নক নক

নিউটাউন, কলকাতা

 


“স্যার, আপনাকে বড়বাবু ডাকছেন”, চেয়ারের একেবারে পাশে এসে জানাল বেয়ারা হরিপদ। 
 আবার কী হল রে বাবা! বড়বাবু মানে অফিসের বস প্রহ্লাদ। সে ডাকলেই বুক ঢিপঢিপ শুরু হয়ে যায় হেমাঙ্গর। হরিপদও কি সেটা জানে? ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, কেমন একটা বদমায়েশি হাসি হাসছে। অবশ্য অফিসের সবাই জানে। হরিপদ না জেনে থাকলে সেটাই আশ্চর্যের। যাই হোক, ডেকেছে যখন যেতে তো হবেই।
        ভয়ে ভয়ে বসের কেবিনের দরজায় গিয়ে দুবার নক করল হেমাঙ্গ।
        “কাম ইন”, বাঁজখাই গলায় অনুমতি এল ভেতর থেকে।
        হেমাঙ্গ দরজা খুলে ঢুকতেই প্রহ্লাদ বলে উঠল, “আরে আসুন আসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম এতক্ষণ। অবশ্য যা কাজকর্ম করছেন, না ভেবে কী আর উপায় আছে! বসুন বসুন।”
        জড়সড় হয়ে বসের সামনের চেয়ারটায় বসল হেমাঙ্গ। ডানদিকে একটা ছোটো টেবিল চেয়ারে বসে আছে বসের সেক্রেটারি পিয়ালী। হেমাঙ্গ বসামাত্রই পিয়ালী একটা ফাইল ধরিয়ে দিল বসের হাতে। প্রহ্লাদ সেটা খুলে তার মুখটা হেমাঙ্গর দিকে ঘুরিয়ে টেবিলের উপর রাখল।
        “বলি, এটা কী করেছেন হেমাঙ্গদা? আপনাকে বলেছিলাম ট্যাবুলার ফর্মে দেখাতে। আর আপনি কিনা পাতি লিখে ছেড়ে দিয়েছেন? আর তাতেও হিসেবে গরমিল? আপনার জন্য তো ক্লায়েন্ট কোম্পানি ছেড়ে চলে যাবে মশাই। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে থাকতে রাজি করিয়েছি। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। তাই আপনাকে সম্মান করি। কিন্তু এভাবে কাজ করলে চলবে?”, কেটে কেটে দাঁত চেপে বলল প্রহ্লাদ।
        হেমাঙ্গর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে, “আমি তো ট্যাবুলার ফর্মেই পাঠিয়েছিলাম স্যার। আপনিই তো চেঞ্জ করালেন। আর ডেটা কালেকশন তো আমার কাজ নয়। ওটা তো পিয়ালীর কাজ। সে আমাকে যা ডেটা দিয়েছে, আমি তো তাই দিয়েই ফাইল তৈরি করেছি।”
        কিন্তু এসব একটা কথাও হেমাঙ্গর মুখ দিয়ে বেরোল না। মাথা নীচু করে সে বলল, “ভুল হয়ে গেছে স্যার। পরের বার থেকে আর হবে না।” 
        “প্রত্যেকবারেই তো ওই একটাই বুলি আওড়ান। কাজটা করার সময় একটু চোখ কান খোলা রাখুন। নিন ধরুন। ঠিক করে নিয়ে আসুন”, বলে ফাইলটা হেমাঙ্গর হাতে ধরিয়ে দিল প্রহ্লাদ। আসলে হেমাঙ্গ মানুষটাই ওরকম। বিয়াল্লিশ পেরিয়েও মেরুদন্ড সোজা রেখে চলতে শিখল না। সবসময় মুখ বুজে সব কিছু সহ্য করে যায়। তাই তো ওর চেয়ে কম এক্সপিরিয়েন্সের ছেলেদের প্রোমোশন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের প্রোমোশনটা বহুদিন আটকে থাকলেও সে সম্বন্ধে টুঁ শব্দটি করার সাহস নেই হেমাঙ্গর। চাকরি হারানোর বড় ভয় তার। এই মন্দার দিনে নতুন চাকরি জোগাড় করা কি অতই সোজা? তার ওপর নিজের যোগ্যতার ওপরেও হেমাঙ্গর খুব একটা ভরসা নেই। চাকরি জীবনের শুরু থেকে এখানেই কাজ করে আসছে সে। এই বয়সে আবার নতুন চাকরির কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। নিজের টেবিলে ফেরত এসে ফাইলটা আবার ‘ঠিক’ করতে বসল হেমাঙ্গ।
বারবার অফিসের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে হেমাঙ্গর। ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। যাহ্‌, অনেক রাত হয়ে গেল। মাধবী বলেছিল, অফিস ফেরত বাড়ি যাওয়ার সময় কিছু সব্জি কিনে নিয়ে যেতে। কাল সকালে রান্না করার মত একটাও দানা নেই। কিন্তু এত রাতে দোকানপাট কী আর খোলা থাকবে!
        আসলে ওই দীপকটাই যত নষ্টের গোড়া। ফার্স্ট হাফ পুরোটাই তো বসের ধরিয়ে দেওয়া ‘ভুল’গুলো ঠিক করতে বেরিয়ে গেল। তারপর নিজের কাজটা যখন প্রায় শেষ করে ফেলেছে, তখনই ‘হেঁ হেঁ’ করতে করতে এল দীপক।
“নতুন নতুন বিয়ে। আজ আবার বউয়ের জন্মদিন। দাদা বুঝতেই তো পারছ। বউকে রেস্তোরাঁয় না নিয়ে গেলে আমায় আর আস্ত রাখবে না। ফাইলটা আজ তুমিই একটু সেরে দিও প্লিজ। খুব একটা বেশি বাকী নেই…” এইসব ভুজুংভাজুং দিয়ে সন্ধের আগেই কেটে পড়েছে ব্যাটা। ফাইল খুলে হেমাঙ্গর তো মাথায় হাত। এ তো অনেক কাজ বাকী। বিড়বিড় করে কতগুলো গালি দিল সে। আসল কথা হল, আজও হেমাঙ্গ সরাসরি কাউকে ‘না’ বলতে পারে না। আর তার সেই ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে নানা লোকে নানারকম কাজ করিয়ে নেয়। অফিসের ‘খড়ুশ’ বস প্রহ্লাদ তো গাধার মত খাটায়ই, কলিগরাও সুযোগ ছাড়ে না।
        কিন্তু এবার অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। বেয়ারা হরিপদও বেরিয়ে গেছে ঘন্টা দুয়েক আগে। দিনের বেলা যে অফিসে সবসময় জমজমাট, এই রাত্তিরে এখন এক্কেবারে খাঁ খাঁ করছে। ফাইলটা যখন সম্পূর্ণ শেষ হল, তখন দেওয়াল ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটাটা নয়-দশের মাঝামাঝি আর মিনিটের কাঁটা ছয়ের গায়ে লেগে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোল হেমাঙ্গর বুক ঠেলে। যাক বাবা, ফাইনালি! এবার ফাইলটা বসের কেবিনে তার টেবিলে রেখে তবে ছুটি। নাহলে কাল সকালে তুলকালাম কাণ্ড বাধাবে প্রহ্লাদ।
        ভালো করে আড়মোড়া ভেঙে ফাইলটা হাতে নিয়ে উঠল হেমাঙ্গ। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বসের কেবিনের দিকে। কাঠের দরজাটা লাগানো। দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে ডানদিকে সোফার দিকে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। বস প্রহ্লাদ, সেক্রেটারি পিয়ালীর গায়ের ওপর থেকে তড়াক করে উঠে বসল। দুজনেই দারুণ হুড়মুড়িয়ে নিজেদের শার্টের বোতাম লাগাতে শুরু করেছে। রাগে বসের ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে উঠেছে। তোতলাচ্ছে সে, “হাউ ডেয়ার ইউ কাম টু মাই রুম উইথআউট নকিং?”
        হেমাঙ্গ এই দৃশ্যের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। একেবারে হাঁ হয়ে গেছে সে। কোনো জবাবই তার মুখে জোগাচ্ছে না। কোনোমতে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে স্যার… এই ফাইলটা… আপনার কালকের মিটিংয়ের… আমি আসি স্যার।” 
“গেট লস্ট”, চিৎকার করে উঠল প্রহ্লাদ।
ফাইলটা হাতে নেওয়া অবস্থাতেই পড়িমরি করে বাইরে বেরিয়ে এল সে। মাথাটা পুরো ভোঁ ভোঁ করছে। সে তো কল্পনাও করতে পারেনি যে এত রাতে বস তার কেবিনে থাকবে। তাও আবার পিয়ালীর সঙ্গে। অফিসে অনেকেই বস আর পিয়ালীকে নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস করে বটে। কিন্তু হেমাঙ্গ আজ পর্যন্ত সেইসব আলোচনায় কোনোদিন যোগ দেয়নি। যে যা করছে করুক। আদার ব্যাপারি হয়ে তার জাহাজের খবরে কী দরকার! কিন্তু আজ যে ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। বস হিসেবে প্রহ্লাদ এমনিতেই অত্যন্ত নাক উঁচু আর অমানবিক। এমপ্লয়িদের যথার্থ অর্থেই চাকর মনে করে। কারও চাকরি খেতে তার একটুও হাত কাঁপে না। সেই বস এভাবে হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়াটা কি সহজে মেনে নেবে? এতদিন গুজগুজ ফিসফাস চলত, সে পাত্তা দিত না। কিন্তু এবার যে একজন প্রত্যক্ষদর্শী… হেমাঙ্গর রীতিমত ঘাম দিতে লাগল। নিজের টেবিলে ফাইলটা রেখে প্রায় দৌড়েই বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
 
বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না হেমাঙ্গর। বুকের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি। একটা চাপা ভয়। মদের নেশা নেই হেমাঙ্গর। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ওই মাঝেমধ্যে এক-আধবার। সিগারেটও কমই খায়। কিন্তু আজ ওল্ড মঙ্কের পাঁইট আর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে দীঘির পাশের ফাঁকা মাঠটায় গিয়ে বসল সে। বছরের পর বছর সব অপবাদ, লাঞ্ছনা বিনা বাক্যব্যয়ে সহ্য করে এসেছে। শুধুমাত্র চাকরিটা টিকিয়ে রাখার জন্য। উপরওয়ালা দারুণ কিছু বুদ্ধি বা ট্যালেন্ট দিয়েও পাঠায়নি যে “রাখুন আপনার চাকরি” বলে বেরিয়ে যাবে। এই কাজটা ছাড়লে অন্য আর কেউ যে তাকে নতুন করে বহাল করবে, তার কি গ্যারান্টি আছে? তার ওপর এখানের কাজকর্মেও সে দারুণ অভ্যস্ত। নতুন জায়গা মানেই নতুন কাজ, নতুন লোকজন – হেমাঙ্গ জানে, তার মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার সেই ক্ষমতা নেই। খুব ভয় করছে এখন। গলা দিয়ে নেমে যাওয়া ওল্ড মঙ্কও সেই ভয় কাটাতে পারছে না। আজ যে দৃশ্য সে চাক্ষুষ করেছে, এরপর আর ওই অফিসে কোনোভাবেই তার জায়গা হবে না। তাহলে সংসার চলবে কীকরে? জমা বলতে তেমন কিছুই নেই। ছেলের স্কুলের বেতনও তো অনেক। খাবে কী তারা? চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল হেমাঙ্গর।
        “বলি এতক্ষণ কোথায় ছিলে শুনি? সব্জি কই? সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি। ফোনটা তুলছোও না একবার”, বাড়ির দরজা খুলেই ঝাঁঝিয়ে উঠল মাধবী। তারপর নাক তুলে তুলে শুঁকে বলল, “এই রাতবিরেতে তুমি মদ খেয়ে এসেছ?”
        নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না হেমাঙ্গ। মাধবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, “চাকরিটা আর থাকবে না মাধবী।” মাধবী স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল হেমাঙ্গর হৃদস্পন্দন।
        ছেলেটা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হেমাঙ্গ খাওয়ার টেবিলে বসে মাধবীকে সব ঘটনা খুলে বলার পর শেষে বলল, “আমার খুব ভয় করছে মাধবী। চাকরিটা চলে গেলে তিনজনকেই যে পথে বসতে হবে।”
        মাধবী হেমাঙ্গর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “অত চিন্তা কোরো না। কাল সকালে বড়বাবুর সঙ্গে গিয়ে কথা বোলো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
        সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি হেমাঙ্গ। এই বয়সে এসে সিভি হাতে কোথায় কোথায় ঘুরতে হবে তাকে, ভেবে ভেবেই ঘুম উড়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু ঘুরলেই কি আর চাকরি পাবে? মনে মনে ঠিক করল, কাল সকালে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে। দরকার হলে বসের হাতে-পায়ে পড়ে যাবে। আর্জি জানাবে, সে যা দেখেছে, সে সম্বন্ধে ঘুণাক্ষরেও কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। শুধু দয়া করে চাকরি থেকে তাকে যেন বরখাস্ত করা না হয়।
        সকাল সকাল তাড়াতাড়ি স্নান, ব্রেকফাস্ট সেরে আটটার মধ্যে অফিসে ঢুকে পড়ল হেমাঙ্গ। কালকের ফাইলটা নিয়ে বসের কেবিনের দরজায় ঠক ঠক করল। খুব শিক্ষা হয়েছে কাল। নক না করে আর ঢুকছে না সে। নাহ, কেউ নেই। বসের টেবিলে ফাইলটা রেখে নিজের জায়গায় ফিরে এল। মনে মনে সাজাতে থাকল কথাগুলো। বস এলে কীভাবে আর্জি জানাবে।
        দশটা থেকে অফিস শুরু হলেও যে বস এগারোটার আগে কোনোদিন অফিসে ঢোকে না, হেমাঙ্গকে অবাক করে দিয়ে সে আজ ন’টাতেই অফিসে ঢুকে গেল। নিজের কেবিনে ঢোকার পথে হাসিমুখে হেমাঙ্গর দিকে তাকিয়ে বলল, “হেমাঙ্গদা, আমার কেবিনে একটু আসবেন।” 
        বুক দুরুদুরু করতে লাগল হেমাঙ্গর। চাকরি থেকে তাকে ছাঁটাই করার এত তাড়া যে সকাল সকাল চলে এসেছে? কেবিনের দরজায় গিয়ে ঠক ঠক করল সে।
“চলে আসুন, হেমাঙ্গদা।”
গলাতে কেমন যেন নরম সুর! নাকি হেমাঙ্গর মনের ভুল?
ভেতরে ঢুকতেই সামনের চেয়ারের দিকে ইশারা করে প্রহ্লাদ বলল, “আরে বসুন বসুন।”
গুটিসুটি মেরে বসল হেমাঙ্গ। সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল প্রহ্লাদ, “নিন নিন।”
বলি দেওয়ার আগে পাঁঠাকে যেমন ভালোমন্দ খাওয়ানো হয়, ঠিক তেমনই অনুভূতি হচ্ছে হেমাঙ্গর। দ্বিধাগ্রস্ত হাতে তুলে নিল একটা সিগারেট। তারপর বলতে শুরু করল, “স্যার, কালকে রাতের ঘটনাটা…”
“আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে”, বলে প্রহ্লাদ থামিয়ে দিল হেমাঙ্গকে। লাইটার দিয়ে নিজের সিগারেটটা জ্বালাল। তারপর হেমাঙ্গর মুখের সামনে এনে ওর সিগারেটটাও জ্বালিয়ে দিল।
এরপর একটা জোরে টান মেরে বলল, “হেমাঙ্গদা, আপনার প্রোমোশনটা বহুদিন ধরেই আটকে আছে। আচ্ছা লোক মশাই আপনি। হাজার একটা কাজ থাকে আমার। আপনি একবার মনে করাবেন না? যাই হোক, চিন্তার কিছু নেই। নেক্সট মান্থেই আপনার প্রোমোশনটা ক্লিয়ার করে দেব। তাছাড়া আপনার স্যালারিটাও এক্সপিরিয়েন্সের তুলনায় বড্ড কম। ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলে সেটাও কিছুটা বাড়িয়ে…”
এরপরের কথাগুলো আর কানে ঢুকছিল না হেমাঙ্গর। ঠোঁটদুটো তার এমনভাবে খুলে গেল যে, আটকে থাকা সিগারেটটা টুপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। ভাগ্যিস কাল দরজায় নক করেনি…

বৈশাখী ২০২৪