ছোটবেলায় ভূতে ধরার গল্প শুনতে শুনতে কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠতাম। বড় বেলাতেও যে কাঁপাকাঁপি করি না, সেটাই বা বলি কী করে? যে কোনও ভূতের মুভি দেখলেই, আমার অন্তত তিনরাত ঘুম হয় না। আমি তাই সযত্নে এসব বিষয় এড়িয়ে যাই। কিন্তু কখনো যদি এমন কোনও ঘটনা জীবন্ত রূপ ধরে সামনে দাঁড়ায়? আমি তখন বেশ বড়। এই ক্লাস নাইন টেনে পড়ি। হঠাৎ শুনলাম, আমাদের পাড়ার পর্ণাদিকে নাকি ভূতে ধরেছে। চমকে উঠলাম। বেচারির বিয়ে আর দিন দশেক পরে, এই সময় একি অনাসৃষ্টি! পাড়ার কাকিমা, জেঠিমা মায় বৌদিরা শুদ্ধ সবাই গালে হাত দিয়ে আলোচনা করতে বসে গেল। সবার মুখে হাহাকার। ও নাকি ভর সন্ধ্যেবেলা ঘর থেকে বেরিয়েছিল। সবাই বারণ করেছিল কিন্তু শোনেনি। বেচারি বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। অনেক কষ্ট করে ওর মা এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি তো কেঁদেই আকুল হচ্ছেন, কী করে বিয়ে হবে? যদি পাত্রপক্ষ বেঁকে বসে? ভূতে ধরা মেয়েকে কেই বা বিয়ে করে? পর্ণাদির এক দূর সম্পর্কের কাকিমা তার দিন দুয়েক আগে, ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছিলেন। সেই তিনিই মায়া ত্যাগ করতে করতেও আটকে পড়েছেন। তিনিই নাকি গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে এসে বেশ ভালোমত ঘাড়ে চেপে বসেছেন। পর্ণাদি সব সময় এলো চুলে একদৃষ্টে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে, আমি পর্ণার বিয়েতে নিমন্ত্রণ খেয়ে তারপর যাব। আমার খুব দেখতে যেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু মায়ের ধমক খেয়ে সে ইচ্ছের গুড়ে বালি না, একেবারে হিমালয় পাহাড় পড়ল। শুধু একবার পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, “আচ্ছা পর্ণাদি কি নাকি সুরে কথা বলছে গো?” তিনি হেসে বললেন, “কই না তো!” আমার একটু কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল। ভূতেরা তো জানি নাকে নাকে কথা বলে, এ কেমন ভূত! এসব ক্ষেত্রে যা হয় অনেক পরামর্শদাতা জুটে যায়। সে পরামর্শ অনুসারে ওঝা এল। পর্ণাদিকে দেখে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, খুব খারাপ ধরণের পেত্নি চেপেছে। পর্ণাদি থুড়ি ওর কাকিমা তীব্র প্রতিবাদ করে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আমি ওর কাকিমা। আমাকে খারাপ বলবি না!” ওঝা জিজ্ঞেস করল, “ওকে ধরেছিস কেন?” সে বলল, “ওর বিয়েতে নিমন্ত্রণ খাব।” ওঝা আবার বলল, “তুই আর ইহলোকে নেই। বিয়েতে নিমন্ত্রণ খাবি কী করে? মেয়েটাকে ছাড়!” ভূতনি বলে, “আমার অনেক আশা ছিল ওর বিয়েতে আসব, ওর বিয়ে না দেখে আমি কিছুতেই যাব না।” “তুই যাবি না? আচ্ছা দাঁড়া, তোর ব্যবস্থা করছি!” পেত্নি তাড়ানোর সব বন্দোবস্ত হল। সেসব দেখে পর্ণাদির কাকিমা দুচার বার দাঁত মুখ খিঁচোলেও কিছুক্ষণ পর চুপ করে বসে পড়ল। আমরা ছোট বেলায় গল্প শুনেছিলাম, ওঝা মন্ত্রপড়া সর্ষে ছুঁড়ে মারে, ভূতনি তিড়িং বিড়িং লাফায়, তাও ছাড়ে না, তাও ছাড়ে না। শেষে ঝ্যাঁটার বাড়ি পড়ে পটাপট করে। তখন ‘যাঁচ্ছি যাঁচ্ছি’ বলে চেঁচাতে থাকে। ওঝা বলে, “কী করে বুঝব তুই চলে গেলি?” তখন ভূত বা ভূতনি বলে, “আমি একটা জলভরা ঘড়া দাঁতে তুলে নিয়ে ঐ গাছটা পর্যন্ত যাব।” হাত দিয়ে কোনও গাছ দেখায় অথবা মুখে সেই গাছের নাম বলে। যেমন, বট গাছ, নারকেল গাছ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে অবশ্য সেসব কিছুই হল না, দুচার বার সর্ষে ছুঁড়ে, এক আধটা ঝ্যাঁটার বাড়ি মারতেই, কাকিমা ছেড়ে যেতে রাজি হয়ে গেল। বেশি মারধর বিয়ের হবু কনের পক্ষে সহ্য করা সহজ ছিল না। বিশেষ করে সবাই যখন বলল, “দুদিন পরে যার বিয়ে তাকে বেশি মারধর করা ঠিক না!” এবার ওঝা যখন প্রশ্ন করল, “কী করে বুঝব তুই গেলি ? প্রমাণ কী তোর যাবার?” সে বলল, “ওর বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের নখটা একটু ভেঙে যাবে।” বলা বাহুল্য পায়ের নখ একটু ভেঙেও গিয়েছিল। এর বেশি কিছু হয় নি। পর্ণাদি তারপর কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। মুখে চোখে ভালো করে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হয়েছিল। এসবই শুনেছিলাম, পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে। এই ভূতে পাওয়ার কারণে অবশ্য বিয়েতে কোনও সমস্যা হয়নি। ছেলেপক্ষ কোনও সমস্যাই করেনি। আসল ঘটনা কানাঘুষো থেকে জানা গিয়েছিল, বিয়ের বেশ কিছুদিন পর। পর্ণাদিকে ভূতে ধরার জন্য বেশি দোষ ছিল ওর প্রেমিক সঞ্জয়ের। সে তখনও বেকার, তাই বিয়েটা করা সম্ভব ছিল না। আর পর্ণাদির বিধবা মা ভালো ছেলে পেয়ে, তাকে হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না। সেদিন সন্ধ্যার সময় সঞ্জয়ের সঙ্গেই দেখা করতে ছুটে গিয়েছিল পর্ণাদি। দুজন মিলে হয়ত শলাপরামর্শ করে এই পন্থা বেছে নিয়েছিল, যদি কোনোমতে বিয়েটা আটকানো যায়! বেচারা! ভূতে পাওয়ার আর একটা ঘটনা:- স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল ক্লাস সেভেনে পড়া যমুনা। সেভেনের তুলনায় একটু বেশিই বড়। সব ক্লাসেই দুএকবার করে হোঁচট খেয়েছে। রেললাইনের পাশ দিয়ে ফিরতে হত নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েটাকে। তার ঘাড়ে চাপল এক বুড়ি। সে বুড়ি আবার যে সে বুড়ি নয়, রতনের ঠাকুমা। রতন আর যমুনার সম্পর্কের কথা কেই বা না জানত! সমস্যা হল রতনের বাবা মা কিছুতেই যমুনাকে মানছিল না। রতনের অত সাহস ছিল না, বাবা মার সঙ্গে লড়াই করার। শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যাওয়া, রতনের ঠাকুমা সুরুৎ করে ফিরে এসে যমুনার ঘাড়ে চেপে বসল। আর চেপেই ওমনি নিজের ছেলে আর ছেলের বৌয়ের নামে, তোড়ে গাল পাড়তে আরম্ভ করল। ঘটনা দেখে তো সবার চক্ষু চড়কগাছ। সবাই বলল, "যে যমুনা ইস্কুলে গেছিল, সেই যমুনা বাড়ি ফেরেনি কো।" চুল খোলা, গোল্লা গোল্লা চোখ পাকাচ্ছে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই সমানে গাল দিচ্ছে। কারও কথা শুনছে না। কেউ সামনে গেলেই তাকে খিমচে দিচ্ছে। যমুনার মা-বাবা ভাই-বোন সবাই ভয়ে জড়সড়। যমুনা শুধু মোটা স্বরে বলে, “রতনের বাপ-মা রে ডাক!” এখানেও ওঝা এল। রতনের বাপ মা এল। যমুনা মানে রতনের ঠাকুমা বুড়ি তখন বলে কিনা, “এই যমুনিরে আমার বড় পছন্দ। আমি চাই ওই আমার রতনার বৌ হোক। শুনলি তোরা? আমার ব্যাটা আর ব্যাটার বৌ শোন, তোরা বিয়েতে মত দিলে, তবে আমি বিদেয় হব।” রতনের দজ্জাল মা টা যমুনার চেহারা দেখে কেমন যেন চুপসে গেল। বুড়ি তাকে আবারও কয়েকটা অশ্রাব্য গাল দিয়ে বলল, “শুনিছিস আবাগীর বেটি, আমি চাই যমুনির সঙ্গে আমার রতনার বিয়ে দে, তুই ওরে ঘরের বৌ করি নে। রতনা আমার বড় আদরের লাতি।” শেষ পর্যন্ত রতনের মা আমতা আমতা করে বলল, “ঠিক আছে, এই মেয়েরেই আমি ব্যাটার বৌ করবানি মা। আপনে এখন ওরে ছেড়ি দ্যান।” বুড়ি তবু নাছোড়বাঁধা। বলে, “মোর ব্যাটা বলে নাই কো এখনও।” রতনের বাবাও বলল, “আমি কবে যমুনারে অপছন্দ করিছি? আমার কোনো অমত নাই ” তবু বুড়ি ছাড়ে না। দাঁত খিঁচায়, মুখ ভ্যাঙচায়। তখন ওঝা এগিয়ে এসে কয়েক ঘা দমাদ্দম ঝ্যাঁটার বাড়ি দিল। এবার যমুনা নির্জীব হয়ে পড়ল। বোঝা গেল, বুড়ি ছেড়ে গেল। প্রমাণ হিসেবে সামনে রাখা এক বাটি জল উল্টে ফেলে দিল। এর কিছুদিন পর যমুনার সঙ্গে রতনের বিয়ে হয়ে গেল। মারের ব্যথাটা বোধহয় যমুনার তখনও ছিল।