পাঁচালিকার রূপচাঁদ পক্ষী কলকাতা শহরের বাজার নিয়ে ছড়া বেঁধেছিলেন, “বাগবাজার কলিবাজার বাজারে বাজারে একাকার, এত বাজার দোকানদার কোন রাজ্যে নাই আর।” তবে এ তো খাস কলকাতা শহরের কথা। সে শহরের পত্তন হওয়ার আগে বাংলার গ্রামের মানুষ বাজার নয়, নির্ভর করত হাটের উপর। জীবনযাত্রার ধরণ ছিল আলাদা, শাকসবজি কিনে খাওয়ার প্রয়োজন তেমন একটা পড়ত না কারুর। বাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য সপ্তাহান্তের হাট ছিল যথেষ্ট। এটাও সত্যি যে তখন সাধারণ মানুষের চাহিদা ছিল সীমিত। নদীর ঘাটে জেলেরা মাছধরা নৌকো নিয়ে ভিড় জমাত, হাটেও মাছ চালান দিত তারা। তাছাড়া পুকুর খাল বিলেও মাছের অভাব ছিল না, সেসব ছিপ দিয়ে, গামছা দিয়ে তুলে নেওয়ার কথা বার বার ফিরে এসেছে বাংলার সাহিত্যিকদের লেখনীতে। মোটমাট রোজ একটা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে বাজার বসবে, আর সেখানে সূচ থেকে মুক্তাভস্ম পয়সা ফেললেই পাওয়া যাবে, এ ছিল তাদের ধারণার বাইরে। ক্রমে গড়ে উঠল কলকাতা শহর, মানুষের ইচ্ছা চাহিদা পাল্টাতে থাকল সেই সঙ্গে। বসতিকে কেন্দ্র করে বেড়ে উঠল বাজার। কলকাতার পুরোনো বাজার বললেই চটপট কয়েকটা নাম আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বৈঠকখানা বাজার, বাগবাজার, শ্যামবাজার, শোভাবাজার, বড় বাজার, হাতিবাগান মার্কেট আর অবশ্যই হগ মার্কেট নিঃসন্দেহে সে তালিকার একেবারে উপরের দিকে। এ ছাড়াও আছে মেছুয়াবাজার, সুতানুটি বাজার আর যেখানে রবিঠাকুরের ভুলুরাম শর্মা তার ভুলের চক্করে দোকানির মাসি বুড়িকে হাসিয়ে খুন করে ফেলেছিল সেই টেরিটিবাজার। এই পুরোনো সব বাজারগুলোর কোনটা যে কার আগে তৈরি বলা খুব কঠিন। হগ মার্কেট অবশ্য ইংরেজদের তৈরি, তার নথিবদ্ধ সময়রেখা জানা সম্ভব হয়, তাছাড়া হগ মার্কেট কলকাতার প্রথম মিউনিসিপ্যাল মার্কেটও বটে। বাকিদের সময়কাল ঝাপসা হয়ে গেলেও, কীভাবে সে সব বাজার গড়ে উঠেছিল তার মোটামুটি স্পষ্ট একটা গল্প জানা যায়। অবশ্য সে গল্পে যাওয়ার আগে অতি পরিচিত একটা কাহিনি একটু ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। এ সেই তিনটে গ্রামের গল্প। সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর ডিহি কলকাতা। মুঘল সাম্রাজ্যের তালুক হলেও জমিদারির দায়িত্ব ছিল বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের উপর। ১৫৩০ নাগাদ আদিগঙ্গা বেয়ে পর্তুগিজরা আসতে শুরু করেছিল এই জলা জঙ্গল ভরা এলাকায়। এর কারণ হল সুতানুটি-হাটখোলায় মস্ত এক হাট বসত তখন। সেখানে মিলত মসলিন আর নানা ধরণের মসলা। ইওরোপে তখন মসলিনের চাহিদা প্রবল। হাট থেকে নামমাত্র দামে মসলিন কিনে ইওরোপে চড়া দামে বিক্রি করত তারা। তাদের অনুসরণ করে ডাচ আর ফরাসিরাও সপ্তদশ শতক নাগাদ আসতে শুরু করেছিল এই অঞ্চলে। ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ এর মধ্যে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন ধালিপাড়া মহাস্থান কলিকাতা কুচিনান দুই কূলে বসাইয়া বাট। পাষাণে রচিত ঘাট দুকূলে যাত্রীর নাট কিঙ্করে বসায় নানা হাট এই হাট সম্ভবত সুতানুটির হাট। দুটো বিষয় এখানে লক্ষণীয়। এক, কলিকাতা নামটি কবিকঙ্কণ ব্যবহার করলেও সুতানুটি নামটি করেননি। হয়তো তখন হাটখোলা নামটাই প্রচলিত ছিল। দুই, জোব চার্ণক মহাশয় তখন কলকাতার ত্রিসীমানাতে আসেনি। সে বিতর্কে না গিয়ে বরং আলোচ্য বিষয়ে ফেরা যাক। সপ্তগ্রামে থাকতেন মুকুন্দরাম শেঠ ও বসাক পরিবারের চার শরিক। এঁরা সকলেই ছিলেন বস্ত্র ব্যবসায়ী দেশিয় বণিক। এই দেশিয় বণিকরা বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন না বটে, তবে আরব, পারস্য, তুরস্ক থেকে বণিকরা আসতেন এখানে। সপ্তগ্রামের বিপরীতে সরস্বতী নদী ধরেই আগমন ঘটত বিদেশি বণিকদের। পর্তুগিজরাও আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাদ সাধল সরস্বতী নদী স্বয়ং। পলি পড়ে মজে যেতে থাকল সরস্বতী। ওদিকে হুগলির পাড়ে হাটখোলা, বেতড় গ্রাম বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠছিল। সপ্তগ্রাম বন্দর ছেড়ে পর্তুগিজরা তখন চুঁচুড়ায় নতুন বন্দর তৈরি করা শুরু করে দিয়েছে। শেঠ ও বসাকরা বুঝতে পেরেছিলেন নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁদের এতদিনের বস্ত্র ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে। তাঁরা উঠে এলেন হুগলি নদীর পূর্বতীরে গোবিন্দপুর গ্রামে। ভাবতে অবাক লাগে, অধুনা শহীদ মিনারের কাছাকাছি অঞ্চলে তাঁরা তাঁতশালা গড়ে তুলেছিলেন। তখন অবশ্য ও অঞ্চল জঙ্গলাকীর্ণ। সে সব পরিষ্কার করে চাষবাসের ব্যবস্থাও নাকি তাঁরা করেছিলেন। বলাই বাহুল্য তাঁতি এবং চাষী সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়া এই কাজ সম্ভব ছিল না। এরাই হলো গোবিন্দপুর গ্রামের আদি বাসিন্দা। অনেকে মনে করেন, বসাকদের গৃহদেবতার নামেই গোবিন্দপুর গ্রামের নামকরণ হয়। তবে সেটা সম্ভবত সঠিক তথ্য নয়, কারণ তাঁদের আগমনের পূর্বেও গোবিন্দপুর গ্রামের অস্তিত্ব ছিল। তবে শেঠ ও বসাকদের তাঁতশালার সুতোর গাঁট বা নুটি থেকে সুতানুটি নামের জন্ম হয়ে থাকতেই পারে। সুস্পষ্ট প্রমাণ না মিললেও এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গোবিন্দপুর গ্রাম এরপর বর্ধিষ্ণু হয়ে ওঠে, ও সুতানুটি হাট হয়ে ওঠে বাণিজ্যকেন্দ্র। জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছারিবাড়ি ছিল ডিহি কলকাতায়। এমন এক ক্রমবর্ধমান নগরী, আর বণিক শিরোমণি ইংরেজ আকৃষ্ট হবে না, তাও কি হয়? ১৬৮৬ সাল, ইংরেজ কুঠিয়াল জোব চার্ণক তখন হুগলিতে। মোগল ফৌজদারদের সাথে প্রবল বিরোধ বাধে ইংরেজদের, ফলে হুগলি থেকে পালিয়ে সুতানুটি আসেন চার্ণক। কিন্তু সেখানের জমিদার মোগল সম্রাটের অধীন, তাই জায়গাটা খুব নিরাপদ লাগেনি তার। পরের বছর আবার সুতানুটি আসেন চার্ণক, কিন্তু এবারেও বেশিদিনের জন্য নয়। অবশেষে আসে সেই বিখ্যাত তারিখ, ২৪ শে আগস্ট ১৬৯০। চার্ণক পাকাপাকিভাবে সুতানুটিতে ঘাঁটি পাতেন। মনে রাখতে হবে, গোবিন্দপুর, সুতানুটি, ডিহি কলকাতা জুড়ে তখন বিরাজ করছে দিব্য উন্নত এক বাণিজ্যকেন্দ্র। অথচ ওই তারিখটাই কলকাতার জন্মদিন হয়ে থেকে গেছে, হায় রে ইতিহাস। হাট বাজারের কথায় আবার ফেরা যাক বরং। চার্ণক খুব ভালো করে বুঝেছিলেন এই এলাকায় ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে এলাকার দেশিয় বণিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আজ যেখানে শিয়ালদহ স্টেশন, সেখানে তখন ছিল এক বিশাল বটগাছ। ক্রেতা আর ব্যবসায়ীরা দিনের শেষে এসে বসতেন সেই গাছের নীচে, সুখ দুঃখের গল্পের পাশাপাশি চলত ব্যবসায়িক আদান প্রদান। দেশি পোশাকে সজ্জিত চার্ণকও হুঁকো হাতে এসে বসতেন সেখানে, কথায় কথায় জেনে নিতেন তাঁদের ব্যবসার হাল হকিকত। এই গ্রামীণ বৈঠক থেকেই নাকি তাঁকে ঘিরে বসা বাজারের নাম হয়েছিল বৈঠকখানা বাজার। আজকের বৈঠকখানা বাজারের ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দিকে তাকালে সেই সময়ের কথা কল্পনা করা অসম্ভব হলেও তার অন্তরাত্মার মধ্যে কোথায় যেন বিগত সেই দিনগুলি রয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কলকাতা অধিগ্রহণ করতে থাকে বণিক ইংরেজ, তার শাসক সত্ত্বাও উঁকি দিতে থাকে। জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছ থেকে মুঘল সম্রাটকে রাজস্ব দেওয়ার অধিকার তারা কৌশলে কিনে নেয়। কেটে যায় আরও কিছু বছর, সুতানুটি ধীরে ধীরে প্রাধান্য হারাতে থাকে, আর কলকাতা হয়ে ওঠে প্রাণকেন্দ্র। এখন যেখানে জেনারেল পোস্ট অফিস, সেই অঞ্চলে কেল্লা বানিয়ে ফেলে ইংরেজরা, মুগল সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করার জন্য কেল্লা বানানোর আসল উদ্দেশ্য তারা গোপন করে যায়। কেল্লার মধ্যভাগে বাণিজ্য কুঠি বানালেও, তখন থেকেই বাংলাকে গ্রাস করা শুরু হয়। চার্ণক অবশ্য তার বহু আগে গত হয়েছেন। ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন ও দ্রুত অধিকার করে নেন। সেই সময়ে ইংরেজরা নিজেরাই গোবিন্দপুরে আগুন লাগিয়ে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে ফলতায় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরের বছর পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করে তারা কলকাতা পুনরায় অধিকার করে। ইতিমধ্যে পুরোনো কেল্লা প্রায় ধ্বংসের পথে চলে যাওয়াতে নতুন কেল্লা বানানোর প্রয়োজন পড়েছিল ইংরেজদের। জ্বালিয়ে দেওয়া গ্রামের মধ্যস্থল বেছে নিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের নির্মাণকার্য শুরু হয়। বিলুপ্ত হয় গোবিন্দপুর গ্রাম। তবে এই অঞ্চলের ধনী বণিকদের সঙ্গে শত্রুতা করার মতো নির্বোধ তারা অবশ্যই ছিল না। কুলদেবতা গোবিন্দকে নিয়ে শেঠ আর বসাকরা চলে যায় এখনকার তালতলা, কুমারটুলি আর শোভাবাজার এলাকায়। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ইংরেজরাই করেছিল। ধনী ব্যবসায়ী শোভারাম বসাক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সুতো ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। সে যুগের হিসেবে তাঁকে কোটিপতি বলাই চলে, তার উপর ইংরেজদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবাদ তিনি পেয়েছিলেন চার লক্ষ টাকা। নবকৃষ্ণ দেবের রাজবাড়ির কাছে তিনি এক বিশাল বাগানবাড়ি ক্রয় করেন। প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল উৎপন্ন হত সেই বাগানে। বাগানবাড়ির বাইরে সেই সব শাকসবজি ফলমূল বিক্রি করার বন্দোবস্ত করেছিলেন শোভারাম। ক্রমে তা এক বাজারের রূপ নেয় আর লোকমুখে তার নাম হয়ে দাঁড়ায় শোভারামের বাজার বা শোভাবাজার। বসাক মহাশয়ের নামে বাজার পরিচিতি পেলেও এই বাজার কিন্তু ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পত্তি, পুরোনো নথি ঘাঁটলে জানা যায় শোভাবাজারের বাৎসরিক জমার পরিমাণ ছিল দুশো পঁচাত্তর টাকা। আজ সে বাজারের কোন চিহ্ন না থাকলেও নামটা থেকে গেছে। শোভাবাজারের নামকরণ নিয়ে কোন দ্বিমত না থাকলেও শ্যামবাজারের নাম নিয়ে আছে নানা মুনির নানা মত। কেউ মনে করেন ওই এলাকায় ছিল শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণ জমিদারের বাস। তাঁর তালুকের অন্তর্গত পুকুরের পাশে বড় একটা বাজার বসত। কালক্রমে সেই পুকুর আর বাজারের নাম জমিদারের নাম অনুসারে হয় শ্যামপুকুর ও শ্যামবাজার। কিন্তু অন্য একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই বাজারটিও ছিল পূর্ব উল্লিখিত শোভারাম বসাকের। তিনি তাঁর কুলদেবতা শ্যামরায়ের সম্মানার্থে বাজারটির নাম দেন শ্যামবাজার। অন্ধকূপ হত্যার অন্যতম জীবিত ব্যক্তি জেফানিয়া হলওয়েল বাংলার অস্থায়ী গভর্নর হওয়ার পর শ্যামবাজারের নাম পাল্টে চার্লস বাজার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু শোভারাম তাঁর সঙ্গে আইনি লড়াই চালিয়ে পুরোনো নাম ফিরিয়ে আনেন। এই ঘটনা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক শ্যামবাজার নামের সাথে তাঁর কুলদেবতা হয়তো সত্যিই জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ সবই জনশ্রুতি, উপযুক্ত প্রমাণ কিছু নেই। আবার অন্য একটি মত অনুযায়ী সেই সময়ে ওই এলাকায় নাকি এক বিশাল নুনের বাজার ছিল। কিছু মানুষ সমুদ্র থেকে তৈরি নুনকে নাকি শ্যাম বলত। সেই থেকে এমন নাম। তবে সমুদ্র থেকে তৈরি নুনকে শ্যাম কেন বলা হত তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ভেবে দেখলে, শোভারাম বসাকের কাহিনিটি যথাযথ বলে মনে হয়। শ্যামবাজারের রমরমা আজও অক্ষুণ্ণ। জামাকাপড়ের দোকান হোক বা গহনা, পুরোনো ঐতিহ্যের মান আজও বজায় রেখেছে এই বাজার। তবে হাতিবাগান মার্কেট শ্যামবাজারের আর একটি অংশ। একাধিক জনশ্রুতি হাতিবাগানের নামের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে। আগেই বলেছি, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেছিলেন ১৭৫৬ সালে। সেই সময়ে তাঁর হাতিদের নাকি এই অঞ্চলের এক উদ্যানে রাখা হত। সেই থেকে এই নামের উদ্ভব। অন্য মতে, হাতি পদবীধারী এক ব্যক্তির বাগানবাড়ি ছিল এখানে। পরবর্তী সময়ে মেহতাব চাঁদ মল্লিক নামে এক ব্যবসায়ী এই বাগানবাড়ি কিনে নেন ও বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। নামকরণের কারণ যাই হোক না কেন, এই বাজার এখনও জাজ্বল্যমান। জাপানি বোমা পড়েছিল এই বাজারে, তবুও নাকি বিশেষ ক্ষয় ক্ষতি করতে পারেনি। আজও এই বাজারের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছেন বস্ত্র ব্যবসায়ীরা। এবার আসা যাক বাগবাজারের কথায়। মজা হল, এই অঞ্চল বাজার এলাকা হিসেবে শুরু হলেও, এক সময়ে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বাগবাজারের নাম নিয়েও মতভেদের অভাব নেই। গঙ্গার বাঁকে সুদূর অতীতে এক মস্ত বাজার বসত। সেই বাঁকের বাজার বা বাঁকবাজার নামটি নাকি অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগবাজার। অন্য একটি মত অনুযায়ী চার্লস পেরিন নামে এক জাহাজের কাপ্তেনের বাগানবাড়ি ছিল গঙ্গার তীরে। যথারীতি সেই বাগানবাড়ি ঘিরে বাজারও ছিল। মুঘলদের সঙ্গে কাজকর্ম ও বাক্যালাপে সুবিধা হবে বলে ইংরেজরা বেশি কিছু ফার্সি শব্দ শিখে নিয়েছিল। হয়তো এই বাগানকে তারা ফার্সিতে বাগ বলে উল্লেখ করতো। পরে অবশ্য এই বাগানবাড়ি নিলামে ওঠে ও হাতবদল হয়। আজ সে বাগানবাড়ি বা বাজার কোনোটারই চিহ্ন নেই। অবশ্য বাগবাজার নিয়ে থেকে গেছে নানা ছড়া, যেমন “ময়রা মুদি কলাকার, এই তিন নিয়ে বাগবাজার।” এই ময়রা হলেন প্রবাদপ্রতিম কবিয়াল ভোলা ময়রা। রসগোল্লার জন্মদাতা নবীন চন্দ্র দাস এঁরই নাতজামাই। থিয়েটার হোক বা টপ্পাগান, বাগবাজারকে কলকাতার প্রায় সব ঐতিহ্যের আকর বললে খুব ভুল কিছু হবে না। ফোর্ট উইলিয়াম তৈরি হওয়ার সময়ে সেই এলাকার বাসিন্দাদের যেমন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয় সুতানুটি অঞ্চলে, তেমনই ফোর্ট তৈরি হওয়ার পর ময়দান ও চৌরঙ্গির আশেপাশে ইয়োরোপিয় বসতি গড়ে ওঠে। একসময়ে সুতানুটি এলাকাকে বলা হতো ব্ল্যাক টাউন, আর এসপ্লানেড-চৌরঙ্গির নাম স্বাভাবিকভাবেই ছিল হোয়াইট টাউন। আশ্চর্যের বিষয় হল এই হোয়াইট টাউনের পাশেই গড়ে উঠেছিল জানবাজার অঞ্চল। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে জান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে, দৈবজ্ঞ, জ্যোতিষবিদ, হস্তরেখাবিদ বা গণক বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়। জানবাজারে যোগী পুরুষের বসবাসের কথা কলকাতার পুরোনো নথি ঘাঁটলে পাওয়া যায়। আবার কারও মতে সুরসম্রাজ্ঞী গওহরজানের একটি বাড়ি ছিল এই অঞ্চলে। তাঁর নামানুসারেও এই নাম হতে পারে। তবে হোয়াইট টাউনের পাশে নেটিভঅধ্যুষিত এমন একটি এলাকা থাকার ইতিহাসটি জানতে বড় ইচ্ছা করে। হয়তো ততটা আশ্চর্য ব্যাপার নয়ও, কারণ মানুষটি যখন গওহরজান, তখন সব কিছুই সম্ভব। শোনা যায়, খোদ গভর্নরের নাকের সামনে দিয়ে ফিটন চড়ে ঘুরতেন তিনি। এর জন্য তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল, কারণ গভর্নর বা রাজপরিবারের লোক ছাড়া ফিটন চড়ার অনুমতি মিলত না। বলা বাহুল্য, ফিটন চড়েই তিনি জরিমানা দিয়ে এসেছিলেন। তাঁর নামে এলাকার নাম জানবাজার হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু নামের সঙ্গে বাজার শব্দটা কেন যোগ হল, সে ইতিহাস আজ সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত। কোনও বাজার এখানে ছিল কিনা তার হদিশ পাওয়া যায় না। পরবর্তী সময়ে রানি রাসমণির বাসভবন হিসেবে জানবাজার প্রসিদ্ধ হয়েছিল, আজও মানুষ সে পবিত্র স্মৃতিজড়িত ভবনের টানে ছুটে আসে জানবাজারে। আর একটি বাজারকে স্বয়ং সুকুমার রায় চিরতরে বিখ্যাত করে দিয়ে গেছেন। “শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?” এই লাইনটা শোনেনি এমন বাঙালি বোধকরি নেই। এই পোস্তা বা পোস্তাবাজারের অদ্ভুত নামটি নিয়েও গল্পের ছড়াছড়ি। এখানে পোস্তর পাইকারি বাজার থাকলেও তার সঙ্গে এই নামকরণের কোনওই সম্পর্ক নেই। শোনা যায় এলাকার এক প্রাচীন কালীমন্দিরের দেওয়াল ছিল একেবারে গঙ্গা ঘেঁসে। জলের তোড়ে যাতে দেওয়াল ধসে না যায়, তাই ঠেস গাঁথা হয়েছিল। ফার্সিতে দেওয়ালের ঠেসকে বলে পুস্ত্। সেই পুস্ত্ থেকেই পোস্তাবাজার। খুব একটা যুক্তিবদ্ধ ব্যাখ্যা এটা নয়। অনেক ফার্সি শব্দ তখন ব্যবহার হত ঠিকই, তবে এত জিনিস থাকতে পাঁচিলের ঠেসের নামে জায়গার নাম হওয়াটা কিঞ্চিত অদ্ভুত শোনাচ্ছে বটে। পরের গল্পটিও বেশ চমকপ্রদ। সেই সময়ে শহরের রাস্তায় পড়ে থাকা মৃত পশুদের দেহ বিশেষ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমাধান হিসেবে এলাকাভিত্তিক ডোম নিযুক্ত করা হয়, তারা নিজের নিজের এলাকার পশুদের মৃতদেহ গরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে আসত গঙ্গার ঘাটে। সেখান থেকে আবার সব মৃতদেহ একত্রিত করে নিমতলা শ্মশানঘাটের সামনে আনা হত। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন তৈরি হতে তখনও ঢের দেরি, শহরের ভালোমন্দের ভার ছিল মেয়র আর জনাকয়েক বিশিষ্ট ব্যক্তি নিয়ে গঠিত জাস্টিসেস অফ দ্য পিসের উপর। তার চেয়ারম্যান ছিলেন একাধারে পুলিশ কমিশনার আর মিউনিসিপ্যাল প্রধান। যাইহোক, সেই কমিশনার মহোদয়ের কাছ থেকে ঠিকা নিয়ে এক চামড়াওয়ালা নিমতলার ঘাটে জড়ো করা মৃত পশুদের চামড়া ছাড়িয়ে মুচিদের কাছে বিক্রি করত। পোস্তার গা ঘেঁষেই ঘটত এইসব। ফার্সিতে চামড়ার জ্যাকেট বা কোটকে পুস্তিন বলা হয়। এর থেকেও এই নামের উৎপত্তি হতে পারে। অন্যদিকে পোস্তা শব্দটির একটি আভিধানিক অর্থ আড়ত। সুতরাং নদীতীরের বাণিজ্য কেন্দ্রের এমন নাম অযৌক্তিক নয় মোটেই। আসলে, কবে থেকে এসব প্রাচীন বাজার শুরু, তার সন তারিখ যেমন আজ সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে গেছে, তেমন কবে নামকরণ হল কেন হল সেসব তথ্যও কালের গর্ভে বিলীন। এও হতে পারে, আজ আমরা এই সব বাজার হাটকে যে নামে চিনি, শুরুতে হয়তো সে নাম ছিলও না। কোনও একটা বিশেষ ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে সে নাম কখন হয়তো পাল্টেও গেছে। যেমন পালটে গেছে এই এলাকার বাসিন্দারাও। অতীতে বাঙালি ব্যবসাদার অধ্যুষিত পোস্তাবাজারে এখন মারোয়াড়বাসীদের আধিপত্য। ভাবলে অবাক লাগে পোস্তাবাজারের বাঙালি ব্যবসায়ী লক্ষ্মীকান্ত ধর ওরফে নকু ধর এতটাই ধনী ছিলেন যে তিনি ইংরেজদের টাকা ধার দিতেন। তাঁর নাতি রাজা উপাধি পেয়ে পোস্তা রাজবাড়ির পত্তন করেন। সে রাজবাড়ি কিন্তু আজও আছে। একসময়ে এখানে আমের পাইকারি বাজার ছিল, লোকে বলতো আমপোস্তা। সেক্ষেত্রে আড়ত অর্থে পোস্তা শব্দের ব্যবহার যথাযথ মনে হয়। পোস্তার গা ঘেঁষে একেবারে নিজস্ব ছন্দে গা এলিয়ে দিয়েছে কলকাতার বৃহত্তম পাইকারি বাজার। স্রেফ এর আকারের কারণে নাম বড়বাজার হয়ে থাকতে পারে, তবে এই এলাকার জনপ্রিয় ইষ্টদেবতা মহাদেবকে আদর করে সবাই বুড়ো বলে ডাকে। সেই সূত্রেও এরূপ নামকরণ সম্ভব। একসময়ে সুতো ও কাপড়ের মূল ঘাঁটি এই বড়বাজারেই ছিল। আজ জামাকাপড়ের পাশাপাশি চলতি কথায় যাকে বলে হিরে থেকে জিরে, সমস্তই পাওয়া যায় বড়বাজারে। এখানেও মারোয়াড়ি বণিকদের আধিপত্য অনস্বীকার্য। জোড়াসাঁকো শব্দটির সঙ্গে বাঙালির অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। সে বিচিত্র অনুভূতি বিশ্লেষণ করলে নানা রং নিঃসৃত হতে পারে, কিন্তু বাজার সংক্রান্ত কোনও চিন্তা বা মনের ভাব তাতে নিশ্চিতভাবেই নেই। কিন্তু এই জোড়াসাঁকোরই আদি নাম ছিল মেছুয়াবাজার। নামেই মালুম, মস্ত এক মাছের আড়ত বা বাজার ছিল এখানে। বিরাট একটা মাছের বাজারের মাঝে ঠাকুরবাড়ি, কল্পনা করা যায়? তবে মেছুয়াবাজারের চারজন পালোয়ানকে রবিঠাকুর তাঁর খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থে সসম্মানে স্থান দিয়েছেন। প্রেমিকার বিরহ পৃথিবীতে অনেক কাব্য অনেক শিল্পের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে না হোক, পরোক্ষভাবে চমৎকার একটি বাজারের জন্ম দিয়েছে এমন নজির বোধহয় খুব বেশি নেই। দুরারোগ্য অসুখে প্রেমিকার মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে ভেনিসের তার্ভিসিও থেকে সুদূর কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন এদুয়ার্দো তিরেত্তা। ইংরেজ শাসনে তখন নতুন করে গড়ে উঠছে কলকাতা শহর। ইয়োরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভাগ্য অন্বেষণে কত মানুষ আসছে তখন সেখানে, কলকাতা তাদের নিরাশ করছে না। তিরেত্তা ছিলেন পেশায় একজন স্থপতি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সহজেই বহাল হলেন তিনি। প্রথমে আঁকতেন শহরের মানচিত্র। পারদর্শিতা দেখিয়ে ক্রমে সুপারইন্টেডেন্ট অফ স্ট্রিটস অ্যাণ্ড বিল্ডিং পদে উন্নীত হয়েছিলেন। হাজার সিক্কা বেতন পেতেন সে যুগে। ব্যবসার দিকে মন কবে ঘুরেছিল জানা যায় না, তবে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে ন’ বিঘা আট কোটার এক বাজারের মালিক হয়েছিলেন তিরেত্তা। ভাড়া বাবদ সেই বাজার থেকে প্রতি মাসে তাঁর সাড়ে তিন হাজার টাকার বেশি আয় হত। অবিশ্বাস্য হলেও ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের কোম্পানির এক নথিতে এই বাজারের নানা প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায় এই বাজারে পাকা দোকানঘর ছিল, যা সেই সময়ের নিরিখে বেশ বিরল। অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে বাজারের এক অংশে পশুপাখিও বিক্রি হত। আসলে তিরেত্তার পাখি পোষার সখ ছিল খুব। বলা বাহুল্য, এই বাজারকেই আমরা আজ টেরিটিবাজার বলে চিনি। এত সমৃদ্ধশালী হওয়া সত্ত্বেও বিলাসবহুল জীবনের কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছিলেন তিরেত্তা। দেনার দায়ে এই বাজারকে লটারির প্রথম পুরস্কার হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ক্যালকাটা গেজেটে এই লটারির বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল। পাকা দোকানঘর আর বাঁধানো রাস্তার এই অসামান্য বাজার লটারিতে জিতে নিয়েছিলেন চার্লস ওয়েস্টন নামে আর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এত সব ঘটনার ঘনঘটায় তিরেত্তা তাঁর মৃত প্রেমিকাকে ভুলতে পেরেছিলেন হয়তো, কারণ বিবাহ করেছিলেন এক সুন্দরী কিশোরীকে। দুর্ভাগ্যবশত তারও মৃত্যু হয় অকালে। হারিয়ে গেছে তিরেত্তার কবর, কিন্তু টেরিটিবাজার আজও রমরমিয়ে চলছে। যদিও এখন এই অঞ্চলে চিনাদের আধিপত্য। চিনা খাবারের পীঠস্থান বলা যায় টেরিটিবাজারকে। ইতালিয় তিরেত্তা তাঁর সাধের বাজারে পাস্তার বদলে চাউমিন বিক্রি হতে দেখলে কী বলতেন তা অবশ্য জানি না। টেরিটিবাজার থেকে দু’পা এগোলেই আরও একটি প্রাচীন বাজারে পৌঁছানো যায়। এখানে নাকি বহু প্রকার জিনিসপত্র বিক্রি হত, তাই প্রথমে এই বাজারের নাম হয় বহুবাজার, পরে অপভ্রংশ হয়ে সেটি বউবাজার হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাঙালির কল্পনাশক্তির এত ঘাটতি বোধহয় কোনওদিন হয়নি যে রকমারি জিনিস বিক্রি হলে তাকে বহুবাজার নাম দেবে। বরং আর একটি মত অনুযায়ী মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মতিলালের তাঁর বাঙালি পুত্রবধূকে একটি বাজার লিখে দেওয়ার গল্পটা অনেক বেশি সম্ভবপর বলে মনে হয়। সেই সূত্রে এই বাজার বহুবাজার বা বউবাজার হয়ে উঠতেই পারে। তবে এই মতিলাল মহাশয়ের আর কোন পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। হয়তো সম্পূর্ণ অজানা কোন কারণ লুকিয়ে আছে এই নামের পিছনে। এই বউবাজারেই হুগলির প্রাণচন্দ্র নাগ তাঁর পারিবারিক মিষ্টির দোকান শুরু করেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র দোকানের ভার নেওয়ার পর একদিন তৎকালীন ভাইসরয় চার্লস জন ক্যানিংয়ের প্রতিনিধি সেই দোকানে আসেন। ভাইসরয় পত্নীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে নতুন কোনও মিষ্টি বানানোর ভার দেন তাঁকে। ভাইসরয় পত্নীর নামেই সে মিষ্টির নামকরণ করা হয়, যদিও নামটি অপভ্রংশ হয়ে বেশি পরিচিতি পায়। আমরা সে মিষ্টিকে লেডিকেনি নামে চিনি, আর তার স্রষ্টা হলেন ভীম চন্দ্র নাগ। জানবাজার রাজবাড়িতেও মিষ্টি যেত এই দোকান থেকেই। এছাড়াও বউবাজার কলকাতার প্রধান গয়নার বাজারও বটে। পুরোনো নথি ঘাঁটলে উঠে আসে আরও কিছু বাজারের নাম, তবে আজ আর তাদের অস্তিত্ব নেই। এই সমস্ত বাজারের ব্যবসায়ীরা ছিলেন দেশিয় অথবা মারোয়াড়ি। ততদিনে ইংরেজ শাসকরা জাঁকিয়ে বসেছে কলকাতায়। স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব একটি বাজারের প্রয়োজন তাদের হয়েছিল। কমিশনার স্টুয়ার্ট হগের উদ্যোগে শুরু হলো সে বাজারের পরিকল্পনা। জমির দাম বাবদ দুই লক্ষ টাকা আর নির্মাণ বাবদ আড়াই লক্ষ টাকা লগ্নি করা হয়েছিল। ব্রিটেনের রেল স্টেশনের আদলে বাজারের নকশা তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত স্থপতি রিচার্ড বেইন। অবশেষে ১৮৭৪ সালের পয়লা জানুয়ারি এই বাজারের উদ্বোধন হয়, স্টুয়ার্ট হগের নামানুসারে বাজারের নাম হয় হগ মার্কেট। আমরা আজ একে নিউ মার্কেট বলে চিনি। এক সময়ে লোকে বলত খুঁজলে নাকি হগ মার্কেটে বাঘের দুধও পাওয়া যেতে পারে। মানুষের চাহিদার সঙ্গে আজ পাল্টে গেছে বাজারের চরিত্র, তার পসরা। আলো পিছলানো ঝাঁ চকচকে মল অনেক পিছনে ফেলে এসেছে সাদামাটা বাজারকে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে বহুমূল্য দুষ্প্রাপ্য বস্তু সবই পাওয়া যায় এক ছাদের তলায়। বাড়িতে বসেও আজ মনের সাধ মিটিয়ে অঙ্গুলিহেলনে যা ইচ্ছা তাই কেনা যায়, বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত পড়ে না। তবু বাজারপ্রিয় আম বাঙালির অন্তরাত্মায় আজও কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে এক বাজার রসিক, যার প্রাণ মলের অত্যাধুনিক পরিবেশে ঠিক তৃপ্ত হয় না, বাজারের নোংরা রাস্তায় জলকাদা ডিঙিয়ে রোজের থোড় বড়ি খাড়া থলিতে ভরে নিতে নিতে সে আড়চোখে তাকায় রুপোলি ইলিশের দিকে। তারপর হয়তো সাধ্যের বাইরে জেনেও জিজ্ঞেস করে ফেলে, “আজ ইলিশ কত করে যাচ্ছে হে?” সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কি আর এমনি এমনি ভজবাজারুকে সৃষ্টি করেছিলেন? তথ্যঋণ: