পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা

শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ

ব্যাপারটা ঘটেছে রথের দিন। 
বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, উলটে আমায় গাঁজাখোর বলবে জানি। তবুও দুঃখের কথা বলে অল্প হালকা হতে চাইছি। 

রথের দিন মা সকাল সকাল উঠে মাসির বাড়ি চলে গেল। আগের রাতেই অবশ্য বলে রেখেছিল। মাসির শ্বশুরবাড়িতে বিগ্রহ আছে জগন্নাথদেবের। রথের দিন তাই বিশেষ পুজো, কীর্তন এসব  হয়। আমায়ও বলেছিল যেতে, আমি রাজি হইনি। আগে আগে গেছি, মহা বোরিং ব্যাপার। ছোটোবেলায় তাও ভালো লাগত, কলেজে উঠে এসব পোষায়! বাবাও বাড়ি নেই, ব্যবসার কাজে বাইরে। মা রাতে খেতে বসে খুব সেন্টুতে সারেঙ্গি বাজাচ্ছিল। 
"বাবান, এই তো বছরে একটা দিন, গেলে তোর সঙ্গে সবার দেখা সাক্ষাৎ হয়। মাসিমা তোর কথা প্রতিবার জিজ্ঞেস করেন। মেসো, ভাইটু তোর জন্য অপেক্ষায় থাকে। মাসি তো থাকেই। তুই যে কেন যেতে চাস না, বুঝি না বাবা! তোর ব্যাপার বোঝা অন্তত আমার কম্মো নয়। সারাদিন কী খাবি? এবার তোর বাবাও নেই। আমি সক্কালে উঠে চলে যাব। রান্না কে করবে? অন্যবার তোর বাবা সামলে নেয়।"
মাকে বুঝিয়ে বললাম। 
"রান্নার চাপ নেই। অনলাইন অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নেব। তুমি নিশ্চিন্ত মনে চলে যাও। বিন্দাস হয়ে থাক। আরে, একটা দিনের তো ব্যাপার। ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।"
মা অল্প গজগজ করল। 
"জানি তো, যত হাবিজাবি এনে খাবি। তাও যাবি না। "
যাই হোক, শেষমেষ মা সাতসকালে একাই রওনা দিয়েছে।বেশ বেলা করে উঠলাম। আজ দিনটা মন্দ নয়। সকাল থেকে হালকা বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ। বেশ রথ রথ আবহাওয়া। দুপুরে অর্ডার দিয়ে বিরিয়ানি আর মোগলাই গোস্ত আনালাম। আরে না না, গোস্ত মানে নিষিদ্ধ মাংস নয়, শুধু দেশি চিকেন। খেয়েদেয়ে জমিয়ে ঘুম। বিকেলে ভাবলাম বন্ধুগুলোর সঙ্গে মস্তি করব। ফোন লাগালাম। কোন ব্যাটাই ফ্রি নেই। একলা আমি কী করি! এক বোতল কোল্ড ড্রিংকস আর বড় এক প্যাকেট চিপস সাঁটিয়ে ঠিক করলাম কুণ্ডুপুকুরের রথের মেলা ঘুরে আসব। বাড়ির কাছেই। যাব, একটু ঘুরেফিরে চলে আসব। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কুণ্ডুপুকুরের মাঠে রথের মেলায় ঘোরা আর নাগরদোলা চড়া অবশ্যকর্তব্য ছিল।  

উফফ! কত্ত বছর পর এলাম। মেলাটা আড়ে বহরে অনেকটা বেড়েছে। তবে নাগরদোলাটা একই আছে। প্রচুর বাচ্চাকাচ্চা ভিড় জমিয়েছে। দেখে খুব মজা লাগল। একা একাই দিব্যি ঘুরছিলাম। টুকটাক মুখ চালাচ্ছি। বেশ একটা ছোটবেলা ছোটবেলা  ফিল হচ্ছে। হঠাত্‍ একটা বাচ্চা এসে বাঁ হাতটা ধরল। অবাক হয়ে তাকালাম। কী মিষ্টি একটা হাসি যে দিল! আমি পুরো ফিদা। হেব্বি স্মার্ট বাচ্চা তো! মনে হয় ভুল করে নিজের কেউ ভেবে আমার হাত ধরেছে। ও মা! তারপর দেখি আমার হাত ধরেই ঘুরছে! যত বলি, "নাম কী তোমার? কোথায় থাক? কার সঙ্গে এসেছিলে? বাবা মা'র থেকে আলাদা হয়ে গেছ? ওদের খুঁজে পাচ্ছ না?"
ছেলেটা কিচ্ছু বলে না, শুধু ঘাড় কাত করে হাসে। হাসি দিয়ে ভুলিয়ে দেয়। হঠাত্‍ মনে হল, বাচ্চাটা বোবা নয়তো? অনেক ভেবে ঠিক করলাম মেলার অফিসে গিয়ে জমা করে আসি। ওর বাবা, মা বা চেনা কেউ দেখতে পেলে আমার ঝামেলা আছে। ছেলেধরা বলে উদোম ক্যালাবে। বোবা বাচ্চাটা তো আর কথা বলে সাক্ষ্য দেবে না। 
এগোলাম অফিসের দিকে। মেলা দেখা মাথায় উঠেছে। যাচ্ছিল বেশ হাত ধরে, অফিসের কাছাকাছি হতেই আর নেই। হাত ছাড়িয়ে কোথায় যে পালাল! ঠিক মনে হল ফুস করে উবে গেল। কত্ত খুঁজলাম, কোন পাত্তা পেলাম না। ধুত্তোর, মরুক গে যাক। হয়তো নিজের বাবা মা কাউকে দেখেছে। স্মার্ট বাচ্চা চলে গেছে তাদের সঙ্গে। আরে যাবি ভালো কথা, বলে যা। ভাবতেই মনে পড়ল বেচারা কথা বলতে পারে না। তাও,হাত নেড়ে, কিছু একটা করে সিগন্যাল দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যাক গে, ঝামেলা গেছে। যত্ত উটকো আপদ। 
জিলিপি আর ফুলুরি কিনে বাড়ি ফিরছি। গুনগুন করে গান গাইছি। রাতে পিজ্জা অর্ডার করব। আহা! রাতে পিজ্জা! অনেকদিন পর খাব। সবে চাবি ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকতে যাব, দেখি বাবু হাজির। আমি তো হাঁ। 
"কী রে, কোথায় চলে গিয়েছিলি? বাবা মা খুঁজবে তো। আমার বাড়ি চিনলি কেমন করে? কাছাকাছি কোথাও থাকিস? আমায় দেখেছিস আগে? "
তোড়ে প্রশ্ন করতে করতে মনে পড়ল বেচারা কথা বলতে পারে না। যাঃ! এখন কী করব? পুলিশে খবর দেব নাকি? মহা মুশকিলে পড়লাম তো! মা, বাবা, বন্ধুদের একের পর এক ট্রাই করছি। কারো নেটওয়ার্ক নেই। মা ,বাবা কেউ ফোন ধরলই না। উফফফ! দরকারের সময় মা, বাবা, বন্ধু... কেউ নেই। কারো সঙ্গে  যে একটা পরামর্শ করব, তার উপায় নেই। ছেলেটা জিলিপির ঠোঙা আমার হাত থেকে নিজের হাতে নিল, তারপর পরিষ্কার গলায় বলল, 
"ভেতরে তো ঢোকো।"
আমি ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো চমকে উঠলাম। 
"অ্যাই, তুই তো দিব্যি কথা বলতে পারিস! এতক্ষণ তবে নাটক করছিলি কেন? কোন বাড়ির বাচ্চা তুই? দাঁড়া, বলছি তোর বাবাকে।"
একগাল হেসে বলে, "আমি তো ভূতের ছানা। বাবা টাবা হয় না আমাদের। আমরা ঠিক করি কার ঘাড়ে চাপব। মেলায় তোমায় বেশ পছন্দ হয়েছে, তাই এখন থেকে তোমার ছানা। "
কী! ক্ষী! সব্বোনাশ! এ কী বলছে রে বাবা! এসব মহা গোলমেলে কথা। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। মহা চালু ছেলে। বারবার বলে ও নাকি ভূতেরই বাচ্চা। বিশ্বাস করছি না দেখে টুক করে চোখের সামনে একবার অদৃশ্য হয়ে আবার ফিরে এল। আমি নাটকবাজটাকে বহুত বোঝালাম। বাবা,বাছা করলাম। এমন কী এটাও বললাম, "চল,যে গাছে থাকিস সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসছি।"
খিক খিক হেসে বলে, "গাছ তো সব কেটে ফেলেছ, গাছে আর থাকব কী করে। আমরা মডার্ন ভূত বুঝলে, গাছে থাকি না, ফ্ল্যাটে থাকি।" 
আমার চোখ ছানাবড়া। আমাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে ও ব্যাটা দিব্যি আমার খাটে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে জিলিপি খেয়ে যাচ্ছে। জিলিপি শেষ করে ফুলুরির ঠোঙাটা টেনে নিল। সেগুলোও গবগবিয়ে খেল। আমাকে একটাও দিল না। খেয়েদেয়ে সুচিন্তিত মতামত দিল, "মন্দ নয় তবে মরা ব্যাঙের পাকোড়া আরও ভাল খেতে।"
শুনেই নাক বন্ধ করলাম। ছিঃ, মরা ব্যাঙ! তা দেখে চোখ পাকাল ।
"ইঃ, নাক বন্ধ করার কী আছে, শুনি? তোমরা শুঁটকি খাও না? সেটাও তো মরা আর শুকনো, ত...বে? দাঁড়াও, এক বাটি উচ্চিংড়ের চচ্চড়া আনি" বলে মুহূর্তে ধাঁ। অল্প পরেই তেনার আবির্ভাব। হাতে শালপাতার বাটিতে কালো মতো বিদঘুটে কী একটা! বিচ্ছিরি গন্ধ ছাড়ছে। নাকটা অজান্তেই কুঁচকে ফেলেছিলাম। সেদিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ছুঁড়ে সবজান্তা গলায় জ্ঞান দিল। 
"তোমরা ধনেপাতা ছড়াও না  এটাতে কয়েকটা গান্ধিপোকা দেওয়া আছে।"
ইশ! ছি! গান্ধিপোকা! ওয়াক , থু...আমি বাথরুমে দৌড়লাম। এসে চোখ পাকিয়ে বললাম, "তা মডার্ন হয়ে গাছ ছেড়ে ফ্ল্যাটে থাকিস আর খাবার অভ্যাসে সেই ভুতুড়ে?"
রেগে গেল মনে হয়। চোখ দুটো গোল গোল করে তাকিয়ে থাকল। একটু পর গম্ভীর গলায় জবাব এল, “আপ রুচি খানা ...!”
সটান লম্বা হল আমার বিছানায়। একটু পর এক লাফে উঠে আমার ল্যাপটপটা টেনে নিল 
আরে! আরে! সর্বনাশ! করিস কী! খারাপ হলে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
দাঁত খিঁচিয়ে ভুতুড়ে হাসি হাসল। "চিল করো, বন্ধুদের সঙ্গে একটু চ্যাট করছি।"
সে সব শেষ হলে অনেক বোঝালাম যাতে ভূতের ছেলে ভূতের ঘরে ফিরে যায়। অনেকক্ষণ চালালাম যাকে বলে মানসিক কুস্তি, কিন্তু ব্যাটা নড়ল না। না আমার ঘর থেকে, না পচা খাবার থেকে। 
সেই থেকে দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে আমার ঘরে। রোজ কোথা থেকে কী সব হাবিজাবি এনে খায়, দুর্গন্ধে টেঁকা দায়। টুকরো-টাকরা যা পড়ে থাকে আমায়ই পরিষ্কার করতে হয়। আমার জীবন যাকে বলে হেল মানে নরক হয়ে উঠেছে। তবে ঠিকই বলেছে যে ব্যাটা ভূতের ছানা। আমিও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ এতদিনেও মা বা বাবা কেউ ওকে দেখেনি। যদিও মা মাঝে মাঝে ঘরে ঢুকে আমায় বেজায় ধমক দেয়। 
"কী বাজে গন্ধ রে তোর ঘরে, বাবান! যত্ত হাবিজাবি জিনিস এনে মনে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে খাস। ছিঃ! কী বিশ্রি দুর্গন্ধ! এরপর ঘর পরিষ্কার না থাকলে তোকে বের করে দেব। গ্যারেজে গিয়ে থাকতে হবে।"
আমি সত্যি কথাটা বলি। 
"মোটেও আমি কোন হাবিজাবি জিনিস এনে খাই না। এই ভূতটা আনে, খায়, দোষ দিচ্ছ আমায়।" আঙুল তুলে আমি ওকে দেখাই। 
মা চোখ বড় বড় করে। "তোর এখনও মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস গেল না রে বাবান? ভূতটুত কী উলটোপালটা বকছিস! মোট কথা ঘর পরিষ্কার না থাকলে গ্যারেজে গিয়েই থাকতে হবে শেষ পর্যন্ত। ভূত দেখিয়ে পার পাবি না।" মা নিজের মনে গজগজ করতে করতে চলে যায়। 
এসব শুনে তিনবার ডিগবাজি খেয়ে ভূতের বাচ্চাটা মুলোর মতো দাঁত বের করে হাসে। 
আরে, আরে, কী করছিস!  ...মুছিস না লেখাটা। ...ভুল হয়েছে। কান ধরছি, মাপ চাইছি। ভূতের না, আমার, একদম আমার ছানা। আমার পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা।

বৈশাখী ২০২৪