ভূতুড়ে গপ্পো

বারাসাত, উত্তর চব্বিশ পরগনা

রামচন্দ্র পাল মরে গিয়ে সদ্য ভূত হয়েছে। এখন হয়েছে কী, রাম নাম শুনলে তো ভূত পালায়। তাহলে রামচন্দ্র পালের কী হবে? ভূশন্ডীর মাঠে, একটা বাজ পড়া শেওড়া গাছের আড়াআড়ি একটা ডালে পা ঝুলিয়ে বসে বসে, এই কথাটাই ভাবছিলো রামচন্দ্র পাল। কোথায়, কবে এই কথাটা প্রথম শুনেছিল যেন, রাম নাম শুনলেই ভূত একেবারে ‘বাবাগো মাগো’ বলে ডাক ছেড়ে পালাতে নাকি পথ পায় না? ঠাকুরমা বলত কথাটা। একটা থলের মধ্যে জপের মালা নিয়ে সবসময় খালি জপ করত ঠাকুরমা। আর গ্রামের কেউ মারা গেলেই ওরা যখন সন্ধ্যাবেলায় পুকুরপাড়ে যেতে ভয় পেত, তখন বলত, "রাম নাম কর সবাই। রাম নাম শুনলে ভূত আর পালাতে পথ পাবে না।" এই কথার জন্য ছোটবেলায় রামচন্দ্র তার ভাইবোন আর বন্ধুবান্ধবের কাছে কতো দরই না নিয়েছে। "আমার নাম রামচন্দ্র। ভূত তাড়ানোর জন্য আমাকে রাম নাম করতে পর্যন্ত হয় না। আমি কাছে থাকলে তোদেরও ভূতের ভয় নেই।"
সত্যি কথা বলতে কী, ছোটো ছোটো ভাইবোনেরা সবাই দিব্যি সে সব মেনেও নিত। আর যেখানেই ভূতের ভয়, সেখানেই এসে রামচন্দ্রের কাছ ঘেঁষে থাকত। তখন নিজেকে বেশ একটা কেউকেটা বলেই মনে হত ওর। তখন কে আর ভেবেছিল যে, সেই ছোট্ট রাম একদিন পঁচানব্বই বছর বয়েসে মরে গিয়ে ভূত হবে! একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল রামচন্দ্র পালের। তখনই শুনতে পেল, পাশ থেকে কে যেন বলছে, "তা দিঘ্যশাস পড়ার কথাই বটে! কী ঘেন্না, কী ঘেন্না। সাবেক কালের নিয়ম কানুন সব কিনা বদলে গেল?" 
"কে? ঠাকুরমা?" বলে পাশ ফিরে তাকাল রামচন্দ্র। দেখে কী, সেই সাদা থান কাপড় পরে, ডান হাতখানা একইরকম ভাবে জপের মালা সমেত থলেতে ভরে, পা ঝুলিয়ে ঠিক তার পাশেই বসে আছে রামচন্দ্রের ঠাকুরমা। সেই একই রকম ছোট ছোট করে ছাঁটা মাথার চুল। মুখে একটা রাগি রাগি ভাব। বিস্ময়ে আর আবেগে প্রথমটায় তো কথাই বলতে পারল না রামচন্দ্র। "ঠাকুরমা, তুমি এখানে? ভাবিই নি কখনো।" ঠাকুরমা মুখখানা বাংলার পাঁচের মতো করে বললো, "আমিই কি কোনদিন ভেবিচি? সারা জেবন ধরে এত ধম্মকম্ম করলাম। এত পুজোআচ্চা করলাম। সবই তো পরকালের জন্য! অথচ দেখ, মুক্তি পয্যন্ত মিলল না। এই ভূশন্ডীর মাঠে পিরেত হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্চি।"
“তাই তো। এ তো ভারী অন্যায়। তা তোমার মুক্তি মিলল না কেন?”
“কে জানে! মরবার পর কোথায় ড্যাং ড্যাং করে সোজা সগ্গে যাব ভাবছি, হঠাৎ দেখি, শোঁ করে আত্মাটা একেনে এসে পড়ল। কেউ চেনা নেই, জানা নেই। কাকে কী জিগ্গেস করি? শেষটায়, দেখা হল আমাদের গাঁয়ের সেই সুদখোর যতীন মুকুজ্জ্যের সঙ্গে। মুখখানা ভার করে পুব-দক্ষিণ কোণের তেঁতুল গাছটায় বসে আছে। আমাকে দেখে আদর করে বসতে দিল। তারও দিন একেনে ভালো যাচ্ছে না। একেনে তো কারো টাকাপয়সা কিম্বা বিষয়-আশয় নেই। সেসবের দরকারও নেই। তাই সুদে টাকা ধারও করে না কেউ। এদিকে সুদখোর মহাজনের ওব্বেস যাবে কোথায়? তাই মন খারাপ করে থাকে। আমাকে বলল, ‘দিদি, সেবার বিপদে পড়ে বিছে হারটা যখন বাঁধা দিয়েছিলে, তখন হিসেবে গোলমাল করে বড্ড ঠকিয়েছিলাম। তাই বোধহয় মুক্তি হল না!’ ব্যাপারখানা বোঝ একবার। ওই হার আমার বিয়ের সময়কার। দুই মেয়ে, তিন বৌমা, কাউকে দিইনি। অথচ, সেবার ঘুন্নিঝড়ে পুবের ভিটেটা যখন ভেঙে পড়ল, তোর বাবার কাছে তখন ঘর সারাবার মতো টাকা ছিল না। বাধ্য হয়ে বাঁধা দিসলাম হারখানা। আর আমায় কিনা ঠকিয়েছিল যতীনটা! সে টাকা শোধ করতে তোর বাবাকে কত কীই না করতে হয়েছে!”
“তাই নাকি? তা এই কথা শুনে তুমি কী বললে?”
“কী বলব? বললাম, ‘সারা জেবন আমাকেই তো আর একা ঠকাওনি, দুনিয়ার সক্কলকে ঠকিয়েচো। কিন্তু ভেবে দেখো, আমি সারাটা জেবন খালি ধম্মকম্ম করে গেলাম। একদিনের তরে এক বিন্দু অনাচার করিনি। আমার গতি হল না একটা?’ তাই শুনে যতীন কি বললো জানিস?”
“কী বললো ঠাকুরমা?” 
“বলে, ‘আমি না হয় সুদখোর, পাতকি। আর তুমি দিদি, সারাজীবন ছেলের বউদের কতই না খোয়ার করে গেছ। ভালো করে খেতে পর্যন্ত দাওনি। কাজের মেয়ে চারুকে চিরদিন দূরছাই করেছ। শীতের রাতে, মাটির মেঝেতে কাঁথা পেতে শুতে দিয়েছ। তোমার গরু বাছুরকে যা তোয়াজ করেছ, মানুষকে তা করনি। মতি জেলে পুকুর থেকে বড়ো বড়ো মাছ ধরে দিয়ে যেত। তাকে এক টুকরো মাছ খেতে দাওনি কখনো। তোমার ঘরে অত মাছ খাবার লোকও ছিল না। আর মতি ওর ছেলেমেয়ে নিয়ে উপোস করে দিন কাটাত। সব জেনে বুঝেও তুমি কিছু করনি!’ আচ্ছা বলতো, এসব কী এমন মহা দোষের? আমি কি সারা দুনিয়ার ঠেকা নিয়ে রেখেছি? মতির যা পাওনা, তা তাকে দিইনি আমি? তেঁতুল দিয়ে পান্তোভাত পেট ঠেসে খেয়ে যেত না মতি কাজের শেষে? তবে হ্যাঁ। পয়সা চাইত বটে মাঝে মাঝে। বলত, ‘ছেলেমেয়েদের জন্য চাল কিনে নিয়ে যাব।’ তা আমি কী করবো? একা তোর বাবার ওপর এতবড়ো সংসার। পয়সা দিলে চলে?”
“আচ্ছা ঠাকুরমা, চারুকে তুমি মেঝেতে শুতে দিতে নাকি?” 
“তা কী করব বল্? চারু সারাদিন বাড়ির ময়লা কাজগুলো করত। বাসন মাজা, ঘরদোর মোছা, উনুন পরিষ্কার, উঠোন ঝাঁট দেওয়া- এসবের পরে ওকে কি আর বিছানায় শুতে দেওয়া যায়? বাড়ির সকলের ছিষ্টির বাসি কাপড় কাচত চারু। নিজের তো ছিল দুটো মাত্তর মিলের ছাপার শাড়ি। রাতে এঁটো বাসন মাজার পর বদলে যে নেবে কাপড়খানা, তারও তো ছাই উপায় ছিল না। তবু শীতের সময় গায়ে দেবার জন্য দিইনি কিছু? আমার সব পুরনো চাদর তো ওকেই দিতাম। তারপর, তোর বড়ো পিসি যেবার আমাকে একটা শিমুল তুলোর ভারী লেপ বানিয়ে দিল, তখন পুরনো লেপটা চারুকে গায়ে দিতে দিইনি? আর মেঝেতে শুতো তো কী হয়েছে? কত লোকই তো মেঝেতে শোয়? খাট পালঙ্ক আর ক'জন মানুষের বাড়িতে থাকে বল্ তো?”
“সেই তো। তা ঠাকুরমা, তুমি কি মা, কাকিমাকে সত্যিই খেতে দিতে না নাকি?”
“কোন্ নরাধম বলে এ কথা? কোন কোন দিন যদি বাড়ির পুরুষদের আর বাচ্চাদের খেতে খেতে তরিতরকারী বা মাছ শেষ হয়ে যায়, কিম্বা ভাত একটু কমই পড়ে, তাকে কি খেতে না দেওয়া বলে?”
“একদম না!”
মাথা নেড়ে জানাল রামচন্দ্র। ঠাকুরমা জিজ্ঞেস করল, “তা বাছা, তুমি কেন এখানে? কোনো দোষঘাট করেছ নাকি বেঁচে থাকতে?”
“দোষ যাকে বলে, তা তো কিছু করিনি, ঠাকুরমা। তবে, অফিসে ইউনিয়ন করার নামে একটু আধটু কাজে ফাঁকি দিয়েছি বটে। আর কী বলব তোমায়, ঘুষ খাওয়া বা প্রমোশন পাওয়ার জন্য চালাকি করে অন্য সহকর্মীদের মন্দ প্রতিপন্ন করা- এসবের জন্য কি আর নরকবাসী হতে হয়! এছাড়া, এই.. মানে...এদিক সেদিক নানা জিনিস নিয়ে বাজে লোকজন হিংসে করে প্রচুর মন্দ কথা বলত। বুঝলে না, নিন্দুকের যা কাজ আর কি! তা, তাকে যদি দোষ বল, তবে তাই!”  
“এসব বাছা, কোন্ পুরুষ মানুষটা না করে! বড়ো হতে গেলে একে দোষ বলে না!”
“আচ্ছা ঠাকুরমা, তুমি যে বলতে, রাম নাম শুনলে ভূত পালায়। তা আমার নিজের নামই তো রাম। আর অবস্থার গতিকে আমি এখন ভূত। তাহলে? এখন রাম নামের কী হবে?” 
“তাহলেই বোঝ্। দিঘ্যশাস ফেলা ছাড়া একেনে আর কীই বা করার আছে?”
“কেউ রাম নাম জপলে আমি পালাব নাকি পালাব না, সেটাই তো বুঝতে পারছি না এখনও!”
“আদ্যিকালের সেই সব নিয়ম কি আর চলছে কোথাও? এই যে আমি, কাত্যায়নী দেবী, সাত গাঁয়ের লোক আমাকে এক ডাকে চিনত, আমার পুজোআচ্চা, নিয়ম-নিষ্ঠের জন্যে। সেই আমি পিরেত হয়ে কিনা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর ওই মতি আর চারু, আমার বাড়ির কাজের লোক, তারা সব সরাসরি সগ্গে পৌঁছে গেছে!”
“কী ভাবে?”
“যতীন বলছিল, মতি নাকি ওর ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিতে গিয়ে দিনের পর দিন নিজে না খেয়ে থাকত। বৌয়ের অসুখের সময় রাতদিন সেবা করেছিল রোগাভোগা বৌটার। পুরুষ মানুষ হয়েও নাকি কোন বারমুখো টান ছিল না!”
“আর চারু?”
“সে নাকি তার মরা বোনের ছেলে আর মেয়ে, দুটিকে নিজের বাচ্চাদের সঙ্গে একরকম করে মানুষ করেছে। অভাব অনটনের কথা না ভেবে ওদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে থেকেছে। চারুর জন্যই নাকি ছেলেমেয়ে দুটো বেঁচেবত্যে ভালোভাবে জেবন কাটাতে পেরেছে!”
“আচ্ছা, ঠাকুর্দার খবর কিছু জানো?”
“সে একেনেই আছে। ওই যতীনের সঙ্গে খুব ভাব। একসঙ্গে থাকে সবসময়।”
“আর বাবা-মা?”
“তোমার মা তো স্বামীকে ছেড়ে একা একাই সগ্গে চলে গেচেন। এটা সাত্থোপরতা না, তাই না? আগেকার দিনে কথায় বলত, 'পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য', সেসব কথা এখন বাসি। তবে, তোর বাবা একেনেই আছে!”
“বাবা এখানে আছে? কেন?”
“কেন আবার? সে নাকি সবসময় মায়ের কথা শুনে চলে বউয়ের ওপর অত্যেচার করেছে! বোঝ!”
“আর ঠাকুর্দা?
“তার কথা জিজ্ঞেস করিসনি। তোর সুমুখে আমি বলতে পারব না সেসব কথা!” 
“ছেলেবেলায় যেসব শুনতাম, সেসব তাহলে সত্যি?”
“ও কথা থাক বাপু। খবর তো পাই, ঠাকুদ্দার সে অব্যেস তোমারও কমবেশি রয়েচে!”
“ঠিক আছে। ঠিক আছে। কিন্তু ঠাকুরমা, এই কথাটা আমাকে খুব তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে যে, ভূত আসলে কী? কেউ রাম নাম জপলে ভূত যদি সত্যি সত্যি পালায়, তাহলে আমি কী করব? আমার সামনে কেউ রাম নাম জপলে আমি তো মোটেই ভয় পাব না। আমার নামই তো রাম!”
“এ বড্ড খটোমটো কথা। এর জবাব একমাত্তর সেই বিজ্ঞেনী বাবুই দিতে পারবে।”
“সে আবার কে?”
“সে একজন ভীষণ নামকরা বিজ্ঞেনী। বিজ্ঞেন নিয়ে নাকি তার অগাধ পড়াশোনা। বেঁচে থাকতে অনেক ভারী ভারী কাজকম্ম করেছে। পিথিমি জোড়া নাম তার!”
“সেও এখানে থাকে নাকি?”
“না না। সে একেনে থাকবে কেন? তার তো অক্ষয় সগ্গোবাস। সে শুধু মাঝে মাঝে একেনে আসে ভূতেদের কেলাস নিতে। তাও নাকি হাজার বছর পরে মাত্তর একবার!”
“ভূতেদের ক্লাস নিতে? মানে কী এর?” 
“অতশত আমি জানি না বাপু। একবার এসেচিল একেনে। যতীন আর তোর ঠাকুদ্দা মিলে জোর করে আমায় নিয়ে গেসলো, বক্তিমে না কী সেই সব শুনতে!”
“শুনলে?”
“ধুর। সবাইকে নাকি যেতেই হবে, এই বলে একেনকার যতো ভূত পিরেত, সবাইকে তো নিয়ে গেল। শুনলুম, এই বক্তিমে পুরোটা শুনতে পারলে, বুঝতে পারলে আর মানতে পারলে, নাকি মুক্তি মিললেও মিলতে পারে!” 
“শোনার পরও মুক্তি হল না?”
“আরে, শুনতে পারলে তো! বক্তিমে শুরু হতে না হতেই যতীন আর তোর ঠাকুদ্দা তো দিল সোজা চম্পট। ওরা নাকি সহ্যিই করতে পারেনি বিজ্ঞেনীবাবুর কথা!”
“আর তুমি?”
“আমি? একবার তাকাতেই, আমি সেই যে ঘুমিয়ে পড়লাম, উঠলাম গিয়ে পুরো তিনদিন পর!” 
“তার মানে, আরো এক হাজার বছর ধরে এখানে পড়ে থাকতে হবে আমাদের সবাইকে?”
“বল্ তাহলে, দিঘ্যশাস ফেলা ছাড়া আর কিই বা করার আছে!”

বৈশাখী ২০২৪