লীলা মজুমদারের ‘সব ভুতুড়ে’: একটি অসমাপ্ত প্রতিবেদন

বিজয় মুখার্জি লেন, কলকাতা

‘অভিব্যক্তি নিউ জার্সি’ পত্রিকার আসন্ন বর্ষা সংখ্যার বিষয়টি বেশ অভিনব -- "ভয় ছাড়া ভূত।" প্রচলিত ধারণায় এমন বিষয় কিছুটা স্ববিরোধী বলে মনে  হলেও, লীলা মজুমদারের হাত ধরে আমরা পৌঁছে যেতে পারি সেই ভয় ছাড়া ভূতেদের রাজ্যে।   
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় লীলা মজুমদারের একটি ভূতের গল্পের সংকলন –‘সব ভুতুড়ে।’ বহু বছর ধরে নানা পত্রিকায় লীলা মজুমদারের লেখা ভূতের গল্পগুলিকে একত্রিত করে প্রকাশিত হল এই গ্রন্থ। মোট ৪২টি ভূতের গল্প আছে এখানে। কিন্তু দৈহিক বর্ণনায় বা আচার-আচরণে এরা প্রায় কেউই ভয় উদ্রেককারী নয়। প্রচলিত ধারণায় ভাটার মতো গোল গোল আগুন জ্বলা চোখ, মুলোর মত দাঁত ইত্যাদি প্রভৃতি যে সব ভয়ংকর হাড় হিম করা বর্ণনা অথবা ঘাড় মটকে দেওয়া ,শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নেওয়া, যে কোনো সময় ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়া ইত্যাদি -ভূতেদের যেসব কর্মপ্রণালীর সঙ্গে আমরা সাধারণভাবে পরিচিত , তার কোনো কিছুই কিন্তু "সব ভুতুড়ে" গল্প গ্রন্থে নেই। তাহলে কি এই গ্রন্থে ভূত নেই? অবশ্যই আছে। ৪২ টি গল্পে অন্তত অর্ধশতাধিক ভূতের দেখা পাই আমরা। কিন্তু তারা কেউ আমাদের অর্থাৎ আশেপাশের মানুষদের কোন ক্ষতি করে না, বরং প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। লীলা মজুমদার এই গ্রন্থের ভূমিকায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। মরে গেলে মানুষের শরীরের একটি কণাও যদি নষ্ট না হয়ব, সবই যদি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়, তবে মানুষের শরীরের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ যে আত্মা তাই বা নষ্ট হবে কেন? তার থেকেও বড় প্রশ্ন তার একটা অশুভ পরিণতিই বা হবে কেন? কথাটা সত্যি ভেবে দেখার মতো। 
লীলা মজুমদারের সৃষ্ট ভূতেরা তাই অন্যরকম। সাধারণ আর পাঁচটা মানুষের মতোই তাদের চেহারা। অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে তাদের যে রূপ ছিল মৃত্যুর পরেও সেই রূপই বজায় থাকে,কোন বদল হয় না। অন্য এক লোকের বাসিন্দা হয়েও তারা পূর্বজীবনের চেহারা নিয়ে ইহলোকেই যেন থেকে যায়। অনেক  সময়ই  তারা কোন না কোন ভাবে চারপাশের মানুষজনের ভালো করার চেষ্ট করে । অন্তত ক্ষতি তো প্রায় কখনোই করে না। আর তাই তাদের দেখে ভয় পাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। বরং অনেক সময়ই একটা মিষ্টি মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভূতের সঙ্গে মানুষের। পরে যখন জানা যায় প্রকৃত সত্য তখন একটু ভয় ভয় করে ওঠে বইকি কিন্তু তাকে কি আর "ভূতের ভয়" বলা যায়?
খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্বল্প পরিসরে সব গল্পগুলি নিয়ে আলোচনার অবকাশ আমাদের নেই তবু অন্তত দু'চারটে গল্প অবলম্বনে আমরা দেখি নিতে পারি ভয় ছাড়া ভূতেদের বিবিধ কান্ডকারখানা।

‘অহিদিদির বন্ধুরা’ গল্পে স্বামী অবসর নেওয়ার পর অহিদিদিরা শহর থেকে বেশ ভেতর দিকে অজপাড়াগাঁয়ে একটি বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানে রান্নাঘরে মাঝে মাঝে উৎপাতের চিহ্ন দেখতেন অহিদিদি। দুধের সর ছিঁড়ে নেওয়ার বা সিকের উপর তুলে রাখা খয়রা মাছ খেয়ে ফেলার স্পষ্ট চিহ্ন। এরপর অহিদিদি ৮/১০টি বাচ্চা ছেলে মেয়েকে আবিষ্কার করলেন। রোগা রোগা চেহারা, গায়ে জামা নেই। রুক্ষ চুল। অহিদিদির সঙ্গে তাদের খুব ভাব হয়ে গেল। অহিদিদি তাদের নানা খাবার দিতেন। সন্তান স্নেহে ভালোবাসতেন। তাদের নানারকম গল্প শোনাতেন। এমনকী পৌষ সংক্রান্তিতে তাদের পেট ভরে পাটিসাপটা, গোকুল পিঠে, দুধপুলি ,নারকেল নাড়ু সব কিছু খাইয়েছিলেন। 
সংক্রান্তির পরেই নানা কারণে বাড়ি  বদল করেছিলেন অহিদিদিরা । নতুন বাড়িতে যেতেও বলেছিলেন তাঁর সেই অসমবয়সী বন্ধুদের। কিন্তু তারা সেখানে যায়নি । বস্তুত পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠে খাওয়ার পরে আর তারা আসেনি। বাড়ি বদলের দিনও তাদের খুঁজে পান না অহিদিদি। কিছুদিন পরে গয়লা বৌ এর কাছ থেকে অহিদিদি জানতে পারেন এক আশ্চর্য নিষ্ঠুর সত্য। বহুদিন আগে, প্রায় ২০০  বছর আগে গয়লাদের বাড়ির এই ছেলেমেয়েগুলো পৌষ পার্বণের  পিঠে খেতে এসে আনন্দে হইচই করেছিল বলে অহিদিদিদের থাকা ওই বাড়ির তখনকার মালিক এক ধনী সওদাগর তাদের মধ্যে নয়জনের জিভ কেটে নিয়েছিল শুধুমাত্র হইচই করার অপরাধে।। সবচেয়ে বড় ছেলেটি পালিয়ে যেতে পেরেছিল বলে তার জিভ কাটতে পারেনি। তাই শুধু বগেশ কথা বলতো অহিদিদির সঙ্গে। জিভকাটা বলে বাকিরা লজ্জায় কথা বলে না এমন কথাও জানিয়েছিল অহিদিদিকে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি বুঝতে পারেননি এর অর্থ। 
সেই থেকে ওখানে আমবাগানে গাছে বোল হয় না।  আর এই  ছেলেমেয়েগুলো যেন এত দীর্ঘদিন ধরে আটকে ছিল একটু স্নেহস্পর্শের জন্য। যে পিঠে খাওয়ার জন্য তাদের এই চরম পরিণতি ঘটেছিল, অহিদিদির হাতে ভালবাসায় আদরে যত্নে সেই পিঠে খেয়ে তাদেরও যেন মুক্তি ঘটল। তাদের অপূর্ণ সাধ পূরণ হলো। আর সেই অঞ্চলটাও যেন অভিশাপমুক্ত হল। আমের গাছে আবার নতুন করে বোল এল।  
এই গল্পে "ভূতেদের" ভয় পাওয়ার অবকাশ কোথায়? বরং এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি স্নেহ মায়া মমতায় ভালোবাসায় অহিদিদির মতই  উদ্বেল হয়ে উঠি আমরা। কিন্তু শুধু স্নেহ ভালোবাসা নয়,ধনি সওদাগর ও দরিদ্র গয়লা বাড়ির ছেলে মেয়েদের মধ্যে যে শ্রেণীবৈষম্যের ইঙ্গিত রাখেন লেখক তাতে নিছক ভূতের ভয়ের কথা ছাড়িয়ে অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে যায় এ গল্প। 

পেনেটিতে" গল্পে গঙ্গার ধারে মামার বাড়িতে থাকতে এসে গল্পকথক কিশোরটির বন্ধু হয়ে উঠেছিল জেলে মাঝি বুড়ো শিবু আর তার দুই ভাইপো সিজি আর গুজি। মামা রাতে দেরি করে ফিরলে ভূতের ভয় পাওয়া এই কিশোরটিকে ভরসা  দিতে এই তিনজন জলের পাইপ বেয়ে বারান্দায় উঠে নানা গল্প করে তার ভয় ভাঙিয়ে দিত। এরাই আবার গল্পকথক এর স্কুলের তিন সহপাঠীকে শিক্ষা দিতে গায়ে সাদা চাদর দিয়ে ভূতের ভয় দেখিয়ে তাদের শায়েস্তা করে। কিন্তু তারপর দেখা যায় শুধু সাদা চাদর  পড়ে আছে আর ওই তিনজন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এ গল্পে  ভয় যে একেবারে নেই তা নয়, গল্পের শেষে ভয়ের একটা অনুভূতি নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু ভূতের ভয়কে ছাড়িয়ে এখানে ভূতের বন্ধুত্ব জয়ী হয়।
"আহিরীটোলার বাড়ি" গল্পে গল্পকথক প্রি - টেস্টে অংকে ১৫ পেয়ে বাড়িতে তিরস্কৃত হয়ে তার বাবার ঠাকুরদার তৈরি মস্ত পুরনো বাড়িতে রাত কাটাতে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে পোড়া বাড়ির বদলে  দেখে  সাজানো গোছানো এক বনেদি বাড়ির অন্দরমহল। ঠাকুরদা শিবেন্দ্রনারায়ন এবং অন্যান্যরা গল্পকথক কে খুব আদর যত্ন করে। লোভনীয় সব খাবার খেতে দেয়। এমনকি অঙ্কের মাস্টার কুট্টিকে দিয়ে অংক শিখিয়ে তার অংকের ভয় কাটিয়ে দেয়।পরে সব জানার পর ছেলেটি বোঝে, সে আসলে অশরীরী দের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। তারা কেউ ইহলোকের বাসিন্দা নয়। কিন্তু ওইটুকুই। এই অনুভূতিটুকু ছাড়া আর কোন ভয় গল্পতে নেই। এমনকি কুট্টির কাছে অংক শিখে ছেলেটি বুঝতে পারে তার অঙ্কের ভীতি কেটে গেছে। পরবর্তী পরীক্ষায় ছেলেটি যে ভাল নাম্বার পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আক্ষরিক অর্থেই এটি একটি  "ভয় ছাড়া ভূতের গল্প"। 

"লাল টিনের ছাদের বাড়ি" গল্পে ভারত -বর্মা সীমান্তে ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে এক বাড়িতে পল্টু কাকা ও কর্নেল রতন সিংকে তাদের গুপ্তচর কুসুমকুমারী পরম সমাদরে আপ্যায়ন করেছিল। শুধু তাই নয় পরদিন শত্রু আক্রমণের পূর্বাভাস দিয়ে ভোরবেলা তাদের স্থান ছেড়ে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছিল। বাস্তবে তেমনটাই ঘটেছিল। পরদিন শত্রুর আক্রমণ হয়েছিল সেই স্থানে। আর তারও পরে জানা গিয়েছিল ওই বিশেষ রাতের অন্তত দশ দিন আগেই কুসুমকুমারীর মৃত্যু হয়েছে। জাগতিক জীবনের বাইরে চলে গিয়েও কুসুমকুমারী তার ডিউটি করে গেছে। 
আগেই বলেছি এইসব চরিত্রগুলি যে আদৌ রক্তমাংসের মানুষ নয়, তারা যে আত্মা - অশরীরী, এই অনুভূতির মধ্যে একটা ভয় অবশ্যই আছে কিন্তু তার বাইরে আর কোন ভয় নেই।  
এমন অজস্র মণিমুক্তা ছড়িয়ে রয়েছে লীলা মজুমদারের এই গ্রন্থে সর্বত্র। শুধু মানুষ নয়, হাতি (পিলখানা), কুকুর (তোজো) ইত্যাদি মনুষ্যেতর প্রাণীরাও মৃত্যুর ওপারে পৌঁছে মানুষের উপকার করেছে, তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাদের দেখে ভয় তো দূরস্থান বরং পরম বন্ধু বলে মনে হয়েছে।
এই গ্রন্থে ভূতেরা অনেক সময়ই দুঃখী মানুষকে সঙ্গ দিয়েছে, অপরাধীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, বিপদে পড়া মানুষকে সাহায্য করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভূতেরা  মানুষের সাহায্য নিয়ে তাদের কোন অপূর্ণ সাধ পূরণ করেছে। আসল কথা হল ভূতকে কোন  ক্ষতিকর পদার্থ বলে মনে করেননি  লীলা মজুমদার। মানুষের সত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ হলো তার আত্মা এবং সেই আত্মা অপরের ক্ষতি করবে না বলেই তাঁর বিশ্বাস। অজস্র এমন গল্প রয়েছে এই গ্রন্থে। এই বিষয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ লেখার অবকাশ রইল। কিন্তু এখন সে পরিসর নেই। অতএব অথ ভয়হীন ভূতকথা সমাপ্ত।

আকর গ্রন্থ--
মূল গ্রন্থ -- সব ভুতুড়ে -- লীলা মজুমদার।
আনন্দ। কলকাতা। প্রথম সংস্করণ জুন ১৯৮৩।
চর্তুদশ সংস্করণ মার্চ ২০১২।

বৈশাখী ২০২৪