“ভয় তার পশ্চিমে, ভয় তার পূর্বে ; যে দিকে তাকায় ভয় সাথে সাথে ঘুরবে।.........ভয় তার বাহিরেতে, ভয় তার অন্তরে; ভয় তার ভূত-প্রেতে, ভয় তার মন্তরে...” ভয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামুদা থাকত ৩২ নম্বর ঘরে। ওর ঘরের দরজায় একটা নোটিস ঝুলত, ‘রণে বনে জঙ্গলে কলেজে হস্টেলে, যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিবে। আশীর্বাদান্তে, শ্রীযুক্ত রামু গড়াই,’ সঙ্গে রামুদার পাসপোর্ট সাইজ ছবির একটা জেরক্স করা কপি, ক্লাস নাইনের ইতিহাস বইয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদদের ছাপাচিত্রের মতো আবছা ধরণের! আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের রামমোহন হল আর কলেজ স্ট্রিটের হিন্দু হস্টেল তখন কলকাতার র্যাগিং হাব। হস্টেলে ঢুকেই টানা র্যাগিংয়ে মুখে পড়ে আমি তখন বিপর্যস্ত। অগত্যা এক মাঝরাতে সংগোপনে আমি রামুদার থানে হত্যে দিলাম। ‘বাবা মহাদেবের ছিলিমে সেবা লাগে,’ বলে রামুদা টেরাকোটার ফুলদানির মতো দেখতে গাঁজার কল্কেতে প্রাণপণে টান দিল। ধোঁয়া ঢুকল, কিন্তু বেরল না। রামুদার হৃদপদ্মে সব ধোঁয়া হাওয়া! এবার অর্ধনিমীলিত চোখে আমার মাথায় হাত রেখে রামুদা বলল, ‘বেটা, যো ডর গয়্যা, ওহ মর গয়্যা! ভয় কী রে পাগল, আমি তো আছি!’আমি ‘র্যাগিংয়ে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, র্যাগিংয়ে আমি না যেন করি ভয়’ বীজমন্ত্র জপতে জপতে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখন ক্রমে আলো ফুটছে। নব দিনমণির মতো আমারও সেই রাঙাপ্রভাতে নবজন্ম হল। লিখতে ভুলে গেছি, সেদিনের সেই দীক্ষান্ত ভাষণে রামুদা বলেছিল, ‘বেটা, এক বাত ইয়াদ রাখো, মেয়েরা কিন্তু সাহসী ছেলে বহুত পসন্দ করে!’ সেদিনই ভেবে রেখেছিলাম, পরীক্ষা প্রার্থনীয়। আর বলব কী, এক বছরের মধ্যে হাতেনাতে ফল। পড়বি তো পড়, কলেজে ‘নূপুর’ বাজল। হিস্ট্রি, ফার্স্ট ইয়ার। নন্দলালের ক্যানভাসের মতো ছাপাশাড়ি, কুরচি ফুলের মতো মণিখচিত গয়না, টানা টানা দুই চোখ, কপালে একটা কালো টিপ, আর মুখে শ্যামলিমা হাসি। ব্যাস, ছেলেরা সব ক্যাবলা হয়ে গেল। পাড়ায় ছোড়দার পোষা মাস্তানগুলো পর্যন্ত কথা বলা তো দূরের ব্যাপার, নূপুরের দিকে মুখ তুলে তাকানোর সাহস পায় না। কাজেই শীর্ষবাছাই হিসেবে আমার ডাক পড়ল। নূপুরের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ‘এক কাপ চা, দু’টো সিঙ্গারা, আর একটা চারমিনার বাজি!’এক রোদ জ্বলা দুপুরে, নূপুর তখন ক্যান্টিনের উন্মুক্ত বাতায়নের প্রান্তে উপবিষ্টা এবং অসংখ্য সখী পরিবেষ্টিতা। ‘কলেজ আইডল’-এর রিয়েলটি শো দেখতে ক্যান্টিনে লোকারণ্য। আমি সটান নূপুরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই, তোমার নাম কী?’ নূপুর মম পানে কড়া চোখে তাকিয়ে আমাকেই বলল, ‘ইডিয়ট’! বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে আমি বললাম, ‘ওটা তো তোমার ডাকনাম, ভালনামটা বলো!’পত্রপাঠ নূপুরের আরক্ত মুখাবয়ব, আনত মস্তক। পারলে নূপুর তখন ঘোমটায় মুখ ঢাকে আর কী! আমিই তখন উপযাচক হয়ে বললাম, ‘আজ থাক, পরে কথা হবে!’বলেই নূপুরের পাশের বেঞ্চে বাজিতে উপার্জিত সামগ্রী নিয়ে বসলাম। নূপুর পরম মমতায় ‘এই বেঞ্চেই বসতে পারো’ বলে আমাকে কাছে ডেকে নিল। ওই একটা ‘সুর তুলে নূপুরে’ দুপুর আমার কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিল। এরপর আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ময়দানের দলবদলের মতো আমার সামনে একের পর এক অফার আসতে শুরু করল। কাজেই আমার ওই ‘খেজুর পাতায় নূপুর বাজে’ জীবন বেশিদিন টেকেনি। নূপুরও সময় ন্যস্ত না করে আউটসোরসিং করলো, পাশের কলেজের একটা ছেলেকে সে ‘বাউন্সার’ হিসেবে বেছে নিল। আমার তখন ‘সিজন টু’ হাজির। তবে আমার ওই নূপুর এপিসোড আমাদের হস্টেলের ‘পদু চ্যাট’-এর মনের গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার পোশাকি নাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, তাত্ত্বিক নেতা। ছোকরা এত ভিতু ছিল যে, ছোড়দার মাস্তানদের প্যাঁদানির ভয়ে সে মিটিং মিছিলে যেত না। তার খুব সখ ছিল সুস্মিতার সাথে প্রেম করবে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। পদু প্রতিদিন কলেজের সামনে একটা মোটা ইংরেজি বই হাতে নিয়ে শ্যামবাজারের নেতাজির স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত, সুস্মিতা ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। আর পদুর দিকে সুস্মিতা এমনভাবে তাকাত যে, কিছু বলেছ কী মরেছ! কিন্তু আমার ওই নূপুরনিধন পালা দেখে পদুর বুকে সাহস উথলে উঠল। সে একদিন সুস্মিতাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলেই পিছন ফিরে দৌড় লাগাতে গেল। সুস্মিতা অমনি দুরন্ত রিফ্লেক্সে পদুর পিঠে গুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল। পদু এবার ‘কালিয়া’-এর জেলপালানো বচ্চনের মতো ঘুরে দাঁড়াল এবং বুক ফুলিয়ে, সুস্মিতার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার!’এ কথা শুনে সুস্মিতাটা কেমন যেন বদলে গেল। সেই কলেজ ভাঙা ভিড়ে, সর্বসমক্ষে সে পদুকে বলল, ‘কাল দেখা করো!’ পদু ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই’ আওড়াতে আওড়াতে হস্টেলে ফিরে আমাকে বলল, ‘চল, তোকে অনাদির মোগলাই খাওয়াই।’ও রামুদাকেও নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পদুকে রামুদা বললো, ‘বিকেলটায় আমি গাঁজা খাই রে। তোরা ঘুরে আয়, রাতে বরং তুই আমাদের গোলবাড়ির কষা মাংস খাওয়াস!’প্রেম কাকে রাজা করেছে জানি না, তবে প্রেম পদুকে একদিনে ভিখিরি করে দিল! কথিত আছে, ভয়ের মতো সাহসও নাকি সংক্রামক! আমাদের হস্টেলের বিপরীতে রাস্তা পেরোলেই আমহার্স্ট থানার পুলিস কোয়ার্টারস। তার তিনতলায় থাকতো তিন্নি, ক্লাস ইলেভেন, ব্রাহ্ম গার্লস। সে আবার কেন কে জানে এতগুলো ঘর থাকতে, বেছে বেছে রাস্তার ধারের ঘরটায় জানলা খুলে পড়তে বসত। এদিকে আমাদের হস্টেলের অতলান্তও থাকত তিন তলায়। সে ওই মোক্ষম সময়ে জানলা খুলে দূরবীন লাগিয়ে তিন্নির ‘পড়াশোনার দিকে নজর’ রাখত। কেসটা এমনিতেই ‘হব হব’ ছিল, কিন্তু তবু অতলান্তের মনে অজানা আশঙ্কা। শত হোক, পুলিসের মেয়ে তো। পুলিসে ছুঁলেই যে আঠারো ঘা। আর পুলিসের মেয়েকে পটাতে গিয়ে ধরা পড়লে অনার কিলিং নিশ্চিত! অগত্যা ওই দূরবীন! তা একদিন বিকেলে ডিসিপ্লিনারি রাউন্ডে বেরিয়ে রামুদা বমাল ধরে ফেললো অতলান্তকে। রামুদা জিজ্ঞেস করল, “কী কেস?” অতলান্ত বলল, “দাদা, সভয়ে বলব না নির্ভয়ে বলব?” রামুদা বলল, “আরে এটা রামু গড়াই রে, বরাভয়ে বল!” অতলান্ত তোতলাতে তোতলাতে বলল, “দাদা, প্রেম না পুলিস?” রামুদা র্যাপিড ফায়ারের মতো নিদান দিল, ‘প্রেম, তবে শোন খোকা, প্রেমে তো আনটাচেবিলিটি চলে না। মনে রাখবি, মেয়েদের সাথে প্রেমটা টাচস্ক্রিন, হাত দিয়ে ছুঁতে হবে! সো, নো দূরবীন!’ কথাটা অতলান্তের মনে ধরল। পরদিন সন্ধ্যা নামার মুখে সে দূরবীনে দেখতে পেলো, তিন্নির মা বেরিয়ে গেল শনিমন্দিরে পুজো দিতে। বাবা তো থানায়, সন্ধ্যাবেলায় নাকি পুলিসের কাজ বেড়ে যায়। হেন কালে অতলান্তিক অভিসার শুরু হল। তিন্নিদের কোয়ার্টার্সের সামনে একটা ঝাঁকড়া পেয়ারা গাছ ছিল, সেটা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়েছিল একেবারে ওদের তিনতলার জানলা পর্যন্ত। তিন্নির সঙ্গে পেয়ার করতে অতলান্ত ওই পেয়ারা গাছ বেয়ে ওপরে উঠে জানলা দিয়ে তিন্নিদের ঘরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিন্নি তো ‘ভূ-ভূ-উ-উ-ত-ত’ বলে চেঁচিয়ে উঠে প্রায় মূর্ছা গেল। ঠিক তখনই অতলান্ত ‘ডর’-এর শাহরুখের স্টাইলে বলল, ‘আই লাভ ইউ, তি-তি-ন-ন-নি-নি!’তারপর সে রামুদার সেই টাচস্ক্রিন থিওরি প্রয়োগ করল। কীভাবে, সেটা লিখলে সেন্সর বোর্ড রাগ করবে। সে যাকগে, সেদিনের সান্ধ্য অধিবেশনের শেষে তিন্নি নাকি অতলান্তর কাছে সবিস্ময়ে জানতে চেয়েছিল, “অতু, তোমার ভয় করলো না একটুও!” অতলান্ত নিজের জামার কলারে একটা টোকা মেরে বলেছিল, “রাস্তায় পড়ে থাকা দড়িকে সাপ ভাবলে প্রেম করা যায় না, বুঝলে!” শুনেছি, অতলান্তকে এই কথাটা বলেছিলেন ওদের ফুটবল টিমের স্পেশ্যাল কোচ সুরজিত সেনগুপ্ত। তিন্নির অতু তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল টিমের লেফট উইঙ্গার! ময়দানের কথা যখন চলেই এল, তখন সেই ক্রিকেট ম্যাচটার কথা লেখা যাক। মাদ্রাজের চিপক স্টেডিয়ামে ভারত বনাম ইংল্যান্ডের পঞ্চম ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ, ১৯৫২। ম্যাচটা ভারত জিতেছিল এক ইনিংস ও আট রানে। ওটাই ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম জয় এবং তারই সুবাদে সেই সিরিজ অমীমাংসিত। মনে রাখতে হবে, তখন ইংল্যান্ডের ওই দলে ছিলেন ‘বিশ্বত্রাস’ ফাস্ট বোলার ফ্রেডরিক ট্রুম্যান, ক্রিকেট তাঁর নাম দিয়েছিল ‘ফায়ারি ফ্রেড!’ আগুনের গোলার মতো ছিল তাঁর প্রতিটি ডেলিভারি। ব্যাটসম্যানকে রক্তাক্ত না দেখলে তাঁর রাতে ঘুম হত না। আর সেই সময়ের আচ্ছা আচ্ছা ব্যাটসম্যানের রাতের ঘুম চলে যেত ট্রুম্যানের বিরুদ্ধে ব্যাট করার কথা ভাবলে। তা ওই ম্যাচটা ভারত জিতেছিল মূলত যাঁদের কৃতিত্বে, তাঁদের অন্যতম হলেন এক সাহসী বাঙালি ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়, মাঠে তাঁকে সবাই জানত ‘রে’ নামে। ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে উনি ১১১ রান করেছিলেন। সেদিন রে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন রীতিমতো ক্ষতবিক্ষত শরীরে। ফায়ারি ট্রুম্যানের লাল বলের বিষ ছোবলে সারা গায়ে তখন তাঁর কালশিটে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ক্রিকেট সাহিত্যে পড়েছিলাম, ওই ম্যাচের অনেকদিন বাদে অসমের ক্রিকেটার তথা তৎকালীন প্রখ্যাত ক্রিকেট সাংবাদিক পুলিন দাস এক সাক্ষাৎকারে জানতে চেয়েছিলেন, “রে, সেদিন তুমি ট্রুম্যানের ওই ভয়ঙ্কর বুলেটগুলো সামলাচ্ছিলে কী করে?” পঙ্কজ বলেছিলেন, “প্রতিটা বল খেলার পর, নতুন করে স্টান্স নেওয়ার সময় আমি নিজেকে ক্রমাগত বলছিলাম, রে, কনসেনট্রেট! রে, কনসেনট্রেট!” সেদিন পঙ্কজের ব্যাটিং পার্টনার পলি উমরিগর অপরাজিত ছিলেন ১৩০ রানে। তাই পুলিনের পরের প্রশ্ন ছিল, “রে, তুমি সেদিন বারবার অন্য প্রান্তে গিয়ে পলিকে কী বলছিলে?” রে জবাব দিয়েছিলেন, “বলছিলাম, পলি, খেলোয়াড়দের ভয় পেতে নেই!” আসলে ভয় পেলে তো লড়াই করা চলে না। সেই যে পিট সিগারের গণ আন্দোলনের গান আছে, “উই আর নট অ্যাফ্রেড, উই আর নট অ্যাফ্রেড, উই আর নট অ্যাফ্রেড, কমরেড!” মাঠের বাইরের আরও একটা লড়াইয়ের গল্প লিখে শেষ করি। বাস্তিলের দুর্গ ঘিরে ফেলেছে ফ্রান্সের জনগণ। গবাক্ষে উঁকি দিয়ে তা দেখে সম্রাট ষোড়শ লুই তাঁর প্রধান প্রহরীর কাছে জানতে চাইলেন, “এ সব কী হচ্ছে বলো তো! ওই সব বিদ্রোহ টিদ্রোহ নাকি?” রক্ষীকুল জবাব দিল, “না সম্রাট, ওটা বিপ্লব!” ভয়ার্ত রাজাধিরাজ বললেন, “সে কি, ওদের কোনও ভয়ডর নেই?” লাল চোখের রাজামশাইকে একবারও কুর্নিশ না করে, একবারও তাঁকে ‘সম্রাট’ সম্বোধন না করে, প্রহরীরা সমবেত স্বরে বললেন, “বিপ্লবীরা ভয় পায় না!” আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না যে, ভয়ও আসলে নির্ভয়ে থাকতে চায়! ‘মাগো, আমার মা— ঝড় নেমেছে দুয়ারে তার ঝঞ্ঝা লাগো-লাগো তুমি আমার বাজনা শুনে শঙ্কা মেনো না। বাজনা বাজুক, ভয় পেয়ো না, বাজনা বাজুক মা!’
4 Responses
খুব ভালো লেখা হয়েছে। এক টানে পড়লাম।
Hillaroius.
শেষ টা একদম অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল লেখাটাকে।
অসাধারণ লিখেছেন! মোহিত হলাম