ধরে ওকে। কি বিশ্রী করে হেসে মিনতি মাসি বলছে " কিছু যদি বল কোথাও, আয়নার ওপাশের ওরা তোমাকে শেষ করে দেবে জানো"। ছোট্ট শরীরটা ধীরে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এলিয়ে পড়ছে বিছানায়। এরপর বেশ কয়েকবার এমন ঘটনার মুখোমুখি হলেও পুপে আতঙ্কে মুখ চেপে নেমে এসেছে।। বড় হতে হতেই আয়নায় নিজের অবয়ব দেখার অস্বস্তিটা বাড়তে থাকল। আয়নায় নিজের ছবি ভেসে উঠলেই পুপে দেখে এক সুন্দরী মেয়েকে। এটা কি সে নিজে! না অন্য কেউ! বুঝতে পারে না। সব কেমন গুলিয়ে যায়। কিন্তু আয়নাস্থিত মেয়েটা কিছু পরেই পিছন ঘুরে যায়। তখন সুন্দরী রূপ বদলে হয়ে ওঠে বীভৎস। একঢাল কালো লম্বাচুল নিমেষে কুঁকড়ে ঝুপরিয়ে কেমন ভয় ধরায় মনে। এ পুপে নিজে দেখেছে বহুবার। আতঙ্কে তখন চিৎকার করে ওঠে সে। না! পুপে ভেবেছে মনে সাহস করবে এমন একটা ঘরে থাকবে যে ঘর আয়নাবিহীন। প্রতিটা আয়নাতেই আজকাল ঘটে চলে আরো বীভৎস সব ঘটনা। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারেনা পুপে। কী মানসিক যন্ত্রনা যে তার! "মির্টলেস প্ল্যান্টেসন"এর সেই ছোটবেলায় দিদুনের কাছে শোনা অভিশপ্ত আয়নার ভূ তুড়ে ঘটনাকে ছাপিয়ে যাওয়া খামারবাড়ির রহস্যময় সেই আয়নার ঘটনা যেন এখন পুপে অনুভব করে চোখের সামনে। বহুবার ঢাকা দেওয়া সত্বেও কে যেন অলৌকিক বলে অনাবৃত করে দেয় তার আয়না। ×××××××××× "জানিস, সব সময় ওরা সামনে আসে। ভয় হয়। টয়লেট পায়।" বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে নামছে জলের ধারা। "কারা বল পুপে? কারা আসে সামনে?" "আয়নার বাসিন্দা সারা উড্রফ নামের এক মহিলা এবং তাঁর দুই শিশুসন্তান।" "কী যা তা বলছিস পুপে! ওসব তো গল্প কথা রে!" "তুই বুঝতে পারছিস না রিয়া। কমপক্ষে দশটি প্রেতাত্মার বাস ওই অপরদিকের অপরিচিত জগতে। সময়ে সময়ে ওরা হানা দেয়। অপরিচিত জগতে যাওয়ার জন্য ডাকে আমাকে। অপেক্ষা করে। তারপর রাগ প্রকাশ করে চলে যায়। বলেছে সময় সুযোগ বুঝে আমাকে নাকি...!" পায়ের নখে নখ ঘষে পুপে। আর মিনতিমাসি তো বহুবার বলেছে এমন সত্যি হয়। "আরো শোন, খোলা পড়ে থাকা আয়না থেকে ভেসে আসে সারা ও তাঁর বাচ্চাদের আর্তি। ওরা আমাকে কানের পাশে অহরহ কী সব বলে! জানিস, মাঝে মাঝেই দেখা যায় ওই আয়নায় ছোট শিশুর হাতের ছাপ। তোকে দেখাবো একদিন। ভেসে ওঠে কোন অচেনা বৃদ্ধ মহিলার নিষ্ঠুর চেহারা। ঘরটা যেন ভেঙেচুরে ঢুকে যেতে চায় আয়নার পৃথিবীতে। বিশ্বাস কর!" আজ এত কথা রিয়াকে বলতে পেরে যেন আশ্বস্ত লাগছে পুপের। শান্তির একটা দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে আসে বুকের অন্তঃস্থল থেকে। হতবাক রিয়ামএ জটিল পরিস্থিতির গভীরতা বুঝতে পারে। বুঝতে পারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ির বড়দের সঙ্গে কথা বলা দরকার সমস্যা আরো জটিলতর হওয়ার আগে। ঘরটা অন্ধকার নয় তবু যেন অন্ধকারটা আলো-আবছায়া হয়ে ঝুলে রয়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে। ঘরের চরিত্ররা স্পষ্ট হতে গিয়েও হতে পারছে না। সামনেই আয়নাটা,আংশিক দেখা যাচ্ছে নিজের অবয়বটা। পুপের শরীর বেয়ে টুপটুপিয়ে নামছে ঘাম। আজ তাকে তো পারতেই হবে। তাই উন্মাদের মতো চিৎকার করছে, “মোহনকাকু, মাসি কী করছ এসব তোমরা!" পুপের দুর্বলতা,ভীতির খোঁজ রাখা মাসি আক্রোশে ছুটে যায়। চুলের মুঠি ধরে ছিঁচড়িয়ে এনে বসায় আয়নার সামনে। ততক্ষণে আতঙ্কে চিৎকার করে কাঁদছে পুপে। "ওকে ছেড়ে দাও তোমরা।" দ্বিগুণ উচ্চস্বরে চেঁচায় রিয়া। মোবাইলটা দেখিয়ে বলে, "তোমাদের অপকীর্তি ভিডিও তুলে পাঠিয়েছি সকলের কাছে। এমনকী বাবার বন্ধু পুলিশকাকুকেও। তোমরা নিজের স্বার্থে ছোট্ট থেকে পুপেকে এভাবে কষ্ট দিয়ে ওকে মানসিক অসুস্থ করে তুলেছ! তোমরা চরম অপরাধী।" পুপে ততক্ষণে এতদিনের ভয়, জমে থাকা আতঙ্কের জড়তা কাটিয়ে বন্ধুর ভরসার ছোট্ট বুকটাতে আশ্রয় নিয়েছে। চোখ দিয়ে বেয়ে নামছে স্বস্তির আশ্বাস। এবার বোধহয় মা-বাবা সব স--ব বিশ্বাস করবে। চোখের জল পরম আদরে দুহাতে মুছিয়ে দিচ্ছে রিয়া।