সৈকত সুন্দরী ও তার বিদেশি প্রেমিক

দমদম, কলকাতা

মাত্র দুদিনের ছুটিতে, ছুটে বেরিয়ে পড়তে হলে বঙ্গসমাজ, চোখ বেঁধে দিলেও অনায়াসে যেখানে পৌঁছে যেতে পারে, মনোরম সেই সমুদ্র প্রেয়সীর নাম দিঘা। জীবনে বার কয়েক দিঘা ঘুরতে যাননি, এমন লোক পশ্চিমবঙ্গে হয়তো হাতে গোনা। তবু, অনেকেই হয়তো জানেন না, আজ যে রূপ দেখে, হাস্যোজ্জ্বল সালঙ্কারা সুসজ্জিতা মূর্তি দেখে আমরা মুগ্ধ হচ্ছি, তার শুরুটা কেমন ছিল। সেই অপাপবিদ্ধা কুমারী কন্যকা তার প্রাক যৌবনে কি ঝাউবীথি জুড়ে ছুটে বেড়াত কপালকুন্ডলার মতো? না কি অতন্দ্রিতা প্রতীক্ষায় চেয়ে থাকত মানুষের পদধ্বনি শুনবে বলে? খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়, ইতিহাসের পাতা উলটে দেখা যাক কেমন ছিল শুরুটা-
কলকাতা শহরের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত ধরে একশত সাতাশি কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসে, যে ক্যাসুরিনা শোভিত, সাত কিলোমিটার বিস্তৃত স্বর্ণালি বালুচর দেখতে পাওয়া যায়, তৎকালীন বৃটিশ উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা, তাকেই আদর করে ডাকতেন, “দ্য ব্রাইটন অফ ক্যালকাটা!” স্থানীয় লোকেরা তখন তাকে “বীয়ারকুল“ বলে জানে।
প্রথম লিখিত তথ্য হিসাবে 'হিকি'জ গ্যাজেট'  থেকে পাওয়া তথ্য দেখে নেওয়া যেতে পারে।
Hicky's Gazette, May 1780: 
We are informed that the following person of figure and consequences arrived at Beercool for the benefit of their health and fish! Henry Grant Esqr., and Lady, and brother - in- law, Major Camac, Capt. Robinson… Miss Burne, and extremely elegant and agreeable young lady.
এর  থেকে বোঝা যায় বৃটিশ আমলে বীয়ার কুলের কদর ছিল ছুটি কাটানোর স্থান হিসাবে। হয়তো সমুদ্র জলে অবগাহন সমাপনান্তে সোনালি বালুকাবেলায় রৌদ্র স্নান তাদের ফেলে আসা স্বদেশের স্মৃতি তাজা করে তুলতে সাহায্য করেছে। 
তখনকার বীয়ারকুল আর আজকের দিঘা যে এক, তার প্রমাণ দুটি স্থানের ভৌগোলিক অবস্থানের অভিন্নতা। এ ছাড়া বৃটিশ অফিসারদের দেওয়া বর্ণনায় রামনগর খাল, বীরকুল পরগনার পরিচয় নিশ্চিত করে, যে সেদিনের বীয়ারকুলই আজকের দিঘা।
তৎকালীন বৃটিশ শাসিত ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস অবসর যাপনের জন্য এই সমুদ্র সৈকতে বাংলো বানিয়েছিলেন।
Hon' ble Jone Company তে ক্যারী যা লিখেছেন, তা বাংলায় অনুবাদ করলে কিছুটা এরকম দাঁড়ায়,
হিজলী থেকে অনতিদূরে এই সমুদ্র সৈকতটির নাম বারকুল! ১৭৮০ থেকে ১৭৮৫ সালের মধ্যে এই মনোরম সমুদ্র সৈকতটি 'কলকাতার ব্রাইটন'  নামের খেতাব পেয়েছিল। সে সময় সেখানে অনেকগুলি বাংলোবাড়ি ছিল- অবসর যাপনের উদ্দেশে অনেকেই সেখানে যেতেন। তারপর কেন জানি না, এই সমুদ্র সৈকত ক্রমশ সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৮২৩ সাল-তক সেখানে একটি মাত্র বাংলোবাড়ি মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে ছিল। বাংলোটি বানিয়ে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস।
এখন আমরা যে দিঘাকে দেখি, আর ওয়ারেন হেস্টিংস যে বীয়ারকুলে/ বারকুলে ঘর গড়েছিলেন, তা কাছাকাছি হলেও একটু পার্থক্য রয়েছে। বালুচরে গড়া সেই ঘর বিলুপ্ত হয়েছে সমুদ্রের খেয়ালে বা বালির ধ্বসে। সমুদ্র তার আগের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে এসেছে। নয়তো সেই সময়ের বানানো সারি সারি সাহেবি বাংলো চিহ্নমাত্র না রেখে উধাও হয়ে যাওয়ার কথা নয়।
দিঘা থেকে কিছুটা দূরে বালিসাই নামের একটি গ্রাম আজও রয়েছে। প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী, ওয়ারেন হেস্টিংসের বারকুল যাওয়ার পথে এই গ্রামের কাদায় গাড়ির চাকা অচল হয়ে পড়ে। লাট সাহেবের বিপদ দেখে, ওই গ্রামের তৎকালীন জমিদার নিজের হাতি দিয়ে, সেই কাদার দ' থেকে গাড়িটা টেনে তোলান। সাহেব অবশ্য এ হেন উপকারের প্রতিদান দিতে ভোলেননি। একটি ট্রিগার কামান আর চিপেন্ডেল খাওয়ার টেবিল উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন সেই ভুঁইয়া জমিদারকে।
ওয়ারেন হেস্টিংস-এর এতই পছন্দ ছিল জায়গাটা যে তিনি একবার মিসেস হেস্টিংসকে চিঠিতে লিখেছেলেন, “বীয়ারকুল একটি স্বাস্থ্যাবাস- কলকাতার ব্রাইটন বলা যায় তাকে!”
যাওয়া আসা পথের অসুবিধা মাথায় রেখে, এবং বীয়ারকুলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে সরকার পক্ষ থেকে এই সমুদ্র সৈকত সুন্দরীর আদিম নগ্নতা ঢেকে আধুনিকতার বস্ত্র পরানোর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল তখন। বেঙ্গল গেজেট  পত্রিকার মে সংখ্যা, ১৭৮০তে লেখা হয়েছে, 
বীয়ারকুলকে একেবারে আধুনিক ঢঙে ঢেলে সাজাতে হবে। এ সৈকতের কতকগুলি প্রাকৃতিক সুবিধা এমনিতেই আছে। বেলাভূমি প্রশস্ত, গাড়ি চালানো যায়। পৃথিবীতে গাড়ি চালাবার উপযোগী যত সমুদ্র সৈকত আছে, বীয়ারকুল তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এছাড়া উপদ্রবকারী জন্তু জানোয়ার একেবারেই নেই বলা চলে- একমাত্র ব্যতিক্রম বোধ করি কাঁকড়া। 
অষ্টাদশ শতকের জনপ্রিয় সেই সমুদ্র সৈকত মুখরিত হয়েছিল অগুণতি সাহেব মেমের ঘোড়ার গাড়ি, নৌকা আর পালকির আনাগোনায়। তারপর অজানা কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিল বীয়ারকুল। আবার জেগে উঠলো  বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। নতুন নামে, নতুন রূপে। এই নবজাগরণের কৃতিত্বের দাবিদার আর এক সাহেব, জন ফ্রাংক স্নেইথ, দিঘার তৎকালীন এডমিন্সট্রেটর শ্রী অরুণ চট্টোপাধ্যায় যাঁকে ‘লিভিংস্টোন অফ দিঘা’ বলে সম্বোধন করতেন।
শুরু থেকেই বলা যাক। উনিশশো আটচল্লিশ সালে ১৫ই অক্টোবর কলকাতা শহর থেকে ছয়জন বন্ধু বিগত শতকের বীয়ারকুল খুঁজতে বের হন। এই ব্যাপারে তারা জেনেছিলেন হিকির গ্যাজেট পড়ে। দলটিতে স্নেইফ ছাড়াও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন, গ্রিনফিল্ড, জে.জেনকিন্স, মিস্টার রিভ বীচক্রফট, এবং ইংলিশ ম্যান পত্রিকার একজন সাংবাদিক। দুর্গম কর্দমাক্ত সে পথ অতিক্রম করার বিস্তারিত বিবরণ ইংলিশ ম্যান পত্রিকায় বের হয়েছিল সেবার৷ বীয়ারকুল ততদিনে সমুদ্র গর্ভে, সুতরাং ছয়জনের দলটি যে নতুন গ্রামটিকে খুঁজে পেয়ে তাঁদের অভিযানে সহর্ষ ইতি টেনেছিলেন তা ওই অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রাম- দিঘা।
সেই প্রথম দেখায় কী চোখে দেখেছিলেন দিঘাকে, তা চল্লিশোর্ধ্ব অবিবাহিত স্নেইথ জানেন। ইতিহাস বলছে, সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের রূপকার ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়কে তিনি চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ জানান, দিঘাকে বিচ রিসোর্ট হিসাবে গড়ে তুলতে। 
সেইবার বন্ধুদের সঙ্গে ফিরে গেলেও, দিঘার টানে পরবর্তীকালে আবার ফিরে এসেছেন স্নেইথ। প্রথমে ছোট্ট কুঁড়েঘর বানিয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসতেন, যাতায়াতের সুবিধার জন্য কিনেছিলেন মনো-প্লেন। ধীরে ধীরে বাইশ বিঘা জমি কিনে সুসজ্জিত দোতলা বাড়িও বানিয়ে ফেলেছিলেন স্নেইথ। দিঘার প্রতি টান দিন প্রতিদিন বেড়েছে বই কমেনি। প্রিয়তমার মতো মুগ্ধ করে রেখেছে আজীবন। 

বিধানচন্দ্র রায়, পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে নিজেদের রাজ্যে সমুদ্র সৈকত উপহার দেওয়ার জন্য আবশ্যকীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। খড়গপুর থেকে রাস্তা তৈরি হল পর্যটকদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে। দিঘা বাজার, বিভিন্ন বাজেটের হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ, হলিডে হোম। সাতমাইল ব্রিজ, পিছাবনী সাঁকোও সেই আমলে তৈরি। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি বড় অংশ পর্যটন ব্যবসা থেকে আসতে শুরু করল। 
বিধানচন্দ্র রায়ের পর, মুখ্যমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করলেন শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র। তিনিও দিঘাকে পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। আঠেরোশো আটচল্লিশ খৃস্টাব্দে, পূর্ত বিভাগের তৈরি একটি একতলা কুঠি বাড়ি ছিল দিঘার একমাত্র সম্পদ। বাড়িটি বানানো হয়েছিল সেচ বিভাগের কাজের সুবিধার জন্য। পরবর্তীকালে সরকারি কর্মচারীদের আনাগোনা শুরু হল। দিঘাকে সাজিয়ে তোলার প্রস্তুতি হিসেবে সৈকতাবাস বানানোর প্রস্তুতি চলছে। মুখ্যমন্ত্রীসহ অন্যান্য রাজ কর্মচারীদের আনাগোনা চলছে অবিরত। শ্রদ্ধেয় স্বনামধন্য লেখক শ্রী নারায়ণ সান্যাল, পেশায় ছিলেন একজন সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর উপর ভার পড়েছিল দিঘার প্রথম সরকারি সৈকতাবাসকে সাজিয়ে তোলার। প্রস্তাবিত ভবনটির যে ড্রয়িং তিনি বানিয়েছিলেন, তার তিনতলার ভিত থাকলেও, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী সেটি দোতলা বানানো হয়। যদিও একবারে তিনতলা বানিয়ে নিলে, খরচ এবং সময় দুইই বাঁচত, তবু স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়ের দিয়ে যাওয়া নির্দেশ অনুযায়ী ভবনটির নির্মাণ দোতলা অবধি করা হয়।
নারায়ন সান্যালের ড্রয়িংটি নিখুঁত ছিল। চব্বিশটি একক সজ্জা, ছয়টি দ্বৈত সজ্জা বিশিষ্ট কামরার কথা ভেবেছিলেন তিনি। এছাড়া রেস্তোরাঁ, পাঠাগার সবই ছিল সেখানে। তবু তাঁর মন খুঁতখুঁত করছিল, কারণ একবার ব্যবহার করা শুরু হলে, যাত্রী পরিপূর্ণ সৈকতাবাসে, তিনতলা করা বেশ ঝামেলার ব্যাপার হবে। তবু কর্তৃপক্ষ রাজি হননি তখন। কর্তৃপক্ষের এই দৃঢ় সিদ্ধান্তের কারণ এক সন্ধ্যায় উন্মোচিত হয়েছিল তাঁর সামনে। তা যেমন মনোগ্রাহী তেমনই হৃদয়স্পর্শী।
ওভারল্যান্ড ৯১ এর নতুন তৈরি শক্তপোক্ত ইঞ্জিনের ক্ষমতা পরীক্ষা করতে খেলাচ্ছলে একদল ব্রিটিশ নাগরিক যখন বহু কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে সত্যিই ওভারল্যান্ড ৯১ এর কষ্ট সহিষ্ণুতার প্রমাণস্বরূপ দিঘায় এসে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, সেই সময় সালটা হয়তো উনিশ শো বাইশ কি তেইশ হবে। এঁদের মধ্যে আর কেউ বারে বারে ফিরে এসেছিলেন কিনা জানি না, তবে হ্যামিল্টন কোম্পানির বড়সাহেব স্নেইথ কিন্তু বাঁধা পড়েছিলেন অদৃশ্য বন্ধনে।  যাতায়াতের সুবিধার জন্য মনো-প্লেন কিনে নিয়েছিলেন, যা অনায়াসেই বালির সৈকতে নামতে পারত। প্রথমে ছুটি ছাটায় এসে ঘুরে গেছেন, থেকে গেছেন পর্ণ কুটিরে।
দিঘার প্রথম বিলাসবহুল বসত বাড়িটি তিনিই বানান। অবসরের পর পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন সেখানে। আপন বলতে ড্রাইভার,  খিদমদগার, মালি- হ্যাঁ, খুব সুন্দর বাগান ছিল স্নেইথের বাড়িতে। এক জোড়া অ্যালসেশিয়ান পোষ্য ছিল তাঁর। তাদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বালিয়াড়ির উপর হেঁটে বেড়াতেন তিনি। তখন দিঘার সৈকত এখনকার মতো জনবহুল ছিল না। যাঁরা সেখানে থাকতেন, বা সরকারের কর্মচারী, এলাকার আদি গরীব বাসিন্দা সকলেই একডাকে চিনতেন স্নেইথ সাহেবকে। 
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীর্ণ হয়ে যায় শরীর, কিন্তু মনের রঙে মরচে ধরেনি তখনও। চলাফেরায় অক্ষম হয়েছেন, একটি আরাম কেদারা নিয়ে বসে থাকতেন দোতলার  বারান্দায়। তৃষ্ণার্ত নয়নে চেয়ে থাকতেন উচ্ছ্বল সাগরের দিকে। তাঁর মনের এই গোপন আকুতি গোপনে থাকেনি ডক্টর বিধান চন্দ্রের কাছেও। তিনি নিজে মুখ্যমন্ত্রী হলেও তাঁর চিকিৎসা শাস্ত্রের জাদুকরি বিস্ময় আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। তিনি ঠিক ধরতে পেরেছিলেন মুমূর্ষু সাহেবের সঞ্জীবনী সুধার উৎসমুখ। তাই নিজের মহাপ্রয়াণের আগেই উনিশশো বাষট্টি সালে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন স্নেইথ সাহেব যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন প্রস্তাবিত সৈকতাবাস যেন দ্বিতল অবধিই উচ্চতা লাভ করে। বস্তুত দরদি মানুষটি স্নেইথ সাহেবের দু’চোখ ভরে সমুদ্র দর্শনের পথে কংক্রিটের নিষ্ঠুরতার আড়াল আনতে চাননি।
নারায়ণ সান্যাল মহাশয়ের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি যখন সরকারি কাজে দিঘায় উপস্থিত ছিলেন, স্নেইথ সাহেব তখনও জীর্ণ দেহে বর্তমান। লেখকের চোখ অনেক কিছুই দেখতে পায় যা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। অসীম কৌতূহল আর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে তিনি দেখা করতে গিয়েছিলেন স্নেইথ সাহেবের সাথে।
সাহেব তাঁর আপ্যায়নের ত্রুটি করেননি। দিঘা সম্পর্কে লেখকের কৌতূহল মেটাতে পুরোনো দিনের ফটোগ্রাফ, পেপার কাটিং দেখিয়েছেন স্নেইথ সাহেব। অনেক কথার মাঝে এই ভেবে দু:খপ্রকাশ করেছেন যে, সরকারি পর্যটন বিভাগের সৈকতাবাসটি সম্পূর্ণ হলে, তাঁর বাড়ি থেকে আর সমুদ্র দেখা যাবে না।  লেখক এবং তাঁর সাথী, সাহেবকে আশ্বাস দেন যে, সরকার বাহাদুরের এখনই বেশি উচ্চতার বিল্ডিং তোলার কোন পরিকল্পনা নেই। এই আশ্বাস পেয়ে বৃদ্ধের চোখে যে খুশির অশ্রু দেখা গিয়েছিল, তা শ্রদ্ধার মালা হয়ে প্রাত:স্মরণীয় বিধানচন্দ্র রায়ের গলায় দুলেছিল নিশ্চয়ই। 
শেষদিন পর্যন্ত দোতলার বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখেছেন স্নেইথ। বিদায় কালে তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়, সেইখানে, যেখানে অনেক দিন আগে প্রথম দিঘায় এসে কুঁড়ে বেঁধেছিলেন হ্যামিলটন কোম্পানির তদানিন্তন উচ্চপদস্থ কর্মচারী জে. এফ. স্নেইথ। উঁচু টিলার উপর একটি ছাউনি দেওয়া চতুষ্কোণ জায়গা তিনি প্রস্তুত করে রেখে গিয়েছিলেন। স্থানটি উঁচু টিলার উপর হওয়ায় সমুদ্রের জলের তোড় তাকে গ্রাস করতে পারবে না, বালুর ধ্বস তাকে ডুবিয়ে দিতে পারবে না। সেই নিভৃত নিরালায় শুয়ে অনাদি অনন্ত কাল ধরে ঢেউয়ের আওয়াজ শুনবেন স্নেইথ, দেখবেন কেমন বালুচরে আছড়ে পড়ে ফেনিল উচ্ছ্বাস! 
আজ তিনি নেই, দিঘা আছে স্বমহিমায়। দিঘাকে কেন্দ্র করে আরও বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। দিঘার জনবহুলতা, অন্যান্য দর্শনীয় স্থান যেমন তাজপুর, মন্দারমণি, নিউ দিঘা ইত্যাদি দিঘা সমুদ্রসৈকতের আকর্ষণ বাড়িয়েছে। ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরণের ওয়াটার স্পোর্টস, মেলা, অ্যাকোরিয়াম, সি-বিচ মার্কেট, জগন্নাথ মন্দির। 
ক্যালেন্ডারে দুদিন ছুটি পেলেই বাঙালি দলবেঁধে দিঘায় ছোটে। তাদের হর্ষ উল্লাসে মুখরিত হয়ে ওঠে দিঘার পথ ঘাট, সমুদ্র সৈকত। আর বালুকাবেলায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাসুরিনার দল যখন কেউ থাকে না, তখন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে বলাবলি করে সেই বিদেশির কথা যিনি সমুদ্র ভালোবেসে, এদেশকেই ভালোবেসে গেছেন। তাই তারা তাঁর কবরের ওপর পাতা ঝরায় ভালোবেসে।


তথ্যসূত্র :
Hicky's Gazette May 1780.
Hon'ble Jone Company Carry.
নারায়ণ সান্যাল। দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী। বাছাই গল্প। দেশ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা। 

বৈশাখী ২০২৪