মেঠো জাহাজ

কলকাতা

সক্কাল সক্কাল হুঁকোবরদারের মুখেই প্রথম খবরটা শুনেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। নাহ্, লোকখানা ভালো। মানে খুবই ভালো। ওঁর চুরাশিজন চাকর বাকরের মধ্যে ওই একটি লোকই তবু কাজের। নইলে বাকিরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে! এদিকে কলকাতা শহর স্তব্ধ হয়ে এল, আর এদের কোনো হেলদোল নেই! 

চিন্তিত মুখেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আলবোলার পেচওয়ানখানা মুখের মধ্যে দিয়ে সুখটান দেবেন, তখনই হাত কচলে লোকটি বলে উঠেছিল, “আজ্ঞে কত্তা, আজ আপনার হবে!”
চমকে উঠেছিলেন তিনি। বলে কী লোকটা! হবে মানে কী হবে রে বাবা! একে তো নিজের দেশ ছেড়ে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে আছেন, মশার কামড়, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুর, বাজার সরকারের বাজারের চুরি সহ্য করছেন মুখটি বুজে, আবার এদিকে পালকি বেয়ারারাও সুযোগ বুঝে ধর্মঘট হেঁকে দিল, পুরো শহরখানা দেখতে দেখতে ঝিমিয়ে শ্মশান শ্মশান লাগছে, অফিসে লোক আসছে না, বিকেলে গড়ের মাঠের হাওয়া খেতে যাওয়া মাথায় উঠেছে, আর তারপরেও লোকটা বলে কিনা, হবে! আর হবার বাকীটা কী আছে? 

তবে ইংরেজ জাত তো, ভাঙবে তবু মচকাবে না। গলার স্বরখানা যথাসম্ভব শক্ত রেখেই তিনি বললেন, “বলি সকাল সকাল মশকরা পেয়েছ নাকি! না হয় ভালো তামাক বানাও!”
কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। ওদিক থেকে আওয়াজ এল, “আজ্ঞে শুধু ভালো বললেন কত্তা! প্রাণে বড় ব্যথা পেলাম! আচ্ছা থাক তাইলে!”

এই হয়েছে জ্বালা! মাইনে চারটাকা, তামাক বানায় দেড়শ টাকার, তার ওপর এমন ছেলেমানুষের মতন অভিমান! মাঝে মাঝে ওঁর ইচ্ছে হয় লোকটাকে ক্রীতদাস বলে চালান করে দেয় পারশিদের জাহাজে! বড় ঝামেলা করে!  
 
গুড়গুড় করে আরেকবার দশহাতি নলখানায় টান মেরে সেই ইচ্ছে আপাতত ধামাচাপা দিলেন। একটু সুর নরম করে বললেন, “আহা, ভালো কে বলেছে হে! তুমি তো হলে গিয়ে শিল্পী মানুষ! দেখো না, যখন এখান ছেড়ে পালাব, তোমায় এই ট্যাঁকে গুঁজে নিয়ে যাব বিলেত! ওখানে নইলে কে এমন হুঁকো সেজে দেবে বলো দিকি! তা কী যেন বলছিলে…”  

এবার বাবুর মন গলেছে। ভারী গোপন কোনো কথা বলছে এমন সুরে লোকটি বলে উঠল, “আজ সব আসবে আপনার কাছে কত্তা বিচারের জন্য!”
“অ্যাঁ! কে আসবে গো?”
“আরে ওই, বেয়ারাগুলো! দেবেন বন্দুক বের করে ধাঁই ধুঁই চালিয়ে! মামদোবাজি! সব ধর্মঘট ফুস হয়ে যাবে!”

বলে কী! মুহূর্তের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মাথায় খেলে গেল এই মুহূর্তে বাংলায় পালকি বেয়ারার সংখ্যা এগার হাজারেরও বেশি। তারা সবাই মিলে এসে সুপ্রিম কোর্টে একটা করে ঢিল ছুঁড়লেও তো কেস পুরো ম্যালেরিয়া!

ওদিকে হুঁকোবরদারের বোধহয় আজ কোনও দেবতার মানত আছে বেশি কথা বলার। সে বলেই চলেছে, “বেশ হয়েছে নগরপাল কত্তা বলেছেন ওই কী সব করাতে হবে! কী যেন বলে?”
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “লাইসেন্স।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই হল। লাছেঞ্চ করতে হবে, হাতে ওই ফিতে বাঁধতে হবে! কী যেন বলে কত্তা?”
“ব্যাজ।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই হল। বেজ, তারপর ঘন্টার হিসেবে ভাড়া! যাই বলুন কত্তা, নগরপাল কত্তা মানুষ নন, সাক্ষাৎ দেবতা! বেশ হয়েছে! আর একটাও তো এই বাংলার লোক নয় বলেন!”
 
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তখনও বুঝতে পারছিলেন না লোকটা হঠাৎ কেন ক্ষেপে গেছে। একটু মিউমিউ করে বলতে গেলেন, “আচ্ছা ওদের দিকটাও তো একটু ভাববে বলো! ব্যাজ পড়লে যদি সত্যি সত্যি ওদের জাত যায়!”
“রাখুন আপনি! ওদের আবার জাত বেজাত কী?” 
প্রায় হুংকার দিয়ে উঠেছে হুঁকোবরদার। আরেকটু হলে হাত থেকে নলখানা পড়ে যাচ্ছিল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের! 
“আরে সব তো উড়ে, আর একেকটা ডাকাত!”
“ডাকাত!” 
“তা নয়তো কী বলেন কত্তা! সেদিন বউ আর মেয়েকে নিয়ে চৌরঙ্গি পেরিয়ে বাগবাজারের দিকে যাব, শুনেছিলাম এক ভারী তান্ত্রিক এয়েছেন নাকি!
একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে নিল সে।  
“বলে কিনা চার আনা ভাড়া! ডাকাত নয়!”

এবার বুঝতে পেরেছেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রাগের কারণখানা। খবরটা অবশ্য তিনি আগেও অনেকের মুখে শুনেছেন। সত্যিই পালকি ছাড়া এই শহরে গতি নেই, আর পালকি বেয়ারাদের ভাড়া হাঁকারও কোনো মা বাপ নেই। কয়েকটা গল্প শুনে তো তিনি নিজেই মনে মনে ভেবেছিলেন গায়ের রংখানা একটু কালো হলে তিনি নিজেই…যা মাইনে পান, তার চেয়ে…সে যাগগে!
নিজের বেয়ারাগুলোর মুখখানা একবার মনে করলেন তিনি। বিগত কয়েকদিন ধরে তাদের টিকিটিরও দেখা মেলেনি। তবু একটু সহানুভূতির সুরে বলতে গেলেন, “আহা জান তো চৌরঙ্গির জঙ্গলে ডাকাত থাকে, তাদের প্রাণের ভয় নেই! তুমি বাবা খামোখাই বড় চটে যাচ্ছ!” 
আবার একটা হুংকার ছেড়ে লোকটি বলে উঠল, “আরে বাবা বলছি তান্ত্রিক ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে যাব! তা আপনিই বলেন কত্তা, ডাকাত যদি শোনে ধর্ম করতে যাচ্ছি তাও অনিষ্ট করতে আসবে? তার নিজের প্রাণে ভয় ডর নেই!” 

কথাটায় খুব একটা ভরসা করতে পারলেন না ম্যাজিস্ট্রেট। চৌরঙ্গির ডাকাত ধর্মপ্রাণ এমন কোনও খবর ওঁর কাছে নেই। 



“সেদিনই জানতাম আমি!”
“অ্যাঁ! কী জানতে হে?”
“আরে বাবা ওই যে ডাকাতি করে চার আনা চাইল, সেদিনই জানতাম এত অধর্ম সইবে না। সে যতই কলিকাল পড়ুক না কেন! তার পরেই তো নগরপাল কত্তা হুকুম দিলেন ওই লাছেন্স আর বেজ পরার। নে এবার নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে বেজ নে!”
ঠিক এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বেদম হাসি পেল। কী মেশায় তামাকে লোকটা কে জানে!
একবার মন দিয়ে দেখলেন তিনি তাঁর হুঁকোবরদারকে। উত্তেজনায় বেচারার চোখগুলো গুল্লি গুল্লি হয়ে গেছে। মাথার পাগড়িখানা দেখে মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে। আসলে লোকটা রাগে কাঁপছে। তাই পাগড়িও থরহরি কম্পমান। 
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, “তুমি কী খবর দেবে বললে, এটাই?”
“আরে আজ ওরা সব জড়ো হবে ময়দানে। আমার কাছে খবর আছে। তারপর সেখান থেকে আসবে সব আপনার কাছে। আপনি কিন্তু…”
“আমি আবার কী করলাম বাপু!”
“আরে সেটাই তো কত্তা, আপনার তো দয়ার প্রাণ! সে আমি আপনার গড়গড়া খাওয়া দেখেই বুইতে পারি। আপনি আবার ওই ডাকাতদের কান্নায় ভুলবেন না যেন। পষ্ট বলে দেবেন, চৌরঙ্গির জঙ্গলে গিয়ে চরে খে গে যা!” 

দেওয়ালে ঝোলান বড় ঘড়িখানার দিকে তাকালেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। এবার উঠতে হবে। সকালে প্রাতরাশ সারার পর একটু আলবোলায় টান দিলে চলে না আজকাল আর। আজ এই বকবকানির চোটে সেখানে খানিক দেরিই হয়ে গেছে। লোকটার বক্তব্য মোটামুটি বুঝে গেছেন তিনি। রাগের কারণও বেশ প্রাঞ্জল ভাষাতেই বুঝিয়ে দিয়েছে সে। 

আজ হবে একটা কিছু, ভালই বুঝতে পারছিলেন তিনি। তা হবে নাই বা কেন, কলকাতা শহরের প্রথম ধর্মঘট বলে কথা! সাল ১৮২৭। এদিকে নগরপাল সাহেব আবার একেবারেই সুর নরম করতে নারাজ। সে খবরও ভালোই জানেন তিনি। 
ধুর ধুর! ভালো লাগে না বাবা এই ঝামেলা! শেষ একবার ভুড়ুক ভুড়ুক করে টান মেরে উঠে পড়লেন তিনি। 

হুঁকোবরদারের খবর একেবারে ঘোড়ার মুখের খবর। বিলেত নিয়ে গিয়ে লোকটাকে দিয়ে হুঁকো বানাবেন না পরের বছর লন্ডনে নতুন যে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট হবে বলে খবর ভাসছে সেখানে চাকরি দেবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি। 

এদিকে হাজারে হাজারে পালকি বেয়ারারা ময়দানে তাদের মিটিং মিছিল আর কী কী করেছে ভগবান জানেন, যাই হোক অবশেষে এসে তারা এসে উপস্থিত লালবাজারে। ভিড়ের যা ধর্ম, সুপ্রিম কোর্টের সামনে এসেই হইহল্লা শুরু করে দিল। 

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বেশ গম্ভীর মুখেই শুনলেন তাদের বক্তব্য। এসব পেটি বক্তব্য শুনতে মোটেই ভালো লাগছিল না ওঁর। সেই হাতে ব্যাজ বাঁধা মানে জাত যাওয়া, সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়া এসব। এসব জাতপাত করেই জাতটা শেষ হয়ে যাবে একদিন! 
সত্যি বলতে কী ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যত না এদের কথা শুনছিলেন, তার চেয়ে বেশি ভাবছিলেন সাধারণ লোকগুলোর কথা। পালকি ছাড়া তো গতি নেই। সাহেব অফিস যাবেন কিসে করে? পালকি। মেমসাহেব যাবেন হাওয়া খেতে, কিসে যাবেন? পালকি। অমুক সাহেব চাঁদপাল ঘাটে জাহাজ থেকে নেমে অক্টারলনি মনুমেন্ট তৈরির কাজ দেখতে যাবেন, কিসে যাবেন? পালকি। বাবুরা কালীঘাট পুজো দিতে যাবেন, পালকি। আরে বাবা আর কিছু আছে নাকি পালকি ছাড়া এই পোড়া দেশে!

বাংলো থেকে লালবাজার পর্যন্ত অগত্যা হেঁটে আসতে আসতেও দিব্যি হাসিখুশি শহরখানা কেমন একটা আলুনি মতন দেখতে লাগছিল ওঁর নিজেরই। 

এদিকে সামনে যে বকবক করে চলেছে, দেখে এদের সর্দার গোছেরই কেউ মনে হচ্ছে, তার কোনদিকে হুঁশ নেই, “তা হুজুর, কোম্পানি বলছে মজুরি হবে ঘন্টা ধরে। তা ট্যাঁকঘড়ি কি আর আমাদের মতো গরীবদের থাকে! ধরেন বাবু উঠে দু’ঘন্টা পালকি চড়ে ঘড়ি মিলিয়ে বলল, এই নে এক ঘন্টার হিসেবে পয়সা দেলুম। কে বাঁচাবে বলুন হুজুর আমাদের! তাইলে আপনি মা বাপ, কোম্পানিকে বলুন আমাদের সবাইকে একটা করে ঘড়ি দিতে। নইলে অন্যায্য হয় না! এই আপনিই বলুন হুজুর!” 
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একবার লোকটির দিকে তাকিয়ে খুক খুক করে কাশলেন। মনে হচ্ছে এই ওয়েদারটা ঠিক স্যুট করছে না ওঁকে। এদিকে দিন কতক চতুর্দোলায় চেপে শহরের হাওয়া খাওয়া স্থগিত আছে। এমন চললে শরীর টিঁকবে! 
এদিকে এই বিপ্লবী বাবাজির থামার নাম নেই! উফ্, কতো দাবী রে বাবা এদের!
“এবার আপনি বলুন, একে তো হাতে বেধর্ম্মের তাবিজ হাতে বেঁধে জাত মারতে চাইছেন, তায় আবার সেটাও আমাদেরই পয়সা দিয়ে কিনতে হবে! এ কেমন বিচার হলো কোম্পানির!”
হাতে একটা মাছি এসে বসেছিল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের। চটাং করে আরেকটা হাত দিয়ে সেটা মেরে বিরক্তিতে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
“আরে ধুত্তোর! বকেই যাচ্ছে বকেই যাচ্ছে তখন থেকে!”
বড় ভ্যাজর ভ্যাজর করে এরা। ওদিকে বেফাঁস কিছু বলে দিলে আবার নগরপাল স্যারের মুখ তোম্বা হয়ে যাবে। 
“আচ্ছা, যা, ব্যাজের জন্য পয়সা দিতে হবে না তোদের। খুশি এবার?”

কথাটা শেষ করেই সামনের লোকটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তড়িঘড়ি উঠে পড়লেন ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ার ছেড়ে। দেখাদেখি বেয়ারারাও বেরিয়ে এল কোর্ট ছেড়ে। মনে মনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ভাবলেন, ‘যাক বাবা, কমের ওপর দিয়ে গেল। এবার মানে মানে এরা কাজে ফিরলেই হল!’

বাড়িতে এসে তিনি হুঁকোবরদারকে দরাজ গলায় বললেন, “দেখো বাবা, তোমার কথায় কিন্তু লোকগুলোকে কিচ্ছু সুবিধে দেইনি! কিন্তু তাও দেখ কেমন সুরসুর করে এবার কাজে লেগে যাবে!”
ভেবেছিলেন খুশি হবে লোকটা। হয়তো বলবে, “হুজুর খুশি হয়ে আজকের তামাকটার আর দাম ধরব না!”
 
ওমা, কোথায় কী! খনখনে গলায় বলে, “কী যে বলেন হুজুর, জানতাম তো ডাকাতগুলো কেঁদে পড়লে আপনার দয়ার শরীর কি কিছু না করে থাকতে পারে! দিলেন তো বেজের দাম মোকুব করে!”
গলার কাছের ধমকটা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না তিনি, “এই থামবে তোমার নাকিক্কান্না? ওরা ডাকাত হলে তুমি কি হে? বলি এই তামাকটার দাম কত ধরেছ শুনি?”
একটু গুটিয়ে গিয়ে যেন শুনতেই পায়নি এমন মুখে হুঁকোবরদার বলল, “এর কী মূল্য হয় হুজুর! নিজের হাতে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা দিয়ে বানানো! এ তো অমূল্য! তা আপনার দয়ার শরীরের দয়া ওরা পেলে আমি পাব না! অন্যদিন দু’টাকা ধরি, আজ চারটাকা হয় হিসেবে, আপনি না হয় ভালোবেসে পুরো তিনই দেবেন!”
রাগে গা রিরি করছিল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের। চোখ বন্ধ করে সুগন্ধী তামাকে টান মারতে মারতে তিনি বিড়বিড় করে উঠলেন, “ডাকাত ডাকাত!”

এদিকে ধর্মঘট উঠল না। সে খাতাপত্রে যাইই লেখা থাকুক, ব্যাজের দাম মকুব ইত্যাদি। তাও দলবেঁধে লালবাজার সুপ্রিম কোর্ট অভিযানের আগেরদিন পর্যন্ত যাও বা কয়েকজন বেয়ারা পাওয়া যাচ্ছিল, কী যে হল ওদের সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরিয়ে, পরদিন থেকে একজন বেয়ারারও টিকির দেখা নেই। শুধু যারা এদিক ওদিক ভাড়া ধরে বেড়াত তারা নয়, যেখানে বাঁধা মাইনের বেয়ারা ছিল, মানে যাদের নিজস্ব পালকি, তাদের ওখানেও সব ভোঁ ভাঁ।

এদিকে খবরের কাগজগুলোতে বড় বড় করে খবর হচ্ছে। একপক্ষ কোম্পানির তরফে, আরেকপক্ষ বেয়ারাদের তরফে। এ সেই বলে, ও তাই বলে। আর এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মনে মনে ভাবেন, এমন বেশিদিন চললে কোম্পানির রাজত্বের সব অফিস আদালতে তালা পড়ে যাবে।
বাঁচা যাবে! এবার তল্পি তল্পা গুটিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন। হুঁকোবরদারকে বলেও দিয়েছেন, তাকে বিলেত নিয়ে যাচ্ছেন। কালাপানি পেরিয়ে যাওয়ার জন্য জাত যাবে, এই বলে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল লোকটা। লন্ডনে পুলিশের চাকরি পাইয়ে দেবেন, আর রাতে এসে হুঁকো সাজবে শুধু, এই লোভ দেখিয়ে তাকে রাজি করান হয়েছে। 

তবুও ম্যাজিস্ট্রেটের মন খারাপ, যদি সত্যিই পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হয়, ব্যাপারটা খুব একটা সুখকর হবে না। কলকাতা শহরটার একটা আমেজ আছে। লোকগুলো একটু গোঁড়া বটে, কিন্তু মজার। মশার কামড় আছে, গ্রীষ্মের প্রখর তাপমাত্রা আছে, তবু গঙ্গার ধারও আছে, লালদীঘি আছে। আরও একটা যে কী আছে, মায়া বলে বোধহয় ওটাকে। জিনিসটা ঠিক সুবিধের নয়।  
আর স্বদেশে একরকম বন্ধুত্ব হয়, পরবাসে অন্যরকম। সেখানে নিজের দেশের লোক দেখলে আপনা থেকেই তাকে আপন লাগে। সে তাকে ছাই এর আগে জীবনে কোনোদিন দেখেছি কী দেখিনি, সে ভালো না ঝগড়ুটে সেসব তো অনেক পরের কথা। 
ইতিমধ্যে সেরকম বেশ কিছু বন্ধুও জুটে গেছে স্বাভাবিক নিয়মে। তাদের মধ্যে আবার মিস্টার ব্রাউনলো একটু বিশেষ পছন্দের। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মতোই নির্বিবাদী মানুষ, আবার এই নতুন দেশটা সম্পর্কে উৎসাহও আছে। থাকে ইংরেজ পাড়ায়। 

সেদিন বিকেলে করার মতন কিছুই ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ঠিক করলেন বন্ধু কী করছে দেখে আসেন। ভালোই মনে আছে ওঁর, ব্রাউনলোরও একখানা সাধের পালকি আছে। বাঁধা বেয়ারা। নিশ্চিত সে ব্যাটাদেরও কোনো পাত্তা নেই।  

ঠিক যা ভেবেছিলেন,  ব্রাউনলোর বাড়িতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সেটাই দেখলেন। অনেকটা মণিহারা ফণীর মতন উদাস হয়ে বাড়ির সামনেটায় ব্রাউনলো অল্প অল্প পায়চারি করছেন। আর বার বার সামনে রাখা পালকিখানার দিকে চোখ টেরে টেরে দেখছেন। এমন করে দেখছেন যেন মনে হচ্ছে প্রিয় কোনো বন্ধু বিছানায় মুমূর্ষু হয়ে পড়ে আছে, ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে যতটুকু পাচ্ছেন শেষ সময়টুকু দেখে নিন। 
ব্রাউনলোর টাট্টু ঘোড়াখানাকেও দেখতে পেলেন একটু পিছনদিকে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। বেচারা জীবটা মাথা নিচু করে একটা বালতি থেকে বোধহয় ঘাসপাতা খাচ্ছে। একঝলক দেখলে মনে হবে বুঝি মনিবের দুঃখে মাথা নিচু করে নীরবতা পালন করছে।  

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ভেবেছিলেন এই দুঃসময়ে বন্ধুকে দেখতে পেয়ে ব্রাউনলো বোধহয় উৎফুল্ল হবে, কী ছুটে এসে জড়িয়ে মড়িয়ে একশা করবে। 
ওমা কোথায় কী!
তাঁকে দেখতে পেয়েই ব্রাউনলো কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন যেন। বেশ উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন, “সব, সব এই তোমাদের মতন লোকজনদের জন্য!”

এই কল্পনার বাইরের আপ্যায়নে খানিক ঘাবড়ে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলতে লাগলেন, “ইয়ে মানে আমি আবার কী করলাম রে বাবা!”
“তুমি আবার কী করলে মানেটা কী? ওই যে লোকগুলো গেল তোমার কাছে অত আশা নিয়ে! তুমি শুধু দুটি পয়সা মকুব করে ছেড়ে দিলে! এই তোমাদের মতন লোকগুলোই এই দেশটার সর্বনাশ করবে যা বুঝতে পারছি!”
অকস্মাৎ আক্রমণে তখনও তিনি খানিক দিশেহারা। আমতা আমতা করতে লাগলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, “আহা আমি তো ওদের ভালোর জন্যই….” 
“এই বাজে কথাগুলো তোমার কোম্পানিকে গিয়ে বলগে যাও! ঠিক আছে? ভালো? ভালো আমার মুন্ডু আর তোমার মাথা! ভালো চাইলে ওদের সব দাবি মেনে নিয়ে আবার শহরটাকে সচল করে ফেলতে পারতে। আর বলি ভাড়া কন্ট্রোল করার আর কোনো উপায় ছিল না! ওই নগরপালটা হয়েছে আরেকটা গাধা! নির্ঘাত কোনো বেয়ারা উল্টোপাল্টা ভাড়া চেয়েছে, দে সবকটার পেছনে বাঁশ করে! এই করেই তোমরা…”
“আরে উত্তেজিত না হয়ে একটু আমার কথা শুনবে?”

যতই হোক, ব্রাউনলো ভদ্রলোক। আসলে বেচারা নিজে তিনদিন অফিস যেতে পারেনি, সাধের পালকিখানা পরবাসের বিরহী স্ত্রীর মতন চেয়ে আছে তাঁর দিকে তাকিয়ে। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! 

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কথায় একটু মেজাজ নরম হল ওঁর। হয়তো মনে মনে একটু লজ্জিতও হলেন। এটা তো ঠিক তাঁর স্বাভাবিক স্বভাব নয়! মেজাজ হারিয়ে বলে ফেলেছেন। 
নিজেই এবার শান্তভাবে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলেন বন্ধুকে। রাঁধুনিকে দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়ালেন। ওঁর হুঁকোবরদারকে বললেন ভালো করে একটু তামাক বানাতে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও চা খেতে খেতে দুঃখ করছিলেন, “কষ্ট কি আর তোমার একার হচ্ছে হে! গোটা শহরটার নাভিশ্বাস উঠেছে! কোথায় কিছুদিন আগেও রাস্তায় বেরোলে ব্যাটাদের ওই সুর করে করে গান গাওয়া, আর এখন চারিদিক পুরো খাঁ খাঁ করছে!”

হেসে ফেললেন ব্রাউনলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও বুঝতে পারলেন হাসির কারণ। আসলে ওঁদের আরেক শাগরেদ ক্লিভল্যান্ড এই পালকি বেয়ারাদের গান শুনে ভেবেছিলেন এটা বোধহয় তাদের কাতরানি। তারা বোধহয় আর বইতে পারছে না তাকে। এই কাতরাতে কাতরাতে প্রাণটাই বুঝি বেরিয়ে যায়! আর সেটি হলে তো আবার নরহত্যা! ক্লিভল্যান্ড আর কাল বিলম্ব না করে নেমে পড়েন পালকি থেকে।  
কী অবাক কান্ড! কোথায় দেখবেন বেয়ারাদের মধ্যে কেউ না কেউ মাটিতে জিভ উল্টে পড়ে আছে, তা নয়, দেখেন তারা নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টা করছে! ওই দেখেই কিঞ্চিৎ ভরসা আর অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে আবার গিয়ে বসলেন তিনি পালকিতে। 
আবার সেই কাতরানি! আবার ক্লিভল্যান্ড সাহেবের বুকের মধ্যে ধুকপুক ধুকপুক। কিছুক্ষণ পর আর থাকতে না পেরে বেচারা ক্লিভল্যান্ড পালকি থেকে নেমে বেয়ারাদের হাতে একটা টাকা গুঁজে দে দৌড় দে দৌড়!

দুজনের হাসি থামলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পরিস্থিতি একটু খোলসা করে বলছিলেন ব্রাউনলোকে। কোম্পানির কঠোর অনমনীয় মনোভাব, এদিকে বেয়ারারাও যে কিসের জোরে নিজের পেটের ভাতে কিল মারছে, কতদিন যে ধর্মঘট চালাতে পারবে এইভাবে কে জানে! 
ব্রাউনলো রাজনীতির অতশত বোঝেন না। তিনি উদাস স্বরে বলছিলেন, “বড় শখ ছিল বুঝলে ভায়া তাঞ্জাম চড়ার! বেশ সলভিন্স ছবি এঁকে দেবে, যেমন আমাদের কর্নওয়ালিশ সাহেব মহিশুরের রাজার জন্য বানিয়েছিলেন! মনে হচ্ছে এই জীবনে আর পূরণ হল না!”
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে সুরুৎ সুরুৎ করে চুমুক দেন। ভুড়ুক ভুড়ুক করে হুঁকোয় টান মারেন। নাহ্, বাড়ির মতন বানাতে পারেনি। ব্যাটা মুখের স্বাদ খারাপ করে দিয়েছে! 
তিনিও বিষাদগ্রস্ত গলায় বললেন, “তাঞ্জাম চড়ার শখ তো আমারও ছিল বুঝলে। ওই সলভিন্স আর্টিস্ট তো শুনেছিলাম সোনার জলের ওপর কাজ করেছিল, ভেতরে নাকি ভেলভেটের লাইনিং, তার ওপর আবার সোনারুপোর ঝালর!”

একটু উত্তেজিত হয়েই বললেন ব্রাউনলো সাহেব। 
“পালকি হবে এমন!” 
তারপর একটু থেমে আবার হতাশ হতাশ গলায় বললেন, “কবে যে তোমরা আবার সব ঠিক করবে!”
এবারের খোঁচাটা আর গায়ে মাখলেন না ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। ওঁর ধুরন্ধর মাথাতেও কোনও সুরাহা আসছিল না। তো বন্ধুকে সান্ত্বনা দেবেন আর কোন মুখে!  
বললেন, “উঠি তাহলে আজ! অনেকটা রাস্তা যেতে হবে আবার! এখন তো আর….”
না বলা কথাগুলো দুই বন্ধুই ভালোই বুঝতে পারলেন। কিন্তু কী আর করা! 
 
বন্ধু চলে যেতেও ব্রাউনলো সাহেব অনেকক্ষণ ধরে বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন। তখন সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তায় গ্যাসের আলো আসেনি তখনও। সূর্য ডুবল মানেই অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায় কলকাতা শহর। 

ঘরের ভিতর রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলছিল। তার থেকেই হালকা আলো এসে পড়ছিল রাস্তার মধ্যে। চাঁদনি রাত হলে হয়তো সেটুকুও বোঝা যেত না। কিন্তু আজ রাতের আকাশে মেঘ আছে। গুমোট গরম। কখনো মেঘ কেটে যাচ্ছে, তখন একটা দুটো তারা দেখা যাচ্ছে। কখনও আবার পুরো আকাশের কোথাও কোনও চিলতে ফাঁকা নেই। 
পায়ে পায়ে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন পালকিটার সামনে। একবার আদর করে হাত বুলিয়ে দিলেন নিষ্প্রাণ জিনিসটার গায়ে। নিষ্প্রাণ হলেও বোধহয় কিছু উষ্ণতা সবার থাকে। নইলে ব্রাউনলো যখন হাত রাখলেন, কেন মনে হলো প্যালানকুইনটা নতুন বউয়ের মতন কেঁপে উঠল একবার!
মুঘল সময় থেকে বিদেশিরা তো এই নামেই ডাকে একে। ব্রাউনলো সাহেবের মনে হল পালকিটা মনে হয় কাঁদছে। তা কাঁদবে না? গতিই যার ভূষণ, তাকে ঢ্যাপের খইয়ের মতন বসিয়ে দিলে সে কাঁদবে না!
ব্রাউনলো সাহেবের ইচ্ছে হল চার জন বেয়ারার দরকার নেই। তিনি নিজে একাই একশো। যদি তাঁর শরীরে আলেকজান্ডারের মতন জোর থাকত, তাহলে তিনি একাই ঠেলে ঠেলে সাধের পালকিখানা কোথা থেকে কোথায় গড়গড় করে নিয়ে চলে যেতেন! খানিক প্রাণ খুলে বাঁচত পালকিটা!  

ঠিক তক্ষুণি একইসঙ্গে দুটো জিনিস ঘটল। আস্তাবল থেকে ওঁর সাধের পনি ঘোড়াখানা যেন মনিবকে সমবেদনা জানানোর জন্য একবার চিঁহি করে ডেকে উঠল এবং আকাশ থেকে মেঘ কেটে গিয়ে কোন সুদূর থেকে ভেসে আসা নক্ষত্রের আলো এসে পড়ল ব্রাউনলো সাহেবের সাধের মেঠো জাহাজের গায়ে। 

এখনকারই কোনও শিল্পীর আঁকা। ব্রাউনলো সাহেব দেখলেন পালকির গায়ে একটা শিশু আঁকা, তার সামনে একটা গোল বল। একটা কাঠি দিয়ে শিশুটি বলটা ঠেলছে আর ছবিটা একমুহূর্তের জন্য সাহেবের মনশ্চক্ষে সচল হয়ে উঠল। তিনি দেখতে পেলেন গড়গড় করতে করতে বলটা মাটির ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আর অতিদূর নক্ষত্রের মায়াবি আলোর তিনি স্পষ্ট দেখলেন, পালকির গায়ের স্থবির দ্বিমাত্রিক শিশুটি যেন খিলখিল করে হেসে হাততালি দিয়ে উঠল। চারপাশের সেই অন্ধকার বিস্তৃত কলকাতা শহরে যেন সেই খিলখিল হাসি আর হাততালির শব্দ আপনমনে খেলা করতে লাগল। 
“ওরে কে কোথায় আছিস রে জলদি আয়!”

চাকর বাকররা বোধহয় ভেবেছিল বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। কে জানে, বলা তো যায় না, চৌরঙ্গীর ডাকাত পালকি ধরতে না পেরে বোধহয় সটান ইংরেজ পাড়াতেই বুঝি চলে এলো। 

খানিক হাঁকডাকের পর যখন চাকর বাকররা বুঝতে পারল সত্যি সত্যি ডাকাত পড়েনি, তখন একে একে তারা বাইরে বেরোল। দেখল সাধের পালকিখানার পাশে তাদের সাহেব মুখচোখ উজ্জ্বল করে দাঁড়িয়ে আছেন। কেন কে জানে, সেদিন রাতে ওঁকে দেখতে রাশভারি সাহেব নয়, একদম একটা দুষ্টু শিশুর মতন লাগছিল। 
বাড়ির সব চাকর বেরিয়ে এসেছে। সরকার থেকে শুরু করে রাঁধুনি, খিদমতগর, হরকরা, মশালচি, আবদার, মালি, দারোয়ান সবাই। 
সারারাত ধরে চলল সে এক মহাযজ্ঞ। ব্রাউনলো সাহেব একবার এই করতে বলেন, একবার ওই করতে বলেন। কখনো বা নিজেই এসে হাত লাগান সেই বিচিত্র কর্মযজ্ঞে। যা আদতে বদলে দেবে শহর কলকাতার আগামীকাল। 

পরেরদিন ভোরবেলা যখন সবাই ক্ষান্ত হলো, ব্রাউনলো সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছিল এক্ষুণি বোধহয় ইউরেকা ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠবেন! চাকর বাকররা, মায় রাস্তায় অত সকালে যারা যাচ্ছিল তারাও অবাক চোখে তাকিয়েছিল এই কিম্ভুতকিমাকার জিনিসটার দিকে। 
আর সময় নষ্ট না করে রাতজাগা ব্রাউনলো সাহেব এবার চেপে বসলেন তার ওপর। গাড়ি সোজা গিয়ে থামল তার বন্ধুর বাড়ির সামনে। রাস্তায় যারা সেই গাড়ি সেদিন জীবনে প্রথমবার দেখেছিল তাদের ছানাবড়া চোখের কথা বর্ণনা করতে গেলে আরেকটা গল্প লিখে ফেলতে হবে। 
তা সে যা হোক। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তখন সদ্য প্রাতরাশ সেরে হুঁকোখানা বাগিয়ে বসেছেন। এমন সময় রাস্তা থেকে উত্তেজিত গলায় হাঁকডাক শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে তো চিত্তির চড়কগাছ! 

এমনিতে মশামাছিকে বড় ভয় পান ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। কিন্তু সেদিন সেই বিচিত্র জিনিস দেখে ওর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে কতগুলো যে মশামাছি ঢুকেছিল স্বয়ং যিশুখ্রিষ্টও বোধহয় বলতে পারবেন না! 

তা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কী দোষ! পাশে দাঁড়ানো সেই হুঁকোবরদারের অবস্থাও তো তথৈবচ। দেখেন কী, পালকিখানার চারদিকে চারখানা চাকা লাগিয়েছেন ব্রাউনলো সাহেব। আর সঙ্গে জুতে দিয়েছেন তার সাধের পনি ঘোড়াটি। 

ব্যাপারটা দেখে সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু সেই সহজ ব্যাপারখানাই ব্রাউনলো সাহেবের আগে কেউ মাথা থেকে বের করতে পারেননি। 

সেদিন অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের চেয়েও বেশি খুশি হয়েছিল তার সেই বিখ্যাত হুঁকোবরদার। কারণ এটুকু সেই মুহূর্তেই ভীষণভাবে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, এই পালকিগাড়ি একবার দাঁড়িয়ে গেলে ওড়িয়া ধর্মঘটী বেয়ারাদের আর কেউ মোটে পুঁছবে না। 

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নেমে এসে বলেন, “করেছ কী! তুমি তো ধর্মঘটের পুরো বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিলে দেখছি!”
এই জিনিসটা ব্রাউনলো সাহেব ঠিক ভাবেননি। যদিও নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনায় তখনও তিনি কাঁপছেন। ওই গলাতেই বললেন, “বেড়ে হয়েছে জিনিসটা, কী বলো!”
বন্ধুর পিঠে চাপড় মারতে মারতে ম্যাজিস্ট্রেট বলে উঠলেন, “তাতে কি আর কোনো সন্দেহ আছে!”

তারপর খুব গোপন কোনো কথা বলার মতো করে তিনি ব্রাউনলো সাহেবকে আরেকটা খবর দিলেন। বললেন, “শোনো হে, বিহারের হিন্দুস্থানি রাউনি বেয়ারারা এই সুযোগে ঝাঁকে ঝাঁকে কলকাতায় চলে আসছে। তারা একবার এসে পড়লে আর…”
ইঙ্গিতখানার মধ্যে একটুও অস্পষ্ট কিছু ছিল না। ব্রাউনলো সাহেব নিজেও বুঝতে পারছিলেন, কলকাতা শহরের প্রথম ধর্মঘটের এবার শেষ হয়ে এল বলে। 

হলও তাই। 

ব্রাউনলো সাহেবের পালকিগাড়ির বুদ্ধি মহামারির মতন ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। যেন ধর্মঘটের মহৌষধের কাজ করল এই নতুন গাড়ি, মুখে মুখে যার নাম হয়ে গিয়েছিল ব্রাউনবেরি। ওড়িয়া বেয়ারাদের ধর্মঘটের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য ব্রাউনবেরিই যথেষ্ট ছিলেন। 

রুজি রোজগার চৌপাট হয়ে যাচ্ছে দেখে আবার নতুন করে মিটিং হল। মজুরি নির্ধারিত হল। পালকি আর বেয়ারাদের হাতে ব্যাজ উঠল যথাবিহিত, প্রত্যেককে আলাদা সংখ্যাও দেওয়া হল। ধর্মঘট উঠে গেল। বেয়ারারা ফিরে এলো কাজে। 

কলিকাতা আবার তার নিজস্ব ছন্দে চলিতে লাগল। তবে এই গল্পের শেষ আরও সামান্য একটু বাকি ছিল। 

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এখন নিজের ব্রাউনবেরি গাড়িতে করে লালবাজার সুপ্রিম কোর্ট যান। পালকির সমস্যা মিটেছে। মনমেজাজ শরীফ। কিন্তু অন্য একটা কারণে তাঁর মনমেজাজ বড়ই খারাপ। 
তাঁর সেই হুঁকোবরদার চাকরি ছেড়ে ভেগেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এতদিন এত ভালো সম্পর্ক রাখলেন তিনি, কতদিন মুখের ডগায় চলে আসা ধমক গিলে নিয়েছেন ওই বিশেষভাবে বানানো তামাকের মায়ায়। তাও হতভাগা এমন করল!

তায় আবার তিনি জানতে পেরেছেন, সেই হতভাগা নাকি নিজের মহলে বলে বেরিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মতো মানুষের কাছে তার মতো গরীব লোকের চাকরি করা পোষায় না। অন্য বাড়িতে তামাক থেকে আরও বেশি আয় করা যায়। সাহেব নাকি বড্ড টিকটিক করেন! 

সে এখন তাই ব্রাউনবেরি গাড়ি চালানো ধরেছে।

কোই পরোয়া নেহি। ওরকম একটা গেছে, একশোটা আসবে। বুকের ব্যাথা চেপেই বলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। 
এই আজই একজন দেখা করতে এসেছে। হুঁকোবরদারের চাকরির আবেদন নিয়ে। 

লোকটিকে দেখে বেশ ভালই লাগল। কথাবার্তা মোলায়েম। সবসময় “জি হুজুর” “জি হুজুর” করে হাত কচলে কথা বলে। একখানা তামাক বানাতেও বললেন, পরীক্ষা করার জন্য। আগের মতো না হলেও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। মনে মনে খুশিই হচ্ছিলেন তিনি। শুধু একটাই জিনিস, লোকটাকে বড় চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না কোথায় দেখেছেন আগে। 
মোটামুটি কথাবার্তা পাকা করেই ফেললেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। লোকটা নিজে থেকেই বলল, “হুজুর, একটা আর্জি ছিল!”
উফ্, কাজে ঢুকল না ঢুকল তো আর্জি শুরু! এদের নিয়ে…বিরক্তি না চেপে বেশ কড়া গলাতেই তিনি বললেন, “আবার কী দাবি?”
“আজ্ঞে হুজুর আপনাদের তো হপ্তায় ছুটির দিন থাকে। আমরাও তো মানুষ বলেন! ওই রবিবার দিনটা….”

ঠিক তক্ষুণি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মাথায় ঝিলিক খেলে গেল লোকটাকে কোথায় দেখেছেন আগে। লালবাজার, সুপ্রিম কোর্ট। বেয়ারাদের দাবি নিয়ে হাত পা মুখ নেড়ে যে লোকটা কথা বলছিল! সে ব্যাটা পালকি ছেড়ে এখন হুঁকোবরদার হয়েছে! কেন জানি মুখে একচিলতে হাসি খেলে গেল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের। যা বাঁশ দিয়েছে ব্রাউনবেরি আর করবেই বা কী এরা! 
তারপর চোখ পাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, “আগে কাজে ঢোকো পরে ওসব ভাবা যাবে! মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি! এটা কোম্পানির শাসন বাবা! যাও যাও, মেলা কাজ পড়ে আছে আমার!”

লোকটা একবার সামান্য ঝুঁকে সেলাম জানিয়ে ছোট ছোট, কিন্তু দৃঢ় পায়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আরেকবার সেদিনের সুপ্রিম কোর্টের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল ওঁর। 
অপসৃয়মান মানুষটার দিকে চেয়ে অভিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট বিড়বিড় করে উঠলেন, “ধর্মঘট! এই তো সবে শুরু হল!”

বৈশাখী ২০২৪