সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু ঘুম এল না, এতটা শ্রমের পর একটি ঘুম দরকার ছিল, আর তা প্রাপ্যও ছিল তার; কাজগুলি তো ঠিক ঠিক হয়েছে, এখন একটা স্বস্তির ঘুম সে আশা করতেই পারে। কিন্তু কাজগুলিতে মিশে থাকা রোমাঞ্চই তাকে যেন ঘুমুতে দিল না। পরিকল্পণাগুলি ঠিক ঠিক কাজ করেছে। সে নিজেও আজ কয়েকটি জায়গায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য গিয়েছিল। মানুষের ভেতর সে দেখেছে প্রবল বিতৃষ্ণা! চোখে-মুখে আত্মশুদ্ধির এক প্রত্যয়। বৈশাখ মরছে! পরদিন সকালে সে খুশি হয়, চারদিক পবিত্র। সে রাস্তাটি দেখে জানালা খুলে, কেউ নেই, সুনসান। এই তো চেয়েছিল। হৃষ্ট চিত্ত তার, এমনি সময় একটা শব্দ কানে এল। দুই একটা ছেলে ভুভুজেলা নিয়ে বের হয়েছে। প্রথমে কিছুটা আঁতকে উঠলেও পরে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে উঠলো, এই রাস্তার ছেলেগুলোকে আর শুদ্ধ করা যাবে না! এরা কোনো দলেই যায় না, কোনো কিছু বোঝানোও দায় এদের, আজ এলেম দিলে সব শুনে নেবে, কিন্তু কালই আবার উচ্ছন্নদের দলে যাবে! হঠাৎ শব্দটা বড় হয়ে ওঠাতে, সে দৌড়ে জানালার ধারে যায়, দেখে আরো লোক আসছে, তার পেছনে আরো, পিল পিল করে তারা আসছে, স্রোতের মত, অগণিত লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি … এরা মিছিল করে কোথায় চলেছে? বটমূল? রমনা? এত কিছুর পরেও? তাহলে যে লাখে লাখে মাইক ব্যবহার করা হল? গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত চালানো হল অভিযান? আর ঐ যে, কোটি কোটি অনলাইন ভিডিও, সেগুলোই বা কী করতে পারল? রাগ চড়তে চড়তে উপচে পড়তে থাকে তার মাথা বেয়ে! কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পরে যেন হুঁশ ফিরে তার। নিজের মনকেই প্রবোধ দেয়! নাহ্, এরা আর কয়জন হবে? যারা বাইরে বেরোয়নি ঘরে রয়েছে, তারা শুধু বেশিই না সংখ্যায়, তারাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাহলে কেন সে ভয় পাচ্ছে শুধু শুধু! একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে! যত যাই হোক, প্রোগ্রাম সফল হয়েছে। দু’চারজন দূরাচার সব দেশে সব কালেই থাকে, এরা কখনোই শুদ্ধ হয় না! এদের তো আর গুনতিতে ধরলে চলে না! এইসব ভেবে মনকে প্রবোধ দিয়ে একটু নিশ্চিন্তমনে বসতে যাবে, এমন সময় প্রথম রিনরিনে একটা মৃদু স্বর ভেসে আসে, খুব চেনা সুর, ধরতে পারছিল না। কিন্তু তাকে ধরাতেই যেন কাছেই কেউ জোর গলায় গেয়ে উঠল “এসো হে বৈশাখ, এসো হে…” কোনখান থেকে এল? কীভাবে এল? জানালার বাইরে থেকে আসার কথা নয়, আওয়াজের যে ধারাপাত তা থেকে মনে হয়, ওপর থেকে; তাহলে দোতলা, মানে সোবহান সাহেবের বাসা থেকে। কিন্তু তিনিও তো গতকালের জমায়েতে শরিক হয়েছিলেন যেখানে এই বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছিল, সংকল্প করা হয়েছিল দ্বার বন্ধ করে রাখা হবে, বৈশাখের ছায়াকে পর্যন্ত ঢুকতে দেয়া হবে না। আবার ক্রোধটা গ্রাস করতে শুরু করে, রাগে ফুঁসতে থাকে, এই লোকগুলোকে কোন বিশ্বাস নেই! বহুরূপী! এই টাইপের লোকগুলা অবিশ্বাসীদের চেয়েও খারাপ! এদের কোন চরিত্র নাই! সব কিছুই নিজেদের মনোমত বদলে নেয়। রাগটা আস্তে আস্তে ঘেন্নায় বিবর্তিত হতে থাকে। হঠাৎ একটা চিন্তা তার মধ্যে শীতল স্রোত বইয়ে দেয়! আচ্ছা, তাহলে যারা বের হয়নি, তারা কি বাসাতেই বসে নববর্ষ পালন করছে? গানা-নাচা-সাজা-আমোদ-খানাপিনা চলছে? তবে এর জন্য তাদেরই দলভুক্ত কারো কারো অহেতুক পাকামির দায় আছে! কিছু লোক যখন ‘কোথায় আছে যে নববর্ষ করা যাবে না’ – এমন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, তখন তাদের মুখ বন্ধ করতেই এমন প্রচার করা হল যে, বৈশাখী করা যাবে, তবে তা ঘরের মধ্যে, ঘর থেকে বাইরে আসা মানেই তো শয়তানের ফুঁসমন্তরে ঢুকে যাওয়া! কিন্তু তারা এইটুকু ভেবে দেখলেন না যে, এই সুযোগে শয়তানের দল ভালো মানুষদের বাসাবাড়িগুলিকে নিজেদের করদরাজ্য বানিয়ে ফেলবে! এই যে এখন বাসায় বসে বৈশাখী করছে যে লোকগুলি, তাদের ঠেকাবেন কী করে তারা? ভাবতে ভাবতে ভীষণ মন খারাপ হয় তার। মনে হয়, সব প্রচেষ্টাই জলে গিয়েছে! হতাশায় মুষড়ে পড়তে থাকে একে একে তার চেতনার সব রন্ধ্র! অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে, এরই মধ্যে সে ভাবতে লাগল তার সব মেধাকে এক করে, কিন্তু তারপরেও যখন কোন উপায় বের করতে পারল না, তখন হাত তুলল উপরে মেঝের উপর পা দুটো সমান্তরলে মুড়ে রেখে! কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করল এক বিরাট ঝড়, সব পাপ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাক! সে তার সমস্ত মনকে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বাইরের শব্দ-শোরগোল তার মনসংযোগ ব্যাহত করছিল বারবার! এক সময় স্বাভাবিক সহ্য শক্তির বাইরে চলে গেল তারা, আওয়াজটা ক্রমেই বড় হচ্ছিল আয়তনে, গান-বাজনা-নৃত্য-মানুষ-রঙ সব কিছু তাকে অবশ করে দিচ্ছিল যেন। নিতান্তই বাধ্য হয়ে জানালাটা বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াল, কিন্তু হঠাৎ একটা দমকা বাতাস ছুটে আসতে দেখল জানালা বরাবর, জানালার কপাট বার কয়েক ধাক্কা খেল ইট-সিমেন্টের নিরেট দেয়ালে। লোকটি খুশিতে নেচে উঠল প্রায়, বার কয়েক উপরে চাইল, এই তো তার মনস্কামনা ফলেছে, ফলেছে! বেরিয়ে এল স্বগতোক্তিঃ ‘কী রে পাপিষ্ঠের দল, কর এবার বৈশাখী! আসছে ঝড় দিগন্ত কাঁপিয়ে!’ সে প্রথম কিছুটা সময় জানালাটা খুলেই রাখলো আমোদে, কিন্তু বায়ুর এই প্রবল ঘূর্ণি তার ঘরে আছড়ে পড়তে থাকলে এক সময় হন্তদন্ত হয়ে জানালাটা বন্ধ করে লাইট জ্বেলে দিল ঘরের। সে তার দিব্য চোখে দেখতে পেল অস্থায়ী দোকানগুলি ভেসে যাচ্ছে প্রবল জলের ঝাপটায়, মেলায় আসা মানুষগুলি ভিজে লেপটে চিড়ে চ্যাপ্টা! ধুলোর সাগরে তারা অন্ধের মত হাত বাড়িয়ে একে অন্যকে খুঁজছে! কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখল, আকাশও আরো নিকষ কালো হয়েছে, বাতাসের দাপট কিছুটা হলেও কমেছে যেন। হয়ত স্বাভাবিক হয়ে আসবে সব কিছু দ্রুতই – এরকম ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি উধাও হল। লোকটি রাতকানা ছিল, কয়েকটা মুহূর্ত সে কিছুই দেখতে পেল না, পরে চোখ খানিক ধাতস্থ হলে সে শশব্যস্ত হয়ে জানালাটা খুলে দিল একটুখানি আলো যদি পায় – এই আশা নিয়ে। ঝমঝমিয়ে ঝিম ধরানো বৃষ্টি এখন, ছেয়ে আছে সামনের পুরো পৃথিবী। সে তাকিয়ে ছিল অনিমেষ নয়নে, কিন্তু দেখছিল না কিছুই, তার তখন একটাই জিজ্ঞাসা - কখন বিদ্যুৎ আসবে, কখন জ্বলবে বাল্ব তার ঘরের, এলইডি লাইটটা আবার কেটে যায়নি তো? হঠাৎ একটি দৃশ্য তাকে তাতিয়ে দিল, লাল সাদা দেহের একটি অচেনা ও অভূতপূর্ব অঙ্গ-ভঙ্গি বৃষ্টির মধ্যে, ক্রমেই রেখাগুলি বাড়তে লাগল সংখ্যায় - অগুনতি, অসীম। তার মনে হল, এগিয়ে আসছে তারা তার দিকে! একটা সময় সেগুলো যেন এক একটি চুলের আকার ধারণ করল, আকাশের থুতনি থেকে তারা অযুত নিযুত সংখ্যায় বের হয়ে আসতে লাগল। জানলার ছিটকিনাটি বন্ধ করার পর সে যেন তড়িৎ আহত হল। জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে শোনা যাচ্ছিল বাজের কান ফাটানো আওয়াজ, ঝিলিক মারছিল আকাশের বুক জুড়ে অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ, ‘বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা!’ সে আর এক পাও নড়তে চড়তে পারছিল না। তাকে জাপটে ধরছিল কোন এক অদৃশ্য শক্তি, কোনো মতেই সেই বাঁধন ছড়িয়ে নিতে পারছিল না সে। সে অমন দাঁড়িয়ে রইল অনন্তকাল। ওদিকে আকাশের সমান বিশাল সেই ভূতটা নেচে চলেছে, তার মাথা ও থুতনি থেকে বেরিয়ে পড়া চুলের রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে পুরো পৃথিবীতে, ছেয়ে ফেলছে বিশ্বচরাচর …যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা জমিন, লাল পাড়, অগণন, অপরিমেয়, একটা বজ্র নিনাদ স্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে… “হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে দে রে …”
2 Responses
খুব সুন্দর। এমনই, এমনই আশা। আবার একই সময়ে ভাবি এই সম্যে এসেও আমাদের এইসবই ভাবতে হচ্ছে। কি উলটো ধারায় চলছি আমরা।
অসাধারণ লেখনী।